সন্তানকে ভালো স্কুলে দিতে প্রতারণায় অভিভাবক

বরিশালে পাঁচটি সরকারি স্কুলে ১৫১ শিশুর ভর্তি বাতিল করা হয়েছে।

সাইদ মেমনবরিশাল প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Jan 2023, 02:17 PM
Updated : 3 Jan 2023, 02:17 PM

অভিভাবকরা প্রতারণার আশ্রয় নেওয়ায় বরিশালের ১৫১ শিশু অন্যদের বঞ্চিত করে সরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিল; যাচাই-বাছাইয়ের পর তাদের ভর্তি বাতিল করেছে কর্তৃপক্ষ।

বরিশালের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মনদীপ ঘরাই মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, নগরীর পাঁচটি সরকারি বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তির ক্ষেত্রে নিয়ম ভেঙে একাধিক আবেদন জমা পড়েছিল। তথ্যে গড়মিলের কারণে এসব শিশুর ভর্তি বাতিল হয়েছে।

এর মধ্যে বরিশাল সরকারি জিলা স্কুলে ৫২ জন, বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৫৯ জন, সরকারি বরিশাল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ১৫ জন, সরকারি শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১৯ জন ও সরকারি শহীদ আরজু মনি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছয় জন শিশুর আবেদন গেছে বাতিলের খাতায়। 

সারা দেশে কোনো ধরনের পরীক্ষা ছাড়া লটারির মাধ্যমে শিশুদের সরকারি-বেসরকারি স্কুলগুলোতে ভর্তির নিয়ম করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নিয়ম অনুযায়ী, এক শিক্ষাবর্ষে একজন শিশু একটিই আবেদন করতে পারে।

কিন্তু অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের ভালো স্কুলে ভর্তির মরিয়া চেষ্টায় প্রতারণার আশ্রয় নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তারা সন্তানের নামে একাধিক জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরি করে, কিংবা এক শিশুর জন্য একাধিক নাম ব্যবহার করে কয়েকটি আবেদন করেন। তারা মনে করেন, অনেকগুলো আবেদন হলে লটারিতে তাদের সন্তানের হয়ত সুযোগ বাড়বে।

এবার স্কুলে ভর্তির আবেদন প্রক্রিয়া চলে ২৫ নভেম্বর থেকে ৮ ডিসেম্বর। লটারির ফল প্রকাশিত হয় ১২ ডিসেম্বর। লটারিতে আসা নামের তালিকার পাশাপাশি অপেক্ষমাণ তালিকাও দেওয়া হয়।

তারপর ১৭ ডিসেম্বর শুরু হয় ভর্তির প্রক্রিয়া। ১৯ ডিসেম্বর স্কুল কর্তৃপক্ষ জানায়, যারা ভুল তথ্য ও মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে আবেদন করেছে, তা বাতিল করা হবে।

শিক্ষার্থীদের নাম, আবেদনপত্র, জন্মনিবন্ধন সনদসহ সংশ্লিষ্ট তথ্য যাচাই-বাছাই করতে গিয়েই বেরিয়ে আসে সন্তানদের ভর্তির জন্য তাদের বাবা-মায়েদের প্রতারণার বিষয়টি।

শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে এবার তৃতীয় শ্রেণিতে দুটি শাখায় মোট ২৪০ জন শিশু ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে ৫৯টি শিশুর ভর্তির ক্ষেত্রে অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে। অর্থাৎ লটারিতে ওই ক্লাসে ভর্তির সুযোগ পাওয়া প্রায় ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থীদের অভিভাবক প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। সরকারি জেলা স্কুলে এ হার আরও বেশি।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মনদীপ ঘরাই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভর্তি কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোনো শিক্ষার্থী একাধিক আবেদন করতে পারবে না। কিন্তু সেই নিয়ম উপেক্ষা করে অভিভাবকরা একের অধিক জন্মনিবন্ধন তৈরি করে একাধিক নাম ব্যবহার করে একাধিক আবেদন করেছে। সেই আবেদনে দেওয়া তথ্যে গরমিল ছিল।

“যাচাই-বাছাইকালে বিষয়টির প্রমাণ পেয়ে শতাধিক শিক্ষার্থীর ভর্তি বাতিল করা হয়েছে। এটি প্রাথমিক হিসাব। এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত হিসাব জানা সম্ভব হয়নি। আরও যাচাই-বাছাই চলছে।”

