লেডিস প্যাভিলিয়নের ভূত ও ক্রিকেটের স্বপ্ন রাজ্য

ক্রিকেটের সবচেয়ে অভিজাত ও পুরনো ক্রিকেট মাঠগুলির একটি সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের গল্প।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Oct 2022, 05:37 PM
Updated : 26 Oct 2022, 05:37 PM

সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের সবচেয়ে আইকনিক স্থাপনা মেম্বার্স প্যাভিলিয়ন। এই প্যাভিলিয়নের ওপর বিশালাকার ঘড়ি, ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড আর লাল দেয়াল ও সবুজ ছাদের গ্যালারি দেখলে ক্রিকেট অনুসারী মাত্রই বুঝে যান, এটি কোন মাঠ। মেম্বার্স প্যাভিলিয়নের ঠিক পাশেই লেডিস প্যাভিলিয়ন। যেখানে থাকে এক মা-ভূত, এই মাঠে যে খেলা দেখে থাকে নিয়মিত!

গল্পটি এরকম, ওই মহিলার ছেলেটি ছিল ক্রিকেট পাগল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেই ছেলে মারা যায়। স্বামীহারা সেই মহিলা সন্তানকেও হারিয়ে শোকে দিশাহারা হয়ে পড়েন। প্রায়ই তিনি লেডিস প্যাভিলিয়নে বসে খেলা দেখতেন আর ক্রিকেটপ্রিয় ছেলেকে খুঁজতেন নানা জনের মাঝে। একসময় তারও মৃত্যু হয় এবং সেই লেডিস প্যাভিলিয়নেই রয়ে যায় তার আত্মা।

নিরাপত্তাকর্মীরা এখানে ২৪ ঘণ্টাই থাকেন। তাদের কাছ থেকে এই লেডিস প্যাভিলিয়নের নানা ভুতুড়ে ঘটনা জানা যায়। কেউ হয়তো বাতি ও দরজা বন্ধ করে গেছেন, ফিরে দেখেন বাতি আবার জ্বলছে, দরজা খোলা। নানারকম শব্দও নাকি শোনা যায়। মাঠ পাহারা দেওয়ার জন্য কুকুর আছে, তারা কোনো কোনো রাতে মাঠের সব জায়গায় গেলেও ওই লেডিস প্যাভিলিয়নে তাদেরকে কোনোভাবেই নেওয়া যায় না।

মাঠের অনেক পুরনো নিরাপত্তাকর্মী যারা, গভীর রাতে অনেক সময়ই লেডিস প্যাভিলিয়নে গিয়ে ওই আত্মার কাছে নিজেদের পরিচয় দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে।

এই কাহিনীগুলো অনেক সময় আসলে খুব অবাস্তব মনে হয় না। যে মাঠের বয়স ১৭৪ বছর, সেখানে এরকম কত গল্পই তো থাকবে!

লেডিস প্যাভিলিয়ন ভুতুড়ে হতে পারে, তবে গোটা ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে অভিজাত, সবচেয়ে নান্দনিক, সবচেয়ে পরিচিত ও সমৃদ্ধ স্টেডিয়ামগুলোর একটি এই সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ড। সেই ১৮৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত মাঠ এটি। একসময় এখানে টেনিস, মোটর রেসিং, রাগবি ইউনিয়ন, রাগবি লিগ, এরকম অনেক খেলা হয়েছে। এখন ক্রিকেটের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ান রুলস ফুটবলও হয়।

তবে এই মাঠের অস্তিত্ব বা পরিচয়, সবই মূলত ক্রিকেট। অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় সবচেয়ে পুরনো টেস্ট মাঠ এটি। এখানে প্রথম টেস্ট হয়েছিল ১৮৮২ সালে। এখনও পর্যন্ত ইতিহাসের তৃতীয় সর্বোচ্চ ১১০ টেস্ট ও তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৫৯ ওয়ানডে হয়েছে এখানে।

