গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের উচ্ছেদের সময় তাদের ঘরে পুলিশের আগুন দেওয়ার ভিডিও গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর ক্ষুদ্র এই নৃ-গোষ্ঠীর মানুষরা ক্ষতিপূরণের জোরালো দাবি তুলেছেন।
Published : 18 Dec 2016, 03:27 PM
তারা বলছেন, বাপ-দাদাদের এই ভিটেমাটি ফিরে পাওয়ার আশায় তারা যার যার শেষ সম্বলটুকু ব্যয় করে সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মের ওই জমিতে বসতি গেঁড়েছিলেন, যেখানে শুধু ঘর নয়, গবাদিপশু ও শস্যও ছিল। সেগুলো রক্ষায় প্রস্তুতি নেওয়া দূরের কথা, কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়।
পুলিশের আগুন দেওয়ার ওই আলোচনা শুরুর পর আগুন দেওয়ার সঙ্গে পুলিশ জড়িত কিনা এবং কারা ওই ঘটনায় দায়ী- তা গাইবান্ধার মুখ্য বিচারিক হাকিমকে খতিয়ে দেখতে বলেছে হাই কোর্ট।
পাশাপাশি উচ্ছেদের সময় ভাঙচুর, লুটপাট ও হতাহতের ঘটনায় দায়ের করা একটি এজাহার ও একটি জিডি মামলা হিসেবে নিয়ে সমান গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করতে বলেছে আদালত।
১৯৬২ সালে রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষ সাঁওতাল ও বাঙালিদের ১৮টি গ্রামের ১ হাজার ৮৪০ দশমিক ৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করে আখ চাষের জন্য সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার গড়ে তুলেছিল।
গত ৬ নভেম্বর চিনিকল কর্তৃপক্ষ জমি উদ্ধার করতে গেলে সংঘর্ষ বাঁধে। সংঘর্ষের সময় সাঁওতালদের বাড়িঘরে আগুন দিয়ে লুটপাট চালানো হয়। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি চালায়। ওই ঘটনায় নিহত হন তিন সাঁওতাল, আহত হন অনেকে।
ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মাদারপুর গ্রামের বাসিন্দা রুমিলা কিসকু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অবশেষে গরিবের কথা সত্য হল। শুনেছি সাঁওতালদের উচ্ছেদ ঘটনার জীবন্ত প্রমাণ ভিডিও একটি বিদেশি ও কয়েকটি দেশি টিভি ও ইন্টারনেটে প্রকাশ করা হয়েছে।
“পুলিশেরাই আমাদের গুলি করছে। আগুন জ্বালায়া দিছে। যখন আগুন লাগে, তখন আমি ওখানে দাঁড়ায়া দেখতেছিলাম। প্রশাসনের লোকেরা এবং পুলিশ প্রথমে আগুন দেয় ও পরে গুলি চালায়।”
উচ্ছেদের সময় আগুন ও লুটপাটে ক্ষতিগ্রস্ত বাঙালি নারী তাসলিমা বললেন, “একটুও সময় দেয়নি। প্রথমে গুলি, তারপর আগুন। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘরবাড়ির মালামাল লুট হয়ে যায়। গরু-ছাগল পুড়ে অঙ্গার হয়েছে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়ই।
শুধু রুমিলা কিসকু আর তাসলিমার নয়। উচ্ছেদ হওয়া সুমি সরেন, কান্দিয়া সরেন, পরিমল মুরমু, রোজিনা টুডু, রিণা মার্ডি ও মঙ্গল টুডু- সবাই একই সুরে কথা বললেন।
“তখন কেউ পুলিশের আগুন দেওয়া কথা বিশ্বাস করে নাই। এখন তো প্রমাণ আছে।
