গত এক সপ্তাহে দুই দিন দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে নওগাঁয়।
Published : 13 Dec 2024, 12:57 PM
দেশের উত্তরের জেলা নওগাঁয় কয়েকদিন ধরে তাপমাত্রা ৯ থেকে ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরে উঠানামা করছে। এতে কনকনে শীতে জনজীবনে ভোগান্তি বেড়েছে।
তীব্র শীতের প্রভাব পড়েছে রবি ফসলের মাঠে- ধানের বীজতলায়। পাশাপাশি ঘন কুয়াশায় বিপদজনক হয়ে উঠেছে সড়ক, বেড়েছে দুর্ঘটনা।
ভোর থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত এবং সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাতও ঘন কুয়াশায় ঢেকে থাকছে জেলার জনপদ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশা কমলেও আকাশে হালকা মেঘ থাকার কারণে সূর্যের দেখা মিলছে না। দুপুরে তাপমাত্রা কিছু বাড়লেও বিকালের দিকে আবারও শীত অনুভূত হতে শুরু করে।
তীব্র ঠান্ডায় রাস্তা-ঘাটে মানুষের আনাগোনাও কমেছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ বের হচ্ছেন না। এতে বেশি বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ।
বদলগাছী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের উচ্চ পর্যবেক্ষক মিজানুর রহমান বলেন, শুক্রবার সকালে জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১০ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
তিনি জানান, গত এক সপ্তাহে জেলার তাপমাত্রা উঠানামা করছে ৯ থেকে ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরে। এর মধ্যে দুই দিন দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। শনিবার মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
তিনি বলেন, “ঘন কুয়াশার সঙ্গে উত্তরের হিমেল বাতাস প্রবাহিত হওয়ায় তাপমাত্রা নিম্নমুখী হতে শুরু করেছে। তাপমাত্রার ব্যবধান কমে যাওয়ায় তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে এখানে। “
এদিকে ঘন কুয়াশায় দিনের বেলায়ও যানবাহনকে লাইট জ্বালিয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে। জেলার সড়কে দুর্ঘটনার হারও বেড়েছে।
এর মধ্যে মান্দা উপজেলায় গত সোমবার নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কে বাস-প্রাইভেট কার সংঘর্ষে দুইজন, পরদিন মঙ্গলবার দেলুয়াবাড়ী-চৌবাড়ীয়াহাট আঞ্চলিক সড়কে ট্রাক-মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে তিন জন প্রাণ হারিয়েছেন।
বুধবার সকালে পোরশা উপজেলায় বাস উল্টে এক নারী, রাণীনগরে ভটভটি উল্টে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে।
এর আগে ৩ ডিসেম্বর ভোরে মহাদেবপুর উপজেলায় ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে প্রাণ হারিয়েছেন পড়ে চালক ও সহকারী।
এ পরিস্থিতিতে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানালেন জেলা প্রশাসক আব্দুল আউয়াল।
তিনি বলেন, সাতদিন ধরে ঘন কুয়াশার কারণে জেলার জনজীবনে দুর্ভোগের পাশাপাশি সড়কে দুর্ঘটনাও বেড়েছে। তা কমাতে এর মধ্যেই সতর্কতামূলক মাইকিং করা হয়েছে, বিভিন্নভাবে প্রচার চালানো হচ্ছে। এছাড়া ট্রাফিক বিভাগের মাধ্যমে চালকদের সচেতন করতেও বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এদিকে চরম শীত কষ্টে পড়েছেন কৃষি শ্রমিক ও রিকশা ভ্যান চালকসহ জেলার খেটে খাওয়া দিনমজুররা। তীব্র শীতে তাদের ঘর থেকে বের হওয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে। শীতবস্ত্রের অভাবে দারুণ কষ্টে আছেন দরিদ্র ছিন্নমূল মানুষজন।
নওগাঁ শহরের রিকশাচালক মোসলেম উদ্দিন বলেন, “গত কয়েকদিন ধরে নওগাঁয় খুবই শীত। সকালে ঘন কুয়াশার কারণে ঘর থেকে বের হতে খুব কষ্ট হয়। ১০ হাত দূরে কি আছে দেখা যায় না।”
শহরতলীর রামভদ্রপুর গ্রামের ব্যাটারিচালিত রিকশার চালক টুকু মিয়া বলেন, “অনেক বেলা পর্যন্ত ঘন কুয়াশায় সব কিছু ঢেকে থাকছে। দিনের বেলাতেও লাইট জ্বালিয়ে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। কনকনে শীতে লোকজন ঘরের বাইরে খুব কম আসায় আয় অর্ধেকে নেমেছে।”
এদিকে শীতের প্রভাব পড়েছে ফসলের ক্ষেতেও। কনকনে ঠাণ্ডায় ব্যাহত হচ্ছে চলতি মৌসুমের আলু, সরিষা, পেঁয়াজ, গমসহ বিভিন্ন শাকসবজির চাষাবাদ।
ঘন কুয়াশার প্রভাব পড়েছে চলতি মৌসুমের ইরি-বোরো বীজতলাতে। বীজতলার চারা গাছ লালবর্ণ ধারণসহ মরে যেতে শুরু করেছে।
তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে বিলম্বিত হচ্ছে চলতি মৌসুমের রোপা আমনের কাটা-মাড়াইও।
আত্রাইয়ের কৃষক মোস্তাক আহমেদ বলেন, “ঘন কুয়াশার কারণে রোপা আমনের কাটা-মাড়াই অনেকটা ধীর গতিতে চলছে। তীব্র শীতের কারণে শ্রমিকরা মাঠে নামতে চান না। এছাড়া ঘনকুয়াশা ও রৌদ্র না থাকায় জমিতে কেটে রাখা ধান শুকাতেও বিলম্ব হচ্ছে।”
বদলগাছী সদরের কৃষক ফেরদৌস হোসেন বলেন, “কয়েকদিন ধরে ঘন কুয়াশা ও মৃদু শৈত্য প্রবাহের ফলে ক্ষতির মুখে পড়েছে ইরি-বোরো বীজতলা। বীজতলার চারা গাছের আগা মরে গিয়ে লাল হয়ে যাচ্ছে। পাতা মরে গিয়ে ক্ষতি হচ্ছে চলতি মৌসুমের আলু, সরিষা, পেঁয়াজসহ অন্যান্য ফসলের।”
এ অবস্থায় ফসল রক্ষায় আলু, সরিষা, পেঁয়াজসহ রবি শস্য রক্ষায় ছত্রাকনাশক স্প্রে করা এবং ইরি-বোরো বীজতলা ঘন কুয়াশার জন্য পলিথিনে মুড়িয়ে রাখাসহ বীজতলা পানি দিয়ে ডুবিয়ে রাখার পরামর্শ দেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, নওগাঁর উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, জেলায় ১ লাখ ৯৩ হাজার হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো চাষের জন্য ১০ হাজার হেক্টর জমিতে ইরি-বোরোর বীজতলা এবং আলু, সরিষা, পেঁয়াজ, গম, ভূট্টা ১ লাখ ১১ হাজার হেক্টর জমিতে রবিশস্য চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৯০ ভাগ রবিশস্যের রোপণ সম্পন্ন হয়েছে।
এদিকে জেলার ৯৯ ইউনিয়ন ও ৩ পৌরসভার দরিদ্র শীতার্ত মানুষের জন্য ১ লাখ শীতবস্ত্র চেয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। শীতবস্ত্র পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা বিতরণ করা হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক আব্দুল আউয়াল।
তবে এখন পর্যন্ত চাহিদা মোতাবেক সরকারি শীতবস্ত্র না আসলেও জেলার ১১ উপজেলায় ৩ লাখ করে ৩৩ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
নওগাঁ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার রবীন শীষ জানান, ৩ লাখ টাকায় শীতবস্ত্র ক্রয় করে বৃহস্পতিবার থেকে শীতার্ত মানুষদের মাঝে বিতরণ শুরু হয়েছে।