এই মাঠেই স্যার ডন ব্র্যাডম্যান খেলেছেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৪৫২ রানের অসাধারণ সেই ইনিংস। এখানেই অভিষেক টেস্টে ২৮৭ রানের অবিশ্বাস্য ইনিংস খেলেছেন টিপ ফস্টার। প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিতে ২৭৭ রান করার পর ব্রায়ান লারা তার প্রথম সন্তানের নাম রাখেন ‘সিডনি।’ এই মাঠের ২২ গজেই ৬১৩ মিনিট ব্যাট করে শচিন টেন্ডুলকার খেলেছেন ক্যারিয়ারের দীর্ঘতম ইনিংস। নিজের শততম টেস্টে জোড়া সেঞ্চুরির অনন্য কীর্তি এখানেই গড়েন রিকি পন্টিং। আরও কত জনের কত কত স্মরণীয় পারফরম্যান্স এখানে!

বলাই বাহুল্য, ক্রিকেটের অসংখ্য ইতিহাসের স্বাক্ষী এই মাঠ। পুরো কমপ্লেক্সের পথে পথে, দেয়ালে দেয়ালে, চারপাশে দেখা মেলে সেসব ইতিহাসের টুকরো টুকরো চিহ্ন।

‘এ’ গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে একটু ডানে তাকালেই যেমন চোখে পড়বে রিচি বেনোকে। মেম্বার প্যাভিলিয়নের সিঁড়ির গোরায় অস্ট্রেলিয়ার সাবেক এই অধিনায়ক, জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার ও কিংবদন্তি এই ক্রিকেট ব্যক্তিত্বের ভাস্কর্য। যেখানে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন এক হাতে বল নিয়ে, আরেক হাত বাড়িয়ে।

বেনোকে পাশে রেখে সোজা একটু এগিয়ে গেলেই দেখা হবে স্টিভ ওয়াহর সঙ্গে। এই সিডনিরই সন্তান অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি এই অধিনায়ক ও ব্যাটসম্যান যেন মাত্রই সেঞ্চুরি করলেন। দু হাত উঁচিয়ে উদযাপনের ভাস্কর্য তার।

এরপর নানা ভঙ্গিমায় ভাস্কর্য আছে গ্রেট ব্যাটসম্যান স্ট্যান ম্যাককেব, ‘দা ডেমন’ নামে পরিচিত সাবেক ফাস্ট বোলার ফ্রেড স্পফোর্থের। শুধু ক্রিকেট তারকারই নন, এই মাঠের আঙিনায় নান্দনিক ভাস্কর্যে অমর হয়ে আছেন এই নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের অন্যান্য খেলার তারকারাও। রাগবি লিগ তারকা ড্যালি ম্যাসেঞ্জার, ট্রেভর অ্যালান, রুলস ফুটবলার পল রস, পল কেলি, এমনকি অস্ট্রেলিয়ার গোল্ডেন গার্ল বলে পরিচিত চারটি অলিম্পিক সোনা জয়ী অ্যাথলেট বেটি চুথবার্ট, স্প্রিন্টার মার্লিন ম্যাথিউসের ভাস্কর্যও আছে।

শুধু ভাস্কর্যই নয়, কংক্রিটের ছোট ছোট পিলারের ওপর লেখা আছে নিউ সাউথ ওয়েলসের কীর্তিমান ক্রীড়াবিদদের বীরত্বগাঁথা। নেট অনুশীলনের জায়গাটি থেকে মাঠে ঢোকার একটি ছোট্ট পথের পাশে দেয়ালের নাম ‘ওয়াক অব অনার।’ নিউ সাউথ ওয়েলসের শ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদদের সম্মান জানানোর অনন্য আয়োজন সেখানে। দেয়ালে পিতলের প্লেটে লেখা আছে ওই ক্রীড়াবিদদের অর্জনের গল্প।

মাঠের ভেতরেও দেয়ালে সাঁটানো আছে শত বছরের পুরনো থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ে এই মাঠের স্মরণীয় মুহূর্তের ছবি।

লেডিস প্যাভিলিয়ন ভুতুড়ে হলেও এখানে বসার আগ্রহও অনেকের বেশি। এখান থেকেই যে খেলা সবচেয়ে ভালো দেখা যায়! তবে প্রায় ৪৮ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার এই স্টেডিয়ামের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, মাঠের যে কোনো জায়গা থেকে খেলা দেখা যায় খুব ভালোভাবে।