চিনিকলের খামারের জমির ঘরবাড়ি লুটপাট ও পোড়ার পর নিঃসম্বল ও নিঃস্ব অবস্থায় অনেকেই মাদারপুর গ্রামের পরিত্যক্ত স্কুল মাঠের খোলা আকাশের নিচে ঠাঁই নিয়েছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এই বৃদ্ধা বলেন, “এই জমি ফেরত পাব জেনে ধার-দেনা করে ঘর বেঁধেছিলাম। সব ছাই হয়ে গেছে।”
দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার বেলোয়া গ্রামে পরের আশ্রয়ে থাকা রোজিনা টুডু বলেন, উত্তরাধিকার সূত্রে ১৫ একর ১২ শতক জমি ফেরত পাওয়ার আশায় প্রায় ২৫ হাজার টাকা খরচ করে ৩ বান ঢেউটিন আর ১৯টি বাঁশ কিনে ঘর তুলেছিলেন। ৫ শতকে শাক-সবজি, ৪ বিঘেতে কালাই ও ৪ বিঘেতে সরিষা বুনেছিলেন।
“আগুন আর লুটেরাদের কবলে পড়ে সব শেষ হয়ে গেছে।”
গোবিন্দগঞ্জের জীবনপুর গ্রামে অন্যের আশ্রয়ে থাকা ফানছিন টুডুর স্ত্রী রিণা মার্ডির অবস্থাও ভিন্ন নয়। স্বামী ও মেয়েসহ সাড়ে চার বান ঢেউ টিনের ঘরে থাকতেন। মাঠে ছিল তার চার বিঘে কালাই আর দুই বিঘে সরিষা। হাঁস-মুরগির সঙ্গে একটি শুকর ও একটি গরুও ছিল। এখন সব হারিয়ে নিঃস্ব তিনি।
মদনপুর গ্রামের মঙ্গল টুডু বলেন, জীবনে শেষ সম্বল হিসেবে ছিল একটি গরু। ২০ হাজার টাকা সেটি বিক্রি করে। সেখানে এক চালা দুটি ঘর তোলনে। এখন তিনি পথের ভিখারী।
এরকম শত শত সাঁওতাল পরিবার ঘরবাড়ি হারিয়ে এখন আশ্রয় নিয়েছে মাদারপুর গির্জা ও পরিত্যক্ত স্কুল মাঠে। তারা জানালেন, চার দিন আগে সহায়তা হিসেবে পাওয়া চার শতাধিক প্লাস্টিকের তাঁবু তাদের শীতের কষ্ট সামান্য কমিয়েছে। তবুও মাটির উপর খড় বিছিয়ে পাতলা কম্বলে শীত নিবারণ হচ্ছে না।
“তবে হাজার কষ্ট হলেও সাঁওতাল ও বাঙালিরা বাপ-দাদার জমি ফেরত পাবার দাবি থেকে সরে আসবে না।”
ভূমি উদ্ধার কমিটির সদস্য বার্ণাবাস টুডু জানান, প্রায় দুই হাজার পরিবারের বেশি লোক ওই জায়গায় বসতি গড়েছিল। সেখানে কালাই, সরিষা ও শাকসবজি ছাড়াও সমিতির মাধ্যমে যৌথভাবে ধান চাষ করা হয়। এজন্য ১৬টি শ্যালো মেশিন ও ৯টি পাওয়ার টিলার বাকিতে কেনা হয়েছিল, যা ওই সময় লুট হয়ে যায়। ওই দেনার কিছুটা অংশ ১৫০ বস্তা ধান বিক্রি করে শোধ করা হবে। এজন্য ধানের ভাগ কোনো সাঁওতালকে দেওয়া হয়নি।
“এখন ভিডিও বের হয়েছে। কোনো সন্দেহ তো আর নেই। অমরা যে কথা আগে থেকেই বলে আসছি। এখনো বলছি অমাদেরকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ওই ঘটনার বিচার করতে হবে।”
ভিডিও চিত্রের কথা বললে গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসি সুব্রত কুমার সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিষয়টি আমার জানা নেই। পুলিশ যে আগুন দেয়নি এটাই সত্য।”
তবে ভূমি উদ্ধার কমিটির সহ-সভাপতি ফিলিমিন বাস্কে বলেন, “ওই ভিডিও চিত্রে স্পষ্ট দেখা যায়, পুলিশ আমাদের ঘরে আগুন দিচ্ছে। ঘটনাটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই।”
গাইবান্ধার পুলিশ সুপার মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, “ভিডিও চিত্রের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”