উৎসবের হাসির ফাঁকে লুকিয়ে থাকে দীর্ঘশ্বাস— দেশের মাটির গন্ধ, মায়ের রান্না, বাবার ডাক আর শৈশবের ঈদ ফিরে পাওয়ার আকুলতা।
Published : 31 Mar 2025, 11:48 AM
সীমানা পেরিয়ে, দেশ থেকে দেশান্তরে— ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা দূরদেশের আকাশে চাঁদ দেখেই বয়ে এনেছেন উৎসবের উচ্ছ্বাস, কেউ কর্মব্যস্ত জীবনের ফাঁকে খুঁজে নিয়েছেন একটু আনন্দ, কেউ বা পরিবার-পরিজনের অভাব ভুলে জড়ো হয়েছেন প্রিয়জনদের সঙ্গে।
সকালে রঙিন পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ঈদগাহ ময়দানের দিকে ছুটে চলার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশিদের ঈদ আনন্দ শুরু। ঈদের জামাতের পর চলে কোলাকুলি ও কুশল বিনিময়। তবে উৎসবের হাসির ফাঁকে লুকিয়ে থাকে দীর্ঘশ্বাস— দেশের মাটির গন্ধ, মায়ের রান্না, বাবার ডাক আর শৈশবের ঈদ ফিরে পাওয়ার আকুলতা।
বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসীদের ঈদ উদযাপনের গল্প ইতোমধ্যেই এসে পৌঁছেছে আমাদের কাছে। আরও আসছে নতুন খবর, নতুন আবেগের রঙ—একই উৎসব, ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতা।
ইতালি
ইতালি থেকে আমাদের প্রতিনিধি সাইফুল ইসলাম জানান, ঈদুল ফিতরের আগের সন্ধ্যা থেকেই ‘চাঁদনি রাত’ উৎসবের মধ্যদিয়ে ইতালিতে প্রবাসীদের উৎসব শুরু হয়।
স্থানীয় সময় রোববার সকালে দেশটির রাজধানী রোমের ভাঙ্গা দেয়াল সংলগ্ন পার্কে প্রথম জামাত অনুষ্ঠিত হয়। এতে ইমামতি করেন রোমের টিএমসি কমিউনিটি সেন্টার মসজিদের ইমাম হুমায়ুন রশিদ। পরে পরপর মোট পাঁচটি জামাত অনুষ্ঠিত হয়।
এছাড়া রোমের একাধিক জায়গায় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। এতে দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত এটিএম রকিবুল হককে সেন্ট্রাল মসজিদে ঈদের জামাত আদায় করেন।
মিলানে বায়তুল মোকাররম মসজিদসহ একাধিক স্থানে শতাধিক মুসলমানের অংশগ্রহণে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ কনস্যুলেট কর্মকর্তা সাব্বির আহমেদ দেশ ও প্রবাসের সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা জানান।
এছাড়া দেশটির বন্দর শহর নাপোলি ও ভেনিসসহ ছোটবড় প্রায় পাঁচ শতাধিক স্থানে বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের নাগরিকদের উদ্যোগে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্র
নিউ ইয়র্ক থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানান, রোববার পুরো যুক্তরাষ্ট্রে ৩ হাজারের বেশি জামাতে বাংলাদেশিরা ঈদুল ফিতর উদযাপন করেছেন।
ওইদিন সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় কাউকেই কর্মস্থলে ছুটি নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধ থাকায় মুসলমান-আমেরিকান শিক্ষার্থীরা স্বাচ্ছন্দে ঈদ আনন্দে জড়িয়ে পড়েন।
সবকিছু মিলিয়ে ভিন্ন এক আমেজে এবার ঈদ উদযাপিত হচ্ছে বাংলাদেশি-আমেরিকানদের ঘরে ঘরে। তবে অভিবাসনের মর্যাদা নেই এমন লোকজনের উপস্থিতি দেখা যায়নি অধিকাংশ জামাতে।
নিউ ইয়র্কে প্রধান ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয় জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টার, ব্রুকলিনে বাংলাদেশ মুসলিম সেন্টার, কুইন্সে আল আমিন মসজিদ এবং ওজন পার্কে আল আল আমান মসজিদ ও ব্রঙ্কসে পার্কচেস্টার জামে মসজিদের ব্যবস্থাপনায়।
এছাড়া নিউ জার্সিতে প্যাটারসন, আটলান্টিক সিটি, পেনসিলভেনিয়ায় ফিলাডেলফিয়া, ফ্লোরিডার ফোর্ট মায়ার্স, মায়ামি, ওরল্যান্ডো, ওয়েস্ট পামবিচ, জর্জিয়ার আটলান্টা, ক্যালিফোর্নিয়ার লিটল বাংলাদেশ, আরিজোনার ফিনিক্স, মিশিগানের ডেট্রয়েট, হ্যামট্রমিক, শিকাগো, টেক্সাসের ডালাস ও হিউস্টন এবং ম্যাসেচুসেটসের বস্টন সিটিতে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় প্রায় সবকটি মসজিদের ভেতরেই নামাজ অনুষ্ঠিত হয় একাধিক জামাতে। নারীদের পাশাপাশি শিশু-কিশোর-তরুণ-তরুণীরাও এতে অংশ নেন।
ফ্রান্স
ফ্রান্স থেকে নজমুল হক জানান, ধর্মীয় মর্যাদা আর উৎসব-আনন্দের মধ্য দিয়ে রোববার ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো ফ্রান্সেও ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়েছে। সকালে রোদ্র-উজ্জল আবহাওয়ায় দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
এবারে ঈদ সাপ্তাহিক ছুটি দিন হওয়ায় ঈদ জামাতে ভিড় দেখা গেছে। সকাল থেকেই তারা দলে দলে আসতে থাকেন বাংলাদেশ কমিউনিটির মসজিদগুলোতে। নামাজ শেষে একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করে কুশল বিনিময় করেন।
প্যারিসে ঈদের প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ কমিউনিটি মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টারে। সেখানে পরপর পাঁচটি জামাত হয়। মসজিদ পরিদর্শন করেন স্থানীয় সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আইজুদ্দিন তাইবি ও সহকারী মেয়র আব্দুল হক।
বাংলাদেশিদের পরিচালিত অভারভিলা বাংলাদেশ জামে মসজিদে সকাল থেকে দুপুর বারটা পর্যন্ত একাধিক জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়। একই এলাকায় আন্দে কারমান স্টেডিয়ামে একটি বড় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া প্যারিসের বিভিন্ন পার্কে ঈদ উপলক্ষ্যে নানা উৎসবের আয়োজন করেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
'
কুয়েত
কুয়েত থেকে আ হ জুবেদ জানান, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের মতো প্রায় ৩ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশির কর্মস্থল কুয়েতে ঈদুল ফিতরের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
রোববার সকালে বাংলাদেশি অধ্যুষিত হাসাবিয়া এলাকার বড় মসজিদ প্রাঙ্গণসহ দেশটির অন্যান্য মসজিদ ও খোলা মাঠে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশটির আওকাফের পরিচালনায় ও বাংলাদেশিদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্রায় ২০টি মসজিদে ঈদের নামাজ শেষে বাংলা খুতবা পাঠ করা হয়।
ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে কুয়েতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সৈয়দ তারেক হোসেনের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় ও মধ্যাহ্নভোজে যোগ দেন প্রবাসীরা।
পর্তুগাল
পর্তুগাল থেকে শাহ মুহাম্মদ তানভীর জানান, দেশটির রাজধানী লিসবন, ওডিভিলাস, কাসকাইস, দামাইয়া, বাণিজ্যিক বন্দর নগরী পোর্তো, পর্যটন নগরী আলগার্ভ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শহর কোইমব্রা্য ও কৃষিপ্রধান শহর ওডিমিরায়সহ সারা দেশের মুসলমানরা ঈদুল ফিতর উদযাপন করেছেন।
বাংলাদেশি অধ্যুষিত লিসবনের মাতৃ মনিজ পার্কের মাঠে দেশটির সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়, এতে অংশ নেন প্রায় ১০ হাজার মুসলমান। লিসবন বায়তুল মোকারম মসজিদের খতিব আবু সায়িদ জামাত পরিচালনা করেন, নামাজের আগে ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করেন আলাউদ্দিন।
এছাড়া বন্দর নগরী ও বাণিজ্যিক শহর পোর্তোর বাঙালি অধ্যুষিত রুয়া দে লউরেইরোর হযরত হামজা মসজিদে ঈদের দুটি জামাত অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশিদের পাশাপাশি ভারত ও পাকিস্তানসহ মধ্য এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের মুসলমানরা অংশ নেন।
বাহরাইন
বাহরাইন থেকে সুকান্ত দেব জানান, রোববার সকালে দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশিরা ঈদের নামাজ পড়েন হামাদ টাউন হামেলা জামে ইউসুফ সামি আল জায়ান মসজিদে। এতে ইমামতি করেন আল-আমিন বিন ইলিয়াছ।
এসময় ঈদের শুভেচ্ছা জানান মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা শায়েখ ইউসুফ সামি আল জিয়ানি। নামাজ শেষে সবার সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধি কামনা করে দোয়া ও মোনাজাত করা হয়।
সংযুক্ত আরব আমিরাত
রাজধানী আবুধাবি থেকে মাহাফুজুল হক চৌধুরী জানান, রোববার আবুধাবিতে অবস্থিত শেখ জায়েদ মসজিদে ঈদের নামাজের সবচেয়ে বড় সমাগম হয়।
আমিরাতের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে এদেশের সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা ও শেখরা এই মসজিদে নামাজ পড়েন। তবে নিরাপত্তা সংক্রান্ত কারণে মসজিদের ভেতর প্রবেশ করতে অনেক সময় লেগে যায়। রাত তিনটা থেকেই অনেকে মসজিদে আসা শুরু করেন।
ঈদগাহ ময়দানের দিকে ছুটে চলা, ঈদের জামাতে অংশ নেওয়া, কোলাকুলি ও কুশল বিনিময়ের মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রবাসী বাংলাদেশিদের ঈদ উৎসব উদযাপন।