যে মাঠের চারপাশে ছড়ানো-ছিটানো আছে নানাজনের কীর্তিগাঁথা, সেখানে গ্যালারিগুলোর নাম তো স্পেশাল হবেই। তারকাদের তারকা, সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান বলে বিবেচিত স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের সম্মানে নামকরণ হওয়া স্ট্যান্ড যেমন সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে। পাশেই আরেক সাবেক অধিনায়কের নামে মন্টি নোবল স্ট্যান্ড।

ব্র্যাডম্যানের দলের কিংবদন্তি লেগ স্পিনার বিল ও’রাইলির নামে আছে একটি স্ট্যান্ড। লেগ স্পিনার হলেও ফাস্ট বোলারদের মতোই আগ্রাসী ছিলেন বলে তাকে ডাকা হতো ‘টাইগার’ নামে। এছাড়া আনন্দদায়ী সাবেক ব্যাটসম্যান ভিক্টর ট্রাম্পারের নামে আছে স্ট্যান্ড। শুধু ক্রিকেটাররাই কেন, রাগবি ইউনিয়ন তারকা ড্যালি ম্যাসেঞ্জার, রাগবি লিগ ফুটবলার ক্লাইভ চার্চিলের নাম খোদাই হয়ে আছে দুটি স্ট্যান্ডে।

তবে মাঠজুড়ে সবচেয়ে বেশি উপস্থিতি রিচি বেনোর। তার ভাস্কর্য, নানা ছবি, তাকে নিয়ে লেখা তো আছেই। তাকে সম্মান জানানো হয়েছে আরও নানাভাবে। ধারাভাষ্যকার হিসেবে এতটা জনপ্রিয় ও এমন উচ্চতায় তিনি নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন যে, তার খেলোয়াড়ী সত্ত্বাও অনেক সময় চাপা পড়ে যেত। স্টেডিয়ামের মিডিয়া সেন্টার তাই অবধারিতভাবেই তার নামে।

এই মাঠের আরেকটি অনন্য উদ্ভাবন ‘মিডিয়া হল অব অনার।’ কিংবদন্তি মিডিয়া ব্যক্তিত্বকে সম্মাননা জানানোর উদ্যোগ এটি। যথারীতি বেনো তো আছেনই, সঙ্গে আপাতত জায়গা পেয়েছেন জ্যাক ফিঙ্গলটন, বিল ও’রাইলি, ইয়ান হেডস, রে রবিনসন, রে ওয়ারেনসহ বেশ কজন।

মিডিয়া সেন্টারের নিচে পিজ্জা শপ, বার্গার শপ, কফি শপ, ককটেল বার, এরকম অনেক কিছুই আছে মাঠে আসা দর্শকদের সময়টা আনন্দময় করে তোলার জন্য।

সমৃদ্ধ এক জাদুঘর আছে এখানে। ব্যবস্থা আছে টিকেট কেটে গোটা আঙিনা ঘুরে দেখার। স্টেডিয়ামের কক্ষ থেকে কক্ষে সযতনে সাজিয়ে রাখা সাবেক ক্রিকেটারদের ব্যাট, অধিনায়কদের ব্লেজার, আরও অনেক মহামূল্য ক্রিকেট স্মারক। আলমারি বোঝায় করে রাখা আছে ছাপার অক্ষরে রত্ন, অনেক ক্রিকেট বই। সবমিলিয়ে যে কোনো ক্রিকেটপ্রেমীর স্বর্গরাজ্য যেন।

এসব ভাস্কর্য-স্মারক, সব কিছুর বাইরেও স্রেফ শতাব্দীপ্রাচীন লাল দালানগুলো স্পর্শ করলেও যেন ক্রিকেট রোমাঞ্চের শিহরণ বয়ে যায় শরীরে, দেয়ালগুলোতে কান পাতলে যেভাবে শোনা যায় ইতিহাসের কণ্ঠ।