যুক্তরাষ্ট্রে শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় নুরুল ইসলামকে শেষ বিদায়

যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন সিমেট্রিতে প্রখ্যাত এই অর্থনীতিবিদকে সমাহিত করা হয়েছে।

নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 May 2023, 06:10 AM
Updated : 11 May 2023, 06:10 AM

বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে যুক্তরাষ্ট্রে শেষ শ্রদ্ধায় চিরবিদায় জানিয়েছেন পরিবার ও প্রবাসী বাংলাদেশিরা।

বুধবার জোহরের নামাজ পর পটোম্যাক ইসলামিক কালচারাল সেন্টারে নুরুল ইসলামের জানাজা হয়। ছেলে নাঈম ইসলামসহ পরিবারের অন্য সদস্য ও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা সেসময় উপস্থিত ছিলেন।

জানাজার পর আডেলফির রিগস রোডে জর্জ ওয়াশিংটন সিমেট্রিতে প্রখ্যাত এই অর্থনীতিবিদকে সমাহিত করা হয়। এরপর সবাই তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়ায় অংশ নেন।

ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দিন আহমেদ, জাতিসংঘের উন্নয়ন-গবেষণা টিমের প্রধান নজরুল ইসলাম, বিশ্বব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও লেখক আব্দুন নূর, লেখক বীর মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ আহমেদ, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ওসমান ফারুক, বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা সিদ্দিক, বিএএআই’র সাবেক প্রেসিডেন্ট আবু সোলায়মান, কম্যুনিটি লিডার ওয়াহেদ হোসেনি, মিজানুর রহমান, সোয়েব চৌধুরী, ওয়াশিংটনের ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব আমেরিকার অধ্যাপক আদনান মোর্শেদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ইকবাল বাহার চৌধুরী, মাসুমা খাতুন, ওয়ালি ফাহমি,  মহসিন সিদ্দিকী, হাসান ইমামসহ অনেকে নুরুল ইসলামের জানাজায় অংশ নেন।

পাকিস্তানি আমলে বাঙালি বৈষম্যের চিত্র সামনে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা নুরুল ইসলামকে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম পরিকল্পনা কমিশনে ডেপুটি চেয়ারম্যান করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।

যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করা নুরুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে ওয়াশিংটনে বসবাস করছিলেন। ৯৪ বছর বয়সে সেখানেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সোমবার রাতে তার মৃত্যু হয়।

তিনি স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন। তার মেয়ে রুমিন ইসলাম বিশ্ব ব্যাংকে অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজ করছেন।

নুরুল ইসলামের জন্ম ১৯২৯ সালে চট্টগ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে, তার বাবা ছিলেন একজন সরকারি স্কুলশিক্ষক। বাবার কর্মস্থল বদলের কারণে নুরুল ইসলামের পড়াশোনা শুরু হয় দেরিতে।

আত্মজৈবনিক গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, তিনি কখনও কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়েই যাননি। সরাসরি হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে বাসায় তার পড়াশোনা চলছিল বাবার তত্ত্বাবধানে।

চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আইএ পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর তিনি ১৯৫৫ সালে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি নেন।

পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধু বাঙালির বৈষম্যের অবসানের দাবিতে যে ৬ দফা ঘোষণা করেছিলেন, তাতে নেপথ্যে থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তৎকালীন শিক্ষক নুরুল ইসলাম।

১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গঠনে ভূমিকা রাখেন নুরুল ইসলাম। স্বাধীনতার পরপরই দেশে ফিরে আসেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর তার নেতৃত্বে যে পরিকল্পনা কমিশন গঠিত হয়েছিল, তাতে তার পরের পদ অর্থাৎ ডেপুটি চেয়ারম্যানের পদে ছিলেন নুরুল ইসলাম। ওই কমিটিতে সদস্য ছিলেন অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ আনিসুর রহমান ও রেহমান সোবহান।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকোণ্ডের পর বিরূপ পরিস্থিতিতে বিদেশে পাড়ি জমান নুরুল ইসলাম। এরপর আর স্থায়ীভাবে দেশে ফেরেননি তিনি।

নুরুল ইসলামকে বাংলাদেশের সেরা অর্থনীতিবিদ মানেন অনেকে। পাঁচ বছর আগে ঢাকায় নুরুল ইসলামের আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘অ্যান অডিসি জার্নি অব মাই লাইফ’ এর প্রকাশনা অনুষ্ঠানে রেহমান সোবহান বলেছিলেন, “নুরুল ইসলাম একজন পরিপূর্ণ অর্থনীতিবিদ। আমি মনে করি, বাংলাদেশের অমর্ত্য সেন হতে না পারার কোনো কারণ তার ছিল না।”

অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদও সেই অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “আমি উনাকে দেখি আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত দেশের প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবে।”

নুরুল ইসলামের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৫টির বেশি। তার মধ্যে রয়েছে করাপশন, ইটস কন্ট্রোল অ্যান্ড ড্রাইভারস অব চেঞ্জ, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ : আ প্রাইমার অন পলিটিক্যাল হিস্ট্রি। তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক উন্নয়ন অর্থনীতিতে অবদানের জন্য তিনি ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক পুরস্কার পেয়েছিলেন।

১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ ছাড়ার পর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করেন নুরুল ইসলাম। সর্বশেষ তিনি খাদ্য নীতি বিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ইমিরেটাস ফেলো হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তার আগে বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থায় দীর্ঘদিন কাজ করেন তিনি।

ইয়েল, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি এবং লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিকসেও পড়িয়েছেন তিনি।

নুরুল ইসলামের কর্মজীবনের শুরু পাকিস্তান ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমি। সংস্থার প্রথম বাঙালি পরিচালক ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিআইডিএস গঠিত হলে তার প্রথম চেয়ারম্যানের দায়িত্বও তিনি পালন করেন।

 

আরও পড়ুন-

Also Read: অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলামের জীবনাবসান

Also Read: বৈষম্য কমাতে চাই ‘রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত’ ডেটা: নূরুল ইসলাম