মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার পর ২০০৪ সালে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় এরশাদ শিকদারকে। তার বিরুদ্ধে অর্ধশত হত্যার অভিযোগ ছিলো।
Published : 05 Jan 2023, 03:35 PM
খুলনার আলোচিত খুনি ও শীর্ষ সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদারের সেই বহুল আলোচিত বাড়ি 'স্বর্ণকমল' ভেঙে ফেলা হচ্ছে।
বুধবার দুপুরে নগরীর সোনাডাঙ্গার মজিদ সরণির বাড়ির সামনে গিয়ে উৎসুক লোকজনের ভিড় দেখা যায়। তাদের কেউ দাঁড়িয়ে ভবন ভাঙা দেখছেন; কেউ ছবি তুলছেন। বাড়ির গেইটের ভেতর থেকে তালা দেওয়া থাকায় কেউ ঢুকতে পারছেন না।
চারজন শ্রমিক দোতলা বাড়িটির মূল ভবনের ছাদে ভাঙার কাজ করছেন। তাদের একজন সর্দার রবিউল হোসেনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সোনাডাঙ্গার মজিদ স্মরণিতে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ১০ কাঠা জমির ওপর এরশাদ শিকদারের একটি পুরানো তিনতলা এবং আরেকটি দুইতলা বাড়ি ছিলো। মূলত দোতলা ওই ভবনটির নামই ‘স্বর্ণকমল’।
সম্প্রতি এরশাদ শিকদারের পরিবারের সদস্যরা পুরানো তিনতলা ভবনটি শ্রমিক দিয়ে ভেঙে ফেলেছেন। এখন দুইতলা ভবনটির অর্ধেকের মতো অংশ ভাঙা হচ্ছে।
রবিউল বলেন, ভবন ভাঙার পর এখানে নতুন করে দশতলা ভবন নির্মাণ করা হবে বলে তিনি শুনেছেন।
খুলনার এরশাদ শিকদার দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ছিলেন। তিনি ও তার গড়ে তোলা বাহিনীর হাতে একাধিক হত্যার রোমহর্ষক ঘটনা দুই যুগ আগে বাংলাদেশে আলোড়ন তুলেছিল।
মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার পর ২০০৪ সালে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় এরশাদ শিকদারকে। তার বিরুদ্ধে অর্ধশত হত্যার অভিযোগ ছিলো।
তার দেহরক্ষী নূরে আলম সাক্ষ্যতে বলেছিলেন, এরশাদ শিকদারের ২৪টি হত্যাকাণ্ড তিনি দেখেছেন। এর বাইরে সব মিলিয়ে ৬০টি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন বলে তার জানা।
হত্যার পর মরদেহগুলো ইট, পাথর বেঁধে বস্তায় ভরে ভৈরব নদে ফেলে দেওয়া হতো। ফলে অনেক সময় মৃতদেহ পাওয়া যেতো না। কোনো মামলাও হতো না। হত্যার পর দুধ দিয়ে গোসল করতেন এরশাদ ও তার সহযোগীরা।
এসব রোমহর্ষক ঘটনা গণমাধ্যমে আসার পর সারাদেশে এরশাদ শিকদারকে নিয়ে আলোচনা তৈরি হয়। আর খুলনা শহরে তার বাড়িটি পরিণত হয় মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রস্থলে।
এরশাদ শিকদারের ফাঁসির কিছুদিন পর উৎসুক জনতা বাড়ির নামফলকটি খুলে ফেলে। তারপরও বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ বাড়িটি দেখতে আসতেন।
নগরীর সোনাডাঙ্গা এলাকার বাসিন্দা শাহীন আহমেদ জানান, অর্থের প্রয়োজনে এরশাদ শিকদারের বড় স্ত্রী খোদেজা বেগম ও তার সন্তানরা ‘স্বর্ণকমল’সহ পাঁচ কাঠা জমি বিক্রি করে দিয়েছেন। যারা কিনেছেন, তারাই ভবনটি ভেঙে ফেলছেন। ওই বাড়িতে এখন এরশাদ শিকদারের ছোট ছেলে হেলাল শিকদার, হেলালের স্ত্রী ও এক ছেলে থাকেন।
এরশাদ শিকদারের বড় ছেলে মনিরুজ্জামান শিকদার জামাল ও মেঝো ছেলে কামাল শিকদার অন্য জায়গায় থাকেন। জামাল শিকদারের দুই মেয়ে, কামাল শিকদারের তিন ছেলে, হেলাল শিকদারের এক ছেলে। মেয়ে সুবর্ণা ইয়াসমিন স্বাদ বিয়ের পর থেকে শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। তার ঘরে তিন ছেলে রয়েছে।
আরেক মেয়ে জান্নাতুল নওরিন এশা ২০২২ সালের ৩ মার্চ আত্মহত্যা করেন। এরশাদের দ্বিতীয় স্ত্রী সানজিদা নাহার শোভাও অন্যত্র থাকেন।
এরশাদের মেঝো ছেলে কামাল শিকদার সাংবাদিকদের জানান, ১০ কাঠা জমির মধ্যে পাঁচ কাঠা জমি তার বাবা এরশাদ শিকদারের নামে এবং পাঁচ কাঠা তার মা খোদেজা বেগমের নামে। তার মায়ের নামে যে অংশ মূলত সেই অংশের স্থাপনা অপসারণ করা হচ্ছে।
কামাল বলেন, “ওই পাঁচ কাঠা জমির ওপর ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ১০ তলা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।”
‘খুলনার জল্লাদ এরশাদ শিকদার’- নামে একটা বই লিখেছেন সাংবাদিক মোহাম্মদ আবু তৈয়ব। ওই বই এবং ওই সময়ে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, এরশাদ শিকদারের জন্ম ঝালকাঠির নলছিটিতে। ১৯৬৭ সালে তিনি খুলনায় চলে যান।
সেখানে রেলস্টেশনে কুলির কাজের পাশাপাশি রেললাইনের পাত চুরি করে বিক্রি করতেন। এই কারণেই তিনি 'রাঙ্গা চোর' হিসাবে পরিচিতি পান।
পরবর্তী সময়ে সেখানে তিনি ঘাট সর্দার বা কুলিদের সর্দার হয়ে ওঠেন। সেই সময় তিনি একটি সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন করে খুলনা রেলস্টেশন, চার ও পাঁচ নম্বর ঘাট এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করেন।
১৯৮২ সালে এইচ এম এরশাদের সামরিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন এরশাদ শিকদার। তারপর থেকে তার দ্রুত উত্থান হতে থাকে। তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন।
তখন খুলনার বাণিজ্যবহুল এলাকা হিসেবে সাত ও চার নম্বর ঘাট এলাকার বহুল পরিচিতি ছিল। এসব ঘাট এলাকা দখল করে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন এরশাদ শিকদার। রেলওয়ের এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি দখল, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, হত্যাকাণ্ডের মতো অসংখ্য অপরাধে জড়িয়ে পড়েন তিনি। তার অত্যাচারে এই ঘাট স্থানান্তরিত হয়ে নোয়াপাড়ায় চলে যায়।
১৯৮৮ সালে খুলনার ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনারও নির্বাচিত হন এরশাদ শিকদার। ফাঁসির আগ পর্যন্ত ওই ওয়ার্ডের কমিশনার ছিলেন তিনি। কিন্তু কমিশনার হওয়ার পর তার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থামেনি। তার এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশাসন বা পুলিশের লোকজনও সহায়তা করতেন বলে স্থানীয়দের অভিযোগ ছিল।
নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় সামরিক শাসকের পতন হলেও এরশাদ শিকদারের ক্ষমতার প্রভাববলয় টলেনি। পরবর্তী সময়ে যারা ক্ষমতায় এসেছেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা তাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তখন ‘স্বর্ণকমলে’ অনেক রথি-মহারথিদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল।
১৯৯৯ সালে যুবলীগ নেতা খালিদ হোসেন হত্যাকাণ্ড এরশাদ শিকদারের লাগাম টেনে ধরে। সেসময় তিনি গ্রেপ্তার হন। বিচার চলাকালে তার নামে ৪৩টি মামলা হয়েছিল। তার মধ্যে সাতটি মামলায় তার ফাঁসির আদেশ হয়।
২০০৪ সালের ১০ মে রাত ১২টা ১ মিনিটে এরশাদ শিকদারের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।