Published : 01 May 2025, 05:23 PM
মৌলভীবাজার জেলার সাত উপজেলায় ৯৩টি চা বাগানে প্রায় নব্বই হাজার শ্রমিক কাজ করেন। চা বাগান প্রতিষ্ঠার প্রায় পৌনে দুইশ বছর তো বটেই দেশ স্বাধীন হওয়ার দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও এসব চা শ্রমিকদের ঘরে সচ্ছলতা ফেরেনি, হয়নি জীবনমানের তেমন উন্নতি।
প্রতিবছর মে দিবস ঘিরে শ্রম অধিকার নিয়ে নানা আয়োজন হলেও মৌলভীবাজার জেলার চা শ্রমিকদের ভাগ্যের তেমন পরিবর্তন ঘটেনি।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ বুনাজী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১৮৫৪ সালে বাংলাদেশে চা বাগানের যাত্রা শুরু হয়। তার আগে থেকেই ব্রিটিশরা ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে কাজের কথা বলে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠির মানুষকে এই এলাকায় বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসে। এখানে এনে এক প্রকার বন্দি করেই তাদের দিয়ে কাজ করানো হত।”
তার ভাষ্য, “আজকের যে সুন্দর চা বাগান দেখছেন, আগে এই জায়গাটা কেমন ছিল, তা কল্পনা করাও কঠিন। ঘন জঙ্গলে ঢাকা ছিল পুরো এলাকা। বিভিন্ন জীবজন্তুতে ভরপুর ছিল। চিতা বাঘ, বন্যহাতি, ভালুক, বন্য শুকরসহ বিভিন্ন প্রজাতির হিংস্র প্রাণী ছিল এই বনে। ছিল বিষাক্ত সাপ। এসবের সঙ্গে মোকাবেলা করে জঙ্গল কেটে এখানে বাগান সৃজন করা শ্রমিকদের জন্য ছিল বাধ্যতামূলক।”
তিনি বলেন, এরপর থেকে এসব জাতি-গোষ্ঠির নামের পাশে সংযুক্ত হয় এক নতুন পরিচয় ‘চা শ্রমিক’।
শ্রীমঙ্গল হরিণ ছড়া বাগানের ফাঁড়ি বাগান মেকানীছড়ার বাসিন্দা প্রবীণ ব্যক্তি, অবসরপ্রাপ্ত চা শ্রমিক রাম সিং গোঁড় বলেন, তার বাবার আদি ভূমি ছিল ভারতের মধ্য প্রদেশের জবলপুর। চা চাষের জন্য তার বাবা এবং দাদা এই এলাকায় প্রথম আসেন।
তার দাবি, তারই দাদা ও বাবার হাতে প্রথম পুটিয়াছড়া চা বাগান সৃজন হয়। আর তার হাতে সৃজন হয় শ্রীমঙ্গল হরিণছড়া চা বাগানটি।
এখন তিনি নো ম্যান্স ল্যান্ডের কাছে ওই হরিণছড়ার ফাঁড়ি বাগান মেকনীচড়াতে বসবাস করছেন।
রাম সিং বলেন, বাগানে কাজের যে পারিশ্রমিক পেতেন তা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে কোনো রকমে জীবনযাপন করেছেন।
শতাধিক বছর বয়সি অবসরপ্রাপ্ত এই চা শ্রমিক বলেন, সারা জীবন বাগানে কাজ করে অবসরে এসে এখন ওষুধ কিনে খাওয়ার টাকাও তার কাছে নেই।
চা শ্রমিক নেতা পরিমল সিং বারাইক বলেন, চা বাগানে কাজ করতে যারা এখানে এসেছেন, তাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ এলাকায় কিছু না কিছু সহায়-সম্পত্তি ছিল। ওই সময় ব্রিটিশরা এই জনগোষ্ঠীকে বিশাল অর্থের লোভ দেখিয়ে এ এলাকায় নিয়ে আসে। এখনে এনে চাবুকের প্রহারে কাজ করানো হত। বিনিময়ে দেওয়া হত বিশেষ কয়েন। এই কয়েন দিয়ে শুধু বাগানের ভেতরে খরচ করা যেত। বাইরে এই কয়েন ব্যবহারের সুযোগ না থাকায় কেউ আর নিজ এলাকায় ফিরে যেতে পারেননি।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন, বালিশিরা ভ্যালি সভাপতি বিজয় হাজরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের বর্তমান মজুরি দৈনিক মাত্র ১৭৮ টাকা। তা বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবি বহু দিনের। তবে এবারের মে দিবসে ভূমি অধিকারের পাশাপাশি তাদের দাবি, চা বাগান এলাকায় কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন এবং বাগানে শিক্ষিত ছেলে-মেয়েদের চাকরির ব্যবস্থা করা।
একই সংগঠনের সহ সভাপতি পংকজ কন্দ বলেন, বর্তমানে চা বাগানে বেড়েছে জনসংখ্যা। প্রতি ঘরে অন্তত তিন থেকে চারজনের কাজ করার স্ক্ষমতা থাকলেও বাগানে মাত্র একজন করে কাজ করছেন। কোনো কোনো পরিবারের কাজ আবার অস্থায়ী। তাদের দৈনিক বেতন মাত্র ১৭৮ টাকা। শিক্ষা, চিকিৎসা ও স্যানিটেশনও অপ্রতুল।
তিনি বলেন, এক জমিতে প্রায় দুইশ বছর বংশ পরম্পরায় বসবাস করে এলেও চা শ্রমিকরা এখনো জমির মালিক হতে পারেননি।
চা শ্রমিক উষার প্রশ্ন, আর কত বছর বসবাস করলে জমির মালিক হতে পারবেন তারা?
শ্রী গোবিন্দপুর চা বাগানের মালিক ও ন্যাশনাল টি কোম্পানির পরিচালক মহসিন মিয়া মধু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি বাগান মালিকরাও কাজ করছেন।
তিনি বলেন, তারা চা শ্রমিকদের ‘প্রায় ফ্রি’ চাল ও আটা দেন। চা বাগানে যে গ্যাস ও বিদ্যুৎ ব্যবহার হয় তার জন্য বাণিজ্যিক হারে বিল দিতে হয়।
তার দাবি, সার থেকে শুরু করে যন্ত্রাংশ সব কিছুর দাম ক্রমশ বাড়লেও চায়ের দাম বাড়েনি। এখন উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি। এতে অনেক বাগান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অনেক মালিক বাগান বিক্রি করে দিচ্ছেন।
এ অবস্থায় সরকারের সহযোগিতা চেয়ে তিনি বলেন, “সহযোগিতা পেলে শ্রমিকদের আরো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যাবে।”