করোনাভাইরাস: ইতালিতে গৃহবন্দি প্রবাসীর ডায়েরি, পর্ব ৩

পড়াশোনার জন্য ৬ বছর আমরা যুক্তরাষ্ট্রের বাফেলো শহরে কাটিয়েছি। সেই শহরের প্রতিটা মানুষ আমাদের আপন হয়ে গিয়েছিলো। এখনো সেই আন্তরিকতা রয়ে গেছে।

ফাতেমা আখতার মিতু, ইতালি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 March 2020, 07:25 AM
Updated : 21 March 2020, 07:35 AM

গত দুইদিন সেখানকার অনেকেই ফোন করে খবর নিয়েছেন আমাদের। একটা সময়ে মনে হচ্ছিলো আমি বাফেলোতেই বসে কথা বলছি। শুনলাম, সেখানে খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। স্টোরগুলোতে তেমন কোনো খাবার পাওয়া যাচ্ছে না। সেখানের সবাই জানতে চাইছে- যেহেতু ইতালি লকডাউন, আমাদের পর্যাপ্ত খাবার আছে কিনা। আমরা কিভাবে দিন পার করছি। আলহামদুলিল্লাহ খাবার নিয়ে কোনো ক্রাইসিসে এখনও পড়তে হয়নি।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে আজকাল আর লোকজন চোখে পড়ে না। আমাদের এক ব্রাজিলিয়ান বন্ধু লিসা, পাভিয়া ইউনিভার্সিটির পিএইচডি কোর্সের ছাত্রী। তার সঙ্গে মাঝে মধ্যে চায়ের আড্ডা হয়। একটা নির্দিষ্ট সময়ে লিসা ও আমরা চা বানিয়ে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে স্কাইপে কথা বলি। লিসা অবশ্য স্টোরে গিয়ে বাজার করে। লিসা জানালো, স্টোরগুলোতে একই সময়ে পাঁচজনের বেশি ঢুকতে দেয় না, আর বাকিরা বাইরে একে অপরের থেকে ১ মিটার বা ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে।

অবশ্য দোকানে খাবার সংকট তার চোখে পড়েনি, এমনকি জিনিসের দামও বাড়েনি। প্যানিক বায়িং ব্যাপারটা তার চোখে পড়েনি। আমরাও যে অনলাইনে কেনাকাটা করলাম, কোনোকিছুর সংকট বা দাম বেশি বলে মনে হলো না।

ও আরেকটা কথা, আমরা দুজন ২৪/৭ বাসায় আছি আজ ২০ দিনেরও বেশি হলো। আমরা প্রথম দিকেই একটা রুল সেট করে নিয়েছিলাম আমাদের দুজনের জন্য। হয়তো শুনলে মনে হবে আদিখ্যেতা। তবে আমাদের মনে হয়েছে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য এটা জরুরি। আমরা ঠিক করেছি, যতকিছুই হোক না কেনো এই সময়ে নিজেদের মধ্যে কথা কাটাকাটি করা যাবে না, কোনো কারণে একের উপর অন্যের বিরক্ত হওয়া চলবে না। মোটকথা ঘরের পরিবেশকে গুমোট করা চলবে না। কোনো বিষয়ে নিজেদের মধ্যে দ্বিমত থাকতেই পারে তাই বলে উত্তেজিত হওয়া যাবে না। সংসার জীবনে এসব নিয়ম চলে নাকি? নাহ আমাদের চলছে ভালোই, করোনার কারণে চালিয়ে যাচ্ছি। খুব ট্যাক্টফুলি আমরা ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করছি।

আজ ১১ মার্চ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘কোভিড-১৯’কে প্যান্ডেমিক বা বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করলো। করোনাভাইরাস নিয়ে প্যানিক না করে আমাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। যেহেতু এখনো ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হয়নি, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের উপসর্গগুলো কমানোই আসলে একমাত্র চিকিৎসা। কাজটা কি খুব সহজ? সহজ হলে তো প্রতিদিন ইতালিতে শত শত মানুষ মারা যেতো না। ফুসফুসের সংক্রমণের মাত্রা বেশি হয়ে গেলে তখন বাঁচানো আসলে খুব কঠিন হয়ে যায়।

ইতালির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটা পরিসংখ্যানে দেখলাম, ১২ মার্চ পর্যন্ত মোট ৮৬ হাজার ১১ জনের করোনাভাইরাস টেস্ট করা হয়েছে। আর মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ হাজার ১১৩ জন। প্রতিদিনই খারাপ সংবাদ শুনছি। আক্রান্তের সংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এভাবে সংখ্যা বাড়তে থাকলে এদেশ কিছুদিনের মধ্যে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হবে। ২০ দিনের মধ্যে আজ ভোরে এই প্রথম অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ পেলাম। আশপাশের শহরের হাসপাতালগুলোতে আর জায়গা হচ্ছে না। আমাদের শহরের বড় যে হাসপাতাল আছে সেখানে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকার কারণে আউটব্রেকের প্রথম থেকেই অন্যান্য শহরের ক্রিটিকাল রোগীদের এখানে নিয়ে আসা হচ্ছিলো চিকিৎসার জন্য।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বলা হচ্ছে সাবান দিয়ে হাত ধুতে কিংবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে। কেন? অল্প একটু পড়াশোনা করে যা বুঝেছি, করোনাভাইরাসের আবরণ ফ্যাট (খাটি বাংলায় বললে চর্বি) দিয়ে তৈরি। সাবানে আছে ক্ষার। চর্বি যখন ক্ষারের সংস্পর্শে আসে, তখন চর্বি ভেঙে টুকরা হয়ে যায়। সাবানের সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গে করোনাভাইরাসের ওপরের আবরণ নষ্ট হয়ে যায়, ফলে ভাইরাস মরে যায়। হ্যান্ড স্যানিটাইজারের কাজও একই, তবে কাপড় কাচার বার সাবান সবচাইতে কার্যকর।

হাত একটু পরপর সাবান দিয়ে ধুতে হবে। কতক্ষণ ধরে হাত ধুতে হবে সেটা রবি অবশ্য আমার আগেই গুগল করে বের করে ফেলেছে। আমি যখন হাত ধুতে যাই সে খুব সুন্দর করে হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থ ডে ডিয়ার লা.. লা..হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ এইভাবে দুইবার গাইতে থাকে। দুইবার গাইতে ৩০ সেকেন্ড সময় লাগে আর হাত ধোয়ার স্ট্যান্ডার্ড সময় হলো ২০ সেকেন্ড। ২০ সেকেন্ডের কম সময়ে ভাইরাসকে হাত থেকে মুক্ত করা যায় না।

চারদিক থেকে শুধু খারাপ খবর শুনছি। আমার ছোট ভাই পিএইচডি করছে যুক্তরাষ্ট্রে। তার শহরেও করোনাভাইরাসের কয়েকজন রোগী পাওয়া গেছে। ইউনিভার্সিটি থেকে নির্দেশ এসেছে বাসায় বসে অনলাইনে ক্লাশ করার। তাকে বাজারের একটা লিস্ট করে দিলাম আর প্যানিক না করে সব নিয়ম মানতে বললাম। কেমন একটা অস্থির সময় পার করছি আমরা!

(চলবে)

আগের পর্ব

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি। বসবাস করেন ইতালির পাভিয়া প্রদেশের ভিয়া জিওভান্নি তাভাজ্জানি এলাকায়। পেশায় একজন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বাফেলো ইউনিভার্সিটি থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন।