অনেক অ্যাডভেঞ্চার-প্রেমী আবার সাইকেল চালিয়েও উঠে যায়। সুমন ভাই অবশ্য বাসে বসে তাদের দেখে বলছিল আমরাও এভাবে আসতে পারতাম, কিন্তু মুস্তাফিজ ভাইয়ের ছিল চরম আপত্তি। থাকাটাই স্বাভাবিক, কারণ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এত উপরে সাইকেল চালিয়ে ওঠা চারটিখানি কথা নয়। আমি অবশ্য দুজনের মাঝে বসে উনাদের বাকবিতণ্ডার মজা নিচ্ছিলাম।
তবে সুমন ভাইয়ের প্রস্তাব অসম্ভব বলে মনে হয়নি, যাদের উঠতে দেখছিলাম ওরা পারলে আমরা কেন পারবো না? এই ফাঁকে অর্থী আপু ফুজিইয়োশিদার আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখে নিচ্ছিল। আবহাওয়ার পূর্বাভাস একটু পর পর দেখে নিতে হচ্ছিল, কারণ মাউন্ট ফুজির আশপাশে আবহাওয়া খুব খামখেয়েলি। এই রোদ তো এই বৃষ্টি! আবার এই কোত্থেকে একরাশ মেঘ এসে ঘিরে ধরে ভিজিয়ে দিয়ে চলে যায় তা বোঝা বড় মুশকিল। এসব দেখতে দেখতে বাস আমাদের নিয়ে যখন পঞ্চম স্টেশনে গিয়ে থামে তখন ঘড়িতে সময় সকাল এগারোটা বেজে নয় মিনিট।
এদিকে সুমন ভাই লাল কাপড়ে মোড়ানো লাঠি কিনবে না নীল কাপড়ে, তাই নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গেছিল। অতঃপর একাধারে তার সহধর্মিণী ও ল্যাবমেট অর্থী আপুর সঙ্গে মিলিয়ে লাল কাপড়ে মোড়ানো লাঠিই কিনেছিলেন। এরপর বাইরে এসে চটপট কিছু ছবি তুলে মূল ফুজি অরোহন যখন শুরু করি তখন বেলা ১২টা বেজে ১৪ মিনিট। আমাদের শরীরের তাপমাত্রা মেপে, করোনাভাইরাস সম্পর্কিত প্রশ্নত্তোর পর্ব শেষে প্রত্যেকের ব্যাগে কর্তৃপক্ষ একটি করে জিপিএস ট্র্যাকার লাগিয়ে দিল, যেন কোন দুর্ঘটনা হলে সহজেই উদ্ধার করা যেতে পারে।
শুরু হয়ে গেলো আমাদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার যাত্রা। আমরা যাচ্ছি এক অদেখা স্বর্গ দেখতে। ভাবতেই অবাক লাগছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে আমরা সত্যিই এটা করছি! এত কাছ থেকে মাউন্ট ফুজির বিশালতাকে কখনো-না-দেখা আমরা সবাই তখন একটা কথাই ভাবছিলাম, এখন যদি ফুজি সান রেগে গিয়ে অগ্ন্যৎপাত ঘটায় তাহলে আমাদের কী হবে? এসব ভাবতে ভাবতে আমরা যতই উপরে উঠতে থাকি মাউন্ট ফুজিকে ঘিরে থাকা ছোট-বড় পর্বতমালা যেন ততই ছোট হতে থাকে। দূরে পাহাড়ের গায়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা সবুজ গাছপালাগুলোও কেমন কালচে সবুজ হতে শুরু করলো। আমাদের মত অনভিজ্ঞ পর্বত আরোহীদের জন্য পাহাড় বেয়ে উপরে ওঠা মোটেও সহজ ছিল না। কিন্তু আমরা নানা গল্প-গুজব আর হাসি-ঠাট্টায় একটু পরপর বিশ্রাম নিয়ে বেশ ভালই এগোচ্ছিলাম। এই বিশ্রাম নেওয়াকে মুস্তাফিজ ভাই নাম দিয়েছিলেন ‘ভিউ দেখা’। তাই আমাদের যখনই ক্লান্ত লেগেছে তখনই থেমে দুই চোখ মেলে দূর দিগন্তে চেয়ে থেকেছি আর মুহূর্তগুলো যান্ত্রিক চোখ দিয়ে ডিজিটাল ফ্রেমে বন্দি করে রেখেছি, যেন বুড়ো বয়সে দেখে ক্ষণিকের সুখ অনুভব করতে পারি।
বৃষ্টি থেকে বাঁচতে আর ক্ষুধা নিবারণ করতে আমরা এমনই একটা কুঁড়েঘরে আশ্রয় নিলাম। আর হ্যাঁ এসব কুঁড়েঘর থেকেই আমাদের ওই আরোহন লাঠিতে স্ট্যাম্প নিতে হবে। বৃষ্টিতে আমরা একটু শীত শীত অনুভব করছিলাম, তাই আমি গরম রামেন খেতে চাইছিলাম। কিন্তু সামনে বসে একদল পর্বতারোহীদের ‘ওদেন’ খেতে দেখে অর্থী আপু আমাদের ওদেন খেতে সুপারিশ করলেন। ‘ওদেন’ হল এক প্রকারের সুস্বাদু ও পুষ্টিকর জাপানি খাবার যা সাধারণত মুলা, গাজর, আলু, মাছের পিঠা আর ডিমকে সয়াসস মেশানো গরম জলে ফুটিয়ে দিয়ে তৈরি করা হয়। তবে অঞ্চলভেদে উপকরণ ভিন্ন হতে পারে। জাপানিরা সাধারণত শীতকালে গরম গরম ওদেন খেয়ে থাকে। অর্থী আপুর কথা মত আমরা ওদেন অর্ডার করলাম। বাহিরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে আর আমরা পাহাড়ি কুঁড়েঘরে বসে গরম গরম ওদেন খাচ্ছি। মনে হচ্ছিল আমরা পৃথিবীর বাইরে কোন এক জগতে আছি। পৃথিবীতে ফিরে গেলে হয়তো এই সুখ না-ও থাকতে পারে।
আমাদের পেট-পুজো করে বিশ্রাম নেওয়া শেষ হলে অষ্টম স্টেশনের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। ততক্ষণে বৃষ্টিও থেমে গেছে। ইউটিউব থেকে মাউন্ট ফুজি আরোহনের কিছু ভিডিও দেখে জেনেছিলাম সপ্তম থেকে অষ্টম স্টেশনে যাওয়ার রাস্তা তুলনামূলক কঠিন এবং আমাদের মত অনভিজ্ঞ অপেশাদার পর্বতারোহীদের জন্য তা বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। ভয় যে একদমই লাগছিল না তা বললে মিথ্যা বলা হবে। তবে সাহস ছিল আমরা পারবো।
সেখানে গিয়ে অবশ্য ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমাদের আর দেখা হয়নি। এখন লিখতে বসে মনে হচ্ছে ঈশ্বর হয়তো সেদিন উনাকে আমাদের মনে সাহস যোগাতে পাঠিয়েছিলেন। তিনি মানুষ হোক অথবা কোন দূত; আমাদের মানসিক সাহসে জ্বলন্ত বারুদ ঠুসে দিয়ে জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছানোর উদ্যম ও উৎসাহ দিয়েছিলেন।
চলবে…
লেখক: পিএইচডি শিক্ষার্থী, চিবা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান
আগের পর্ব
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |