করোনাভাইরাস: ইতালিতে গৃহবন্দি প্রবাসীর ডায়েরি, পর্ব ৪

আমাদের বন্দি জীবনের চতুর্থ সপ্তাহ চলছে। এ সপ্তাহ থেকে যেন অ্যাম্বুলেন্সের আসা যাওয়াটা একটু বেশি শুনছি। অনেক দূর থেকে অ্যাম্বুলেন্সের শব্দটা আস্তে আস্তে যেন কাছে আসতে থাকে, মনে হয় প্রকট শব্দটা আমাকে ভেদ করে চলে যাবে।

ফাতেমা আখতার মিতু, ইতালি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 March 2020, 05:04 AM
Updated : 24 March 2020, 05:27 AM

একটা সময় সেই শব্দটা মিলিয়ে যায়। বুকটা কেঁপে উঠে হাসপাতালে জীবনের সঙ্গে লড়তে থাকা সেইসব মানুষগুলোর কথা মনে করে। প্রতিদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থাকি একটু ভালো সংবাদ পাবার আসায়, কিন্তু পাই না। এই ভাবি, আজ বোধ হয় নতুন রোগীর সংখ্যা কম দেখবো, কিংবা মৃতের সংখ্যা কম শুনবো।

কই, আশানুরূপ কিছু কি শুনছি বা দেখছি? হাসপাতালের ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিট থেকে শুরু করে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড, ওয়েটিং রুম এমনকি অন্যান্য ইউনিটকেও সাব ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিট বানিয়ে ফেলেছে। তারপরও রোগী রাখার জায়গা হচ্ছে না।  প্রতিদিন শত শত রোগী ভর্তি হচ্ছে একেকটা হাসপাতালে।

মিলানের দক্ষিণের শহর ক্রেমোনা। ক্রেমোনা হাসপাতালের একটা প্রতিবেদন দেখছিলাম সেদিন। ফ্রন্টলাইনের প্রতিটা মেডিক্যাল প্রফেশনাল দিনরাত কষ্ট করে যাচ্ছে ভালো কিছু দেখবে, অপেক্ষায় থাকছে কখন রোগীর ভেন্টলেশান খুলে দিয়ে স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে দেখবে এই আশায়। কিন্তু না, প্রতিদিন চোখের সামনে এতো এতো মৃত্যু তাদেরকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দিচ্ছে। একজন ডাক্তার বলছিলেন তার চল্লিশ বছরের পেশা জীবনে তিনি এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি কখনো পড়েননি।

একটা তথ্য খুব অবাক করলো আমাকে। চীনের সিচুয়ান প্রদেশের হেলথ কমিশনার সেইন চি বলেন, ২০০৮ সালে সিচুয়ান ভূমিকম্পের পর সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় উদ্ধ্বার কাজে সাহায্য করার জন্য ইতালির রেড ক্রস এর মেডিক্যাল সংস্থা ১৪ জনের একটি বিশেষজ্ঞ টিম পাঠিয়েছিলো।  গুরুতর আহতদের (৯০০ জন) ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে বের করে আনতে ইতালিয়ান টিমের ভূমিকা ছিলো অনবদ্য। এ অবদানের কথা সিচুয়ানবাসী সবসময় কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে।

ঠিক একইভাবে ইতালির এই দুঃসময়ে চীন তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ইতালিকে। ইতালিয়ানদের করোনাভাইরাস মোকাবেলায় পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করার জন্য চীন একদল স্বেচ্ছাসেবক দল পাঠিয়েছে মার্চের ১৩ তারিখে। তার ৪ দিন পর আরো একটি টিম মেডিক্যাল সরঞ্জামাদি নিয়ে ইতালিতে আসে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীকে কিভাবে হ্যান্ডেল করতে হবে, তাদের টেকনিক্যাল ডিলেইলস, স্টাফ ম্যানেজমেন্ট, প্রতিরোধের উপায়, ডায়াগনসিস, চিকিৎসা পদ্ধতি, প্লাজমা থেরাপি সম্পর্কে ইতালিয়ান হেলথ প্রফেশনালদের অবগত করেছেন স্বল্প সময়ের মধ্যে। তাদের অভিজ্ঞতা থেকে এখানকার ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিক্স, মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট সবাই শিখতে চাইছেন যেন সঠিকভাবে সেবা দিয়ে রোগীদের সুস্থ করে তুলতে পারেন।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের লক্ষণ সামান্য থেকে গুরুতর হতে পারে। জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট হতে পারে। আরও গুরুতর ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া, কিডনি কাজ না করা থেকে মৃত্যুও হতে পারে। ইতালিতে শুরুর দিকে মৃত্যুহার কম ছিল যা বর্তমানে চীনকেও ছাড়িয়ে গেছে। ইতালিয়ান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০ মার্চ পর্যন্ত মোট একটিভ কেইস ছিলো ৩৭ হাজার ৮৬০, যার মধ্যে করোনাভাইরাসের লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা ছিলো ১৬ হাজার ২০ জন,  ইন্টেন্সিভ কেয়ারে ছিলো ২ হাজার ৬৫৫ জন আর হোম আইসোলেশানে ছিল ১৯ হাজার ১৮৮ জন। অর্থাৎ মোট একটিভ কেইসের অর্ধেক হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি ছিলো।

আমার বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব জানতে চেয়েছে ইতালিতে প্রতিদিন এতো লোক আক্রান্ত হবার কারণ কী? প্রতিদিন ৬০০-৮০০ লোক মারা যাচ্ছে কেন? উত্তরটা আমার সঠিক জানা নেই। তবে স্বল্প জ্ঞানে যা মনে হয়, বেশি সংখ্যক লোক আক্রান্ত হবার পেছনে ইতালিয়ানরাই দায়ি। প্রথমদিকে তারা ব্যাপারটাকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে চায়নি। এমনও অনেকে বলেছে আমাদেরকে অহেতুক ভয় দেখিওনা। আমাদের স্বাধীনভাবে চলতে দাও, মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস ছাড়তে দাও।

কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত এক ব্লগারের একটা ভিডিও দেখছিলাম সেদিন। বলছিলো, ভাইরাসে আক্রান্ত না হবার জন্য কোনো ধরনের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সে নেয়নি। প্রথমদিকে সবাই ভাবছিলো এটা সাধারণ সর্দি কাশির মতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ভাইরাস তার শরীরে প্রবেশ করে এবং ধীরে ধীরে তার ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। তার বাবা তার থেকে সংক্রমিত হয় আর এই সংক্রমণের কারণে সে তার জীবনের সবচাইতে প্রিয় আর পছন্দের মানুষকে হারায়। কতোটা হৃদয়বিদারক, চিন্তা করা যায়? সে হয়তো বেঁচে গেছে, কিন্তু কি দুর্বিসহ দিন পার করছে হাসপাতালে! রাতের পর রাত রেস্পিরেটরের সাহায্য ছাড়া শ্বাস নিতে পারছে না।

যখন মানুষ এ ভাইরাসের ভয়াবহতা বুঝতে পেরেছে ততদিনে হাজার হাজার লোক সংক্রমিত হয়ে গেছে। প্রথমদিকে যেসব অঞ্চলে বেশি ধরা পড়েছিলো সেসব অঞ্চলকে রেড জোন ঘোষণা করা হয়েছিলো। যারা নিজেদের সুস্থ মনে করছিলো এমন অনেকেই ওইসব অঞ্চল থেকে দক্ষিণ দিকের শহরগুলোতে চলে যেতে শুরু করলো। এসব লোকের অনেকেই হয়তো ভাইরাস বহন্কারী ছিলো আর যেতে যেতে অনেক মানুষকেই নিজের অজান্তে সংক্রমিত করে ফেলেছে। তারপর নির্দেশ এলো রেড জোনগুলোকে লকডাউন করার।

এখন থেকে ২-৩ সপ্তাহ আগের কথা বলছি আমি। লকডাউন করলেও রেস্টুরেন্ট, বার, কফি শপ একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খোলা রাখার কথা বললো। ইতালিয়ানরা যেমন আমুদে জাতি, তেমনি পরিবারকেন্দ্রিক আর সামাজিকও বটে। ছুটির দিনে দেখেছি তারা খুব নিয়ম করে পরিবার পরিজন নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে যায়, কফি শপ, ডেজার্ট শপগুলোতে সবসময়ই লোকজনের আড্ডা চলে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কৃষ্টি-কালচারে আমাদের দেশের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

তাহলে চিন্তা করুন এসব মানুষকে কোন শক্তি দিয়ে ঘরে বেঁধে রাখবেন? আমার বাসার ঠিক উল্টোদিকে ছোট একটা কফির দোকান, খাঁটি বাংলায় বললে টং দোকান আছে। আমরা যখন বাসার বাইরে যাচ্ছি না তখনো মানুষকে দেখতাম সেই দোকানের সামনে জটলা পাকিয়ে কফি খাচ্ছে আর হয়তো কোনো একটা টপিক নিয়ে একজন আরেকজনকে জ্ঞান দিতে দিতে দেশ উদ্ধার করছে! এটাতো আমার দেখা একটা ছোট্ট চায়ের দোকানের কথা, এমন হাজার হাজার দোকান বা রেস্টুরেন্টে কত মানুষ নিজের অজান্তেই অন্যকে সংক্রমিত করেছে তার হিসাব নেই।

প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না হওয়াটা খুবই জরুরি ছিলো। মানুষ তা করেনি। আর পুরো ফেব্রুয়ারি জুড়ে ভেনিসে কার্নিভ্যাল চলছিল। শুধু ইতালিয়ান কেনো বিশ্বের অনেক দেশ থেকে পর্যটকরা ভিড় জমিয়েছে ভেনিসের নানা শহরে। যেখানেই বড় জমায়েত সেখানে অন্তত একটা কেইস থাকলে ছড়াতে কতক্ষণ!  ৯ মার্চ তো সরকার পুরো দেশকে লকডাউন করে দিলো। চলাচলে আরো নিষেধাজ্ঞা জারি করলো। তারপরও কেনো সংক্রমণের হার কমছে না?

আমার ক্যালকুলেশান খুব সিম্পল। ৯ তারিখেও যারা সংক্রমিত হয়েছে তাদের উপসর্গ আসতেও তো সর্বোচ্চ ১৪ দিন লাগবে। ফলাফল, গত ১৮ তারিখ থেকে শুরু করে ২১ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিন ৪ হাজার থেকে সাড়ে ৬ হাজার রোগী পাওয়া গেছে। আর যেহেতু এটা একটা চেইনের মতো কাজ করছে, আশা করা যাচ্ছে আরো কয়েকদিন সংখ্যাটা বাড়বে, তারপর কমতে থাকবে। আরেকটা বিষয়, ২২ তারিখ পর্যন্ত কিন্তু মোট আড়াই লাখেরও বেশি মানুষের করোনাভাইরাস আছে কিনা তা পরীক্ষা করা হয়ে গেছে, যার মধ্যে একটিভ কেইসের সংখ্যা ছিলো ছেচল্লিশ হাজারেরও উপরে।

এবার আসি কেনো মৃত্যুহার বেশি সেই প্রসঙ্গে, প্রথমদিকে আমার মতো অনেকেই ভাবছিলো এদেশে বয়স্ক লোকের সংখ্যা বেশি তাই মৃত্যুহারও বেশি। ‘ইতালিয়ান ন্যাশানাল ইন্সটিটিউট অব হেলথ’ এর ১৯ মার্চের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৩০ বছরের নিচে মৃত্যুহার এখন পর্যন্ত শূন্য। ৮০-৮৯ বছরের বয়সের মানুষের সংক্রমণের হার ১৫% আর মৃত্যুহার ৪০.৮%। ৭০-৭৯ বছরের বয়সের মানুষের সংক্রমণের হার ১৯.৯% আর মৃত্যুহার ৩৫.৮%। ৬০-৬৯ বছরের বয়সের মানুষের সংক্রমণের হার ১৭.৭% আর মৃত্যুহার ১০.২%। ৯০ বছরের উপরে সংক্রমিত হচ্ছে ৩.১% আর মৃত্যুহার ৯.৪%। ৫০-৫৯ বছরের বয়সের মানুষের সংক্রমণের হার ১৯.১% আর মৃত্যুহার.২.৭%। ৪০-৪৯ বছরের বয়সের মানুষের সংক্রমণের হার ১২.৩% আর মৃত্যুহার ০.৬%। ৩০-৩৯ বছরের বয়সের মানুষের সংক্রমণের হার ৭.১% আর মৃত্যুহার ০.৪%।

দেখা যাচ্ছে ষাটোর্ধ্বদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি। বয়সের সঙ্গে আরো একটা বিষয় খুব কাজ করে সেটা হলো যদি প্রিএকজিস্টিং কন্ডিশান যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ বা অন্যান্য শারীরিক সমস্যা থাকে তাহলে ঝুঁকি আরোও বেড়ে যায়। কারণ বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে আর অন্যান্য শারীরিক সমস্যা থাকলে তা আরো দুর্বল থাকে। যেহেতু কোনো ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়াঘটিত সংক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য আমাদের শরীরের কোষ, টিস্যু আর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ একসঙ্গে ফাইট করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হবার কারণে ফাইটে এগিয়ে থাকাটা তখন কষ্টকর হয়। 

ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে কোন এক রোববার মিলানে সব প্রকার পারসোনাল গাড়ি সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বাইরে ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিলো। জানতে পারলাম, মিলানের পরিবেশ দূষণ কমানোর জন্য এই উদ্যোগ। ইউরোপের একশটা দূষিত শহরের ২৪টা শহরই ইতালিতে। করোনা আউটব্রেকের পর ভাবছিলাম, এই সংক্রমণের কারণে যেহেতু নিউমোনিয়া ডেভেলপ করে অর্থাৎ ফুসফুসকে আক্রমণ করে; এদেশের মানুষের লাংস ফাংশান বা ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কতোটা শক্তিশালী! পারবে কি এমন ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে? 

২০ তারিখে মিলানে ষাটোর্ধ্ব একজন বাংলাদেশি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। খবরে দেখছিলাম প্রতিদিন এতো মানুষ মারা যাচ্ছে যে শহরগুলোর সিমেটারিগুলোতে আর জায়গা হচ্ছে না। সারি সারি কফিন অপেক্ষা করছে তাদের শেষযাত্রার। আফসোস তাদের স্বজনেরা কেউ তার শেষযাত্রার সঙ্গীও হতে পারছে না।

কেউ কি ভেবেছিলো বাসা থেকে হাসপাতালে আসাটাই ছিলো তাদের শেষ আসা! কখনোও কি ভেবেছিলো আর দেখা হবে না সেইসব প্রিয় মুখগুলোর সঙ্গে!

চলবে…

আগের পর্ব

লেখক: পেশায় একজন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বাফেলো ইউনিভার্সিটি থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন। বসবাস করেন ইতালির পাভিয়া প্রদেশের ভিয়া জিওভান্নি তাভাজ্জানি এলাকায়