সাইপ্রাস বর্তমানে একটি বিভক্ত রাষ্ট্র। তুর্কি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ১৯৭৪-এর তুর্কি আগ্রাসনের পর থেকে দ্বীপের উত্তরের এক-তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। এই ঘটনাটি সাইপ্রাসের রাজনীতিতে আজ অবধি গভীর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। সাইপ্রাসের মোট লোকসংখ্যার ৮৩% গ্রিক সাইপ্রিয়ট, ১৫% তুর্কি সাইপ্রিয়ট, বাকি দুই ভাগ আর্মেনিয়ান ও মারোনিট।
নিকোশিয়াতে ঢোকার পর দেখতে পেলাম গ্রিস ও তুর্কি অংশের মধ্যে তারের বেড়া দিয়ে আলাদা করে ফেলা হয়েছে। বেড়ার ওপারে তুরস্কের পতাকা মাটিতে এঁকে রাখা হয়েছে অন্য অংশকে উত্যক্ত করার জন্য। আলোকসজ্জা করা হয়েছে এই পতাকার আশপাশে যাতে রাতেও সেটা দেখা যায়। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কোন অংশই শান্তিতে নেই, খুশি নেই।
তুর্কিরা প্রমাণ করতে চেয়েছে তারা সাইপ্রাসের জনগণকে সাহায্য করার জন্য সেখানে গিয়েছে, কিন্তু বাস্তবতা তা প্রমাণ করে না। আগেই তারা ভালো ছিল, সব ধর্মের লোকের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ছিল, সহবস্থান ছিল, যা বিভক্ত সাইপ্রাসের তুর্কি অধিকৃত অংশে উধাও।
আমরা যে হোটেলে ছিলাম, সেই হোটেলের মধ্যে একটা উপহার সামগ্রীর দোকান ছিল। দোকানের মালিকের বোনও ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করেন, তার সঙ্গে কথা হলো। জিজ্ঞাসা করেছিলাম কীভাবে আলাদা হয়েছিল, এতে সমাজের উপর কী প্রভাব পড়েছিল? তখন উনি আমাকে জানান, দেখেন অনেকে মনে করে সাইপ্রাসের অপর অংশটা তুরস্কের অংশ। কিন্তু সেটা ঠিক নয়। আমরা একটা স্বাধীন দেশ, স্বাধীন জাতি ছিলাম। আমাদের মধ্যে ভাষার পার্থক্য ছিল, তারপরও কিন্তু আমাদের কোন সমস্যা ছিল না। আমরা সবাই মিলেমিশে বাস করছিলাম, কারণ আমরা সবাই সাইপ্রিয়ট ছিলাম, আছি এবং থাকবো। কিন্তু তুরস্ক আগ্রাসন চালিয়ে একটা স্বাধীন দেশের এক তৃতীয়াংশ দখল করে নেয় নিরাপত্তা দেবার নামে। কিন্তু কী নিরাপত্তা তারা দিয়েছে দেখেন! আমি তুর্কি সাইপ্রিয়ট অধ্যুষিত এলাকায় বসবাস করতাম। সেখানে আমার বাড়ি ছিল, ব্যবসা-বাণিজ্য, বন্ধু-বান্ধব ছিল, আরও ছিল আমার শৈশব। কয়েক ঘণ্টার নোটিশে আমাকে আমার ভিটেমাটি ছাড়া করা হয়েছিল। আমাকে শূন্য হাতে গ্রিক অংশে চলে আসতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু যখন তুরস্ক সেখানে আগ্রাসন চালায় তারা বলেছিল তারা বহিঃশত্রু আক্রমণ থেকে সাইপ্রাসের নিরাপত্তার জন্য বা বিশেষ করে তুর্কি সাইপ্রিয়টদের নিরাপত্তা দেবার জন্য তারা সেখানে এসেছে। আপনি বলেন তুর্কি সাইপ্রিয়টের নিরাপত্তার বিধান নিশ্চয়ই কোন নিরীহ গ্রিক সাইপ্রিয়টকে বিতাড়িত করে হতে পারে না।
এখানকার সব থেকে উঁচু পাহাড়টা ভূমধ্যসাগর থেকে ৮০০ মিটার উপরে। সকালে নিকোশিয়া যাত্রা আর গোধূলিলগ্নে প্রত্যাবর্তন শুক্রবার সকাল আটটায়, আমরা রওয়ানা দিলাম পাফোস থেকে রাজধানি নিকোসিয়ার উদ্দেশ্যে। পথপ্রদর্শক বাসে আমাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছিলেন সবকিছু কোথায় কী গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি বিশেষ গাছপালা ও ফলের বাগানের বর্ণনাও উনি দিচ্ছিলেন।
আমার মনে হয়েছিল পুরো দেশটাই এ ভদ্রমহিলার নখদর্পণে, কোনরকম লিখিত ধারাবিবরণী উনি দেননি। কোন বিশেষ তথ্যও নোট করে রাখেননি, সবকিছু মুখস্ত বর্ণনা করেছেন। পাফোসে যে দুটো বড় জলাধার আছে কৃষিতে জল সরবরাহের জন্য তা দেখালেন এবং অনেক সময় বৃষ্টি বেশি হলে জল উপচে পড়ার কাহিনী।
‘পেত্রা তু রোমিও’ যা ‘অ্যাফ্রোদিতির রক’ নামেও পরিচিত, সাইপ্রাসের পাফোসে সমুদ্র প্রস্তরের স্তুপ। পাফোস থেকে লিমাসল পর্যন্ত যে প্রধান রাস্তা গেছে তার উপকূলে অবস্থিত। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী সাইপ্রাসের জনগণ বিশ্বাস করে এখান থেকে গ্রিক দেবী অ্যাফ্রোদিতি আবির্ভূত হয়েছিলেন। এখন এ স্থানটা খুবই জনপ্রিয় একটা পর্যটক আকর্ষণে পরিণত হয়েছে। এখানে এসে আমাদের বাস থেমে গেল, প্রায় বিশ মিনিট আমাদেরকে সময় দেওয়া হয়েছিল ছবি তোলা ও দেখার জন্য। তবে এখানে সমুদ্রস্নান এবং শিলা আহরণ নিষিদ্ধ।
বেশ কয়েকটা সামরক ঘাঁটি চোখে পড়েছিল আমাদের। পাফোস থেকে বেরিয়ে লিমাসোলের দিকে যাবার সময় একটা ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটি পড়ে। ১৯৬০ সালে ব্রিটিশরা সাইপ্রাসকে স্বাধীনতা দিলেও পুরো স্বাধীনতা যে দেয়নি এই সামরিক ঘাঁটিই তার প্রমান। নিরাপত্তার নামে এখনো সাইপ্রাসকে চুষে খাচ্ছে, কিন্তু কার্যকর কোন পদক্ষেপ তারা বিপদের সময় নেয়নি।
হাইওয়ে না থাকার কারণে রাজধানীমুখী সব যানবাহনকে এই সামরিক ঘাঁটির মধ্য দিয়ে যেতে হতো আর তারা প্রত্যেকটা গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করত। সব রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারপর ছাড়ত, একটা দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে হলে যেরকম নিয়মের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় এখানেও সেই একই ঘটনা ঘটত। অথচ সাইপ্রাস একটা স্বাধীন প্রজাতন্ত্র।
এরকম কিছু আমেরিকান সামরিক ঘাঁটি জার্মানিতে এখনও দেখা যায়। এসব ঘাঁটির মধ্যে পুরো আমেরিকান আইন-কানুন। এরকম তিনটা আমেরিকান সামরিক ঘাঁটিতে যাবার সুযোগ আমার হয়েছিল। হোহেনফেলসের ঘাঁটিতে আমি দুই রাত ছিলাম। এসব ঘাঁটির মধ্যে সাইকেল চালাতে হলে আপনাকে অবশ্যই হেলমেট ব্যবহার করতে হবে, সেটাই আমেরিকার নিয়ম। হেলমেট ছাড়া সাইকেল চালালে জরিমানা, অথচ জার্মানির আইন অনুযায়ী আপনাকে সাইকেল চালানোর সময় হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক নয়। এই ঘাঁটি থেকে বেরিয়ে আসলে আপনি আবার হেলমেট ছাড়া সাইকেল চালাতে পারেন।
অনেক জায়গায় হাইওয়ের মাঝখানে ওলিয়ানডার ফুলের চাষ করেছে, এগুলো সাধারণত শুষ্ক মৌসুমেও মরে না। পরিচর্যাও খুব সহজ, এজন্য এই ফুলগুলো হাইওয়ের মাঝখানে লাগানো হয়েছে যাতে শুষ্ক মৌসুমেও সৌন্দর্যের কমতি না হয়। গাইড কিছু গ্রাম দেখিয়ে জানালেন এগুলো এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। কারণ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বাড়ছে, সেই সাথে কাজের সন্ধানে মানুষ শহরের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। তারা আগের মতো আর গ্রামের জীবনে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে না। আর অতিথি কর্মী যারা কাজের জন্য আসে তারাও গ্রামে থাকে না, কারণ অধিকাংশই শহরে বা পর্যটন এলাকায় কাজ করেন।
যখন আমরা লিমাসল পার হচ্ছিলাম তখন গাইড আমাদের দিক নির্দেশ করে দেখালেন ওদিকে অলিম্পাস মাউন্টেন সাইপ্রাসের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। এ পর্বতের উচ্চতা এক হাজার নয়শ ৫২ মিটার, এটা সাইপ্রাসের ট্রুডোস পর্বতমালার মধ্যে অবস্থিত। ‘ট্রুডোস স্কোয়ার’ লিমাশোল জেলার প্ল্যাটার অঞ্চলের অন্তর্গত। বর্তমানে ব্রিটিশরা একটা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রাডার পর্বত অলিম্পসের শিখর থেকে পরিচালনা করেন।
মাউন্ট অলিম্পাসে স্কি রিসোর্ট আছে। অস্ট্রিয়ার সহায়তায় ট্রুডোস পর্বতমালার উপর এ স্কি রিসোর্ট তৈরি করেছে। যখন শীতে তুষারপাত হয় তখন অনেকেই সেখানে স্কি করতে আসে। দূর থেকে পাহাড়ের চূড়ায় একটা সাদা বলের মতো দেখা যায়। লিমাসোল থেকে এক