“হিন্দু হওয়ায় আমার এই সর্বনাশ হইছে। আমি এর বিচার চাই”, বলেন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান।
Published : 12 Aug 2024, 11:14 PM
নেত্রকোণা সদর উপজেলায় মধ্যরাতে সনাতন ধর্মাবলম্বী সাবেক এক ইউপি চেয়ারম্যানের বাড়িতে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এতে নয়টি গরু, ছয়টি ছাগল ও সেচের যন্ত্রপাতি ছাই হয়েছে।
রোববার মধ্যরাতে উপজেলার ঠাকুরাকোণা ইউনিয়নের সোয়ারীকান্দা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে বলে জানান সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানিয়া তাবাসসুম।
ওই বাড়ির মালিক ঠাকুরাকোণা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান দীপক কুমার সাহা রায় চৌধুরী। সোমবার সকালে খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
এ ঘটনার পর থেকে ওই এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের মাঝে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক।
সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান দীপক কুমার সাহা বলেন, রোববার মধ্যরাতে বাড়ির নাটমন্দিরের পাশে একটি গোয়াল ঘরে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। আগুন দেখে বাড়ির লোকজন ডাক-চিৎকার শুরু করলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয়রা মিলে আগুন নেভানোর চেষ্টা করা হয়।
খবর পেয়ে সেনা সদস্যসহ ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। তবে আগুন নিয়ন্ত্রণের আগে ঘরে থাকা নয়টি গরু ও ছয়টি ছাগল এবং সেচের যন্ত্রপাতি পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
আগুনে অন্তত ১৬ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি দীপক কুমার সাহার।
তিনি বলেন, “অন্ধকারের মধ্যে আগুন দিয়েছে। কাউকে চেনা যায়নি। আমার কোনো শত্রু নাই। এরপরও আগুন দিছে। গোয়াল ঘরের থাকা সব গবাদিপশু পুড়ে মারা গেছে। ঘরে ৫০০ মণের মতো খর আছিল। আমার সর্বনাশ করে ফেলছে।
“এলাকার মুসলমান, হিন্দু সবাই মিলে আগুন নিভাইছে। ফায়ার সার্ভিস ও আর্মির লোকজন রাতেই আসছিল। এখনও ধোঁয়া উঠতাছে। হিন্দু হওয়ায় আমার এই সর্বনাশ হইছে। আমি এর বিচার চাই।”
দীপক সাহা রায়ের ছোট ভাই অরুণ কান্তি সাহা রায় চৌধুরী বলেন, “আমরা ভীষণভাবে আতঙ্কিত। কারণ আমরাত মাইনোরিটি। আমরাত এইহানে ভয়ভীতি নিয়েই থাকতাছি। খুব বিপদের মধ্যে দিন চলতাছে। আমরা যে উইঠ্যা দাঁড়াব, এমন অবস্থা নাই।”
এলাকার মুসলমান সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা এ ঘটনায় মর্মাহত। তারা এ ঘটনার বিচার দাবি করেছেন।
আবেগাপ্লুত হয়ে ওই গ্রামের ষাটোর্ধ্ব ওয়ারেস আলী ফকির বলেন, “আমার মনের মধ্যে অনেক কষ্ট আইছে। আমরা এর জন্যে অনেক দুখিত। সকালে শোনার পর আইছি। এখনও এখানেই আছি। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই।”
একই গ্রামের কডু চান মিয়া বলেন, “রাতেই শব্দ শুনে আইছি। আইয়া দেহি বাড়ির মধ্যে আগুন। সব পুইড়া যাইতাছে। সবাইরে ডাকাডাকি কইর্যা আইন্যা পানি দিয়া নিভায়া জীবনডা বাচাইছি। গরু-বাছুর বাঁচাইতাম পারলাম না। যারা এই কাজ করছে, এরা কী মানুষ। বোবা প্রাণীডিরে পুইড়া মারছে।”
আরেক বাসিন্দা রেজাউল হক বলেন, “এই রহম ঘটনা ঘটবে, আমরা কেউই কল্পনা করতে পারি নাই। সারা দেশে যহন ঘটনা ঘটতেছে, তহন উনার বিষয়ে আমরা সতর্ক আছিলাম। এলাকার মানুষ সবাই আমরা তৎপর আছিলাম। উনি খুবই ভাল মানুষ।
“যহন চেয়ারম্যান আছিলেন তহন, এলাকার মানুষের সেবা করছেন। উনি যহন চেয়ারম্যান আছিলেন, তহন ক্ষমতা দেখায়া কারো ক্ষতি করছে কেউ বরতে পারবে না। আমরা এ ঘটনার উপযুক্ত বিচার চাই।”
সোমবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন নেত্রকোণা জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি জ্ঞানেশ রঞ্জন সরকার, সাধারণ সম্পাদক লিটন পণ্ডিত, জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি সিতাংশু বিকাশ আচার্য্য এবং সাধারণ সম্পাদক মানকি সাহা রায়।
এ সময় তারা আগুনের ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
বিকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানিয়া তাবাসসুম। এ সময় ঘটনাস্থলে বিএনপি নেতারাও উপস্থিত ছিলেন।
ইউএনও তানিয়া তাবাসসুম বলেন, “সকালে আগুনের কথা জানতে পারি। গিয়ে যা দেখলাম, তাতে পরিস্থিতিটা কোনো দুস্কৃতিকারীর মাধ্যমে ঘটেছে। গবাদিপশু ও খড়ের গাদা পুড়ে গেছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।
“আমরা আশ্বাস দিচ্ছি, এ ঘটনার সঙ্গে যে বা যারাই জড়িত থাকুক, আমরা তদন্ত করছি। সবাই আমাদের সহযোগিতা করুন। দায়ী ব্যক্তিদের সকলের সামনে আনতে চাই।
“আমরা সবাই বাঙালি, বাংলাদেশের নাগরিক। এখানে কেউ সংখ্যালঘু নয়। অসাম্প্রদায়িক একটি সমাজে আমরা বাঁচতে চাই।”
নেত্রকোণা জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মজিবুর রহমান খান তার কর্মীদের নিয়ে ঘটনাস্থলে সভা করেছেন।
এ সময় মেদনী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম, ঠাকুরাকোণা ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি সংগ্রাম মিয়া, মেদনী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি হাশেম মিয়া, বিএনপি নেতা মিঠু মিজান এবং সদর উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি খায়রুল আলম মাসুদ উপস্থিত ছিলেন।