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক জানান, বাতিল হওয়া শিক্ষার্থীদের স্থান অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে পূরণ করা হবে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মাহাবুবা হোসেন বলেন, “প্রথম ধাপে দুইদিন যাচাই-বাছাই করে দুই শিফটে ৫৯ জন শিক্ষার্থীর ভর্তি বাতিল করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রভাতী শাখায় ২৮ ও দিবা শাখায় ৩১ জন রয়েছে।

“লটারির মাধ্যমে সুযোগ পাওয়া ২৪০ জনের ভর্তি শেষ করা হয়। তবে ভর্তির আগে প্রত্যয়নপত্রে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, যাচাই-বাছাইয়ে কোনো ধরনের অসত্য তথ্য ধরা পড়লে ভর্তি বাতিল বলে গণ্য হবে।”

বাতিল হওয়া শিক্ষার্থীদের বিষয়ে তিনি বলেন, “এর দায়-দায়িত্ব অবশ্যই তাদের অভিভাবকদেরই নিতে হবে। তাদের সন্তানকে তারা কোথায় পড়াবেন তা তারা বুঝবেন। কারণ তারা প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। তারা যা করেছেন তা অপরাধের সামিল।”

এ ধরনের প্রতারণার কারণে অনেক শিশুই ভালো স্কুলে ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় বলে অভিযোগ করেন নগরীর কাউনিয়া এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান মিজান। তার ছেলে এবার তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তির জন্য চারটি স্কুলের আবেদন করেছিল। কিন্তু লটারিতে টেকেনি।

মিজানুর রহমান বলেন, “ভর্তি হতে না পেরে ছেলের মন খারাপ হয়েছে। এখন স্কুল কর্তৃপক্ষ যেটা করছে সেটা ভর্তির আগে করলে হয়ত আমার ছেলে সুযোগ পেতে পারত। এখন যে বাচ্চাগুলো ভর্তি হয়েছে, তাদের ভর্তি বাতিল হলে তাদের মনের ওপর চাপ পড়বে, বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে।”

এই অভিভাবক বলেন, “এমন সফটওয়ারের মাধ্যমে ভর্তিটি করা উচিত যাতে কেউ একাধিক জন্মনিবন্ধন ব্যবহার করে একাধিক আবেদন করতে না পারে। এতে সবাই বিড়ম্বনা থেকে রেহাই পাবে।”

তবে এক্ষেত্রে শুধু অভিভাবকদের দোষ দেখছেন না বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতির বরিশাল বিভাগীয় আহ্বায়ক অধ্যাপক মহসিন উল ইসলাম হাবুল।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “কেউ সুযোগ দিলে, সেটা নেওয়ার তো কেউ চেষ্টা করবেই। হয়ত ভুল নাম দিয়ে ভর্তি হয়েছে, পরে সংশোধন করে নেবে।”

অধ্যাপক মহসিন বলেন, “প্রতি বছর ভর্তির সময় একটা তাণ্ডব হয়। কখনও নম্বরে, কখনও তদ্বিরে, আবার কখনও কোচিং সেন্টারের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে নেবে। এ ধরনের ঘটনা বরিশাল জিলা স্কুল, সরকারি বালিকা বিদ্যালয়, আরজু মনি, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত সবাই করেছে। মেধাবী শিক্ষার্থীদের বাদ দিয়ে তদ্বির ও বাণিজ্যের মাধ্যমে স্কুলগুলোতে ভর্তির ইতিহাস রয়েছে।”

যারা ভর্তি হয়েছে তাদের ভর্তি বাতিল না করে বহাল রাখার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “অভিভাবকদের ভুলের কারণে তো শিশু-সন্তানদের ক্ষতি করা যাবে না। ভর্তি বাতিল করায় শিশুরা যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার দায় কে নেবে? তাই কোনোভাবেই ভর্তি বাতিল গ্রহণযোগ্য নয়।

“এমন পদ্ধতি বের করা উচিত যাতে মেধারীরা সুযোগ পাবে। অন্যরা বাদ পড়বে। যেখানে কোনো প্রশ্নের সুযোগ থাকবে না।”

তবে তার সাথে একমত নন বরিশাল জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “আমাদের ভুল কোথায়? অভিভাবকরা অনলাইনে আবেদন করেছে, লটারির মাধ্যমে বাছাই করে তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। তারা ভর্তি করেছেন। যখন একাধিক জন্ম নিবন্ধন ও ভুল নামের অভিযোগ আসে, তখন যাচাই-বাছাই করা হয়। এতে এখন পর্যন্ত ৫২ জন পাওয়া গেছে। অন্তত ৬০ জনের মতো হবে।”

শিক্ষার্থীদের ভর্তি বাতিল হওয়া এবং শূন্য আসন নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা পাননি বলে জানান বরিশাল জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক।