কালকিনির ইউএনও বলেন, “সোহেল হাওলাদার নামের বিএনপির এক নেতা লেখকের ঘর দখলে নিয়ে ওএমএসের ডিলারের চাল রেখেছিলেন।”
Published : 10 Sep 2024, 12:04 AM
মাদারীপুরের ডাসার উপজেলায় প্রখ্যাত কবি ও ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটেবাড়ি দখলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় এক বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে। সেখানকার ঘরে সংরক্ষিত বই, আসবাবপত্র ও ছবি ফেলে দিয়ে ওএমএসের চাল রাখা হয়েছে।
শনিবার দুপুরে বিএনপির ডাসার উপজেলা কমিটির সাবেক আইনবিষয়ক সম্পাদক সোহেল হাওলাদার বাড়িটি দখলে নেন বলে কালকিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উত্তম কুমার দাশ জানান।
তিনি বলেন, “সোহেল হাওলাদার নামের বিএনপির এক নেতা লেখকের ঘর দখলে নিয়ে ওএমএসের ডিলারের চাল রেখেছিলেন। আমরা ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই তিনি ওই চাল সরিয়ে ফেলেছেন। ওই দখলদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
বর্তমানে ডাসার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) পদ শূন্য রয়েছে।
সোহেল হাওলাদারের বাড়ি উপজেলার কাজীবাকাই এলাকায়।
ডাসার ও কালকিনি উপজেলা প্রশাসন এবং স্থানীয়রা জানায়, কালকিনি উপজেলা ভেঙ্গে নবগঠিত ডাসার উপজেলার কাজীবাকাই ইউনিয়নের পূর্ব মাইজপাড়ায় মৌজায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাত একর ১৫ শতাংশ পৈতৃক জমি রয়েছে। এসব জমির মধ্যে দুই একর ৯৭ শতাংশ জমি সরকারের খাসজমি হিসেবে রেকর্ড।
শনিবার দুপুরে লেখকের পৈতৃক ভিটার একটি টিনশেড ঘরের (সুনীল স্মৃতি পাঠাগার) তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেন বিএনপি নেতা সোহেল হাওলাদার ও তার লোকজন। পরে তারা লেখকের ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি, বই, আসবাব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিসহ একাধিক ছবি ভাঙচুর করেন।
এরপর তারা ওই ঘরে ওএমএসের প্রায় এক ট্রাক চাল রেখে নতুন তালা ঝুলিয়ে দেন। এ ছাড়া লেখকের বাড়ির সামনে জেলা প্রশাসক কর্তৃক লাগানো একটি সাইনবোর্ডও ভেঙে সরিয়ে ফেলা হয়।
লেখকের পৈতৃক ভিটা দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন স্থানীয় এক ব্যক্তিকে। তিনি বলেন, “সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর থেকেই সোহেল হাওলাদার লোকজন নিয়ে লেখকের জমি তার নিজের বলে দাবি করেন। আওয়ামী লীগের কয়েকজন কর্মী-সমর্থক তার সমালোচনা করলে তাদের বাড়িঘরে হামলা চালান সোহেল ও তার লোকজন।
“রাজনৈতিক পরিবেশ পরিবর্তন হওয়ায় এখন ভয়ে গ্রামের কেউ কথা বলছেন না। এই সুযোগে সোহেল তার লোকজন নিয়ে এখানকার টিনশেড ঘরের তালা ভেঙে নতুন তালা ঝুলিয়ে দেন। ওই ঘরে আবার ওএমএসের চাল রাখেন। বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে সবাই জানে। কিন্তু বাড়ি উদ্ধারে তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে এখনো দেখা যায়নি।”
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মারুফুর রশীদ খান বলেন, “সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটেবাড়িতে থাকা একটি টিনশেড লাইব্রেরি ঘরের তালা ভেঙে এক ব্যক্তি দখলে নেওয়ার খবর আমরা পেয়েছি। যারা এই কাজের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট ইউএনও ও এসি ল্যান্ডকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারা লেখকের বাড়িটি দখলমুক্ত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন।”
এ বিষয়ে জানতে সোহেল হাওলাদারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। খুদে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।
ভিটা দখলের নিন্দা
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটা বেদখল হওয়ায় ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন জেলার সাংস্কৃতিক কর্মী ও সাহিত্যপ্রেমীরা। তাদের দাবি, দখলদারদের শাস্তি নিশ্চিত করে লেখকের ভিটা দখলমুক্ত করে তা সংরক্ষণ ও সংস্কার করতে হবে।
কথাসাহিত্যিক মাসুদ সুমন বলেন, “প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও আমাদের প্রিয় লেখকের শেষ স্মৃতিচিহ্ন তার পৈতৃক ভিটা। যেটা দখলের কথা শুনে আমাদের হৃদয় ব্যথিত করেছে। খুবই দুঃখজনক ঘটনা। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। দখলদারের বিচার নিশ্চিত করে প্রশাসনের কাছে বেদখল হওয়ার জমি পুনরুদ্ধারের দাবি জানাই।”
সুনীলের স্মৃতি ধরে রাখতে ২০০৫ সালে মাদারীপুরে সুনীল সাহিত্য ট্রাস্ট্রের উদ্যোগে ‘সুনীল সাহিত্য পুরস্কার’ চালু করা হয়।
সেই পুরস্কারপ্রাপ্ত গল্পকার রিপনচন্দ্র মল্লিক বলেন, “সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জীবিত থাকা অবস্থায় তার ৭৫তম জন্মদিন পূর্ব মাইজপাড়ার বাড়িতে আমরা উদযাপন করেছিলাম। তখন সপ্তাহব্যাপী সুনীল মেলারও আয়োজন করা হয়েছিল ওই বাড়িতে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার ভিটেবাড়ি দখল হয়ে যাওয়াটা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য খুবই লজ্জার। আমি দ্রুত দখলমুক্ত চাই কবির ভিটেবাড়ি।”
উদ্ভাস আবৃত্তি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আঞ্জুমান বলেন, “সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমাদের মাদারীপুরের শুধু গর্ব নন, পুরো পৃথিবার সব বাঙালির গর্ব। সরকারিভাবে লেখকের পৈতৃক ভিটায় সুনীল সাহিত্য গবেষণাকেন্দ্রসহ একটি জাদুঘর করার কথা। অথচ সরকার পরিবর্তনের পর সেটি দখল হয়ে যাওয়া খুবই অপ্রত্যাশিত একটি ঘটনা। খুব দ্রুত প্রশাসনের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে লেখকের পৈতৃক ভিটা দখলমুক্ত করার দাবি জানাচ্ছি।”
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর মাদারীপুরের রাজৈরের আমগ্রামের মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক বাড়ি কালকিনির পূর্ব মাইজপাড়া গ্রামে। তিনি ২০১২ সালের ২৩ অক্টোবর কলকাতায় মারা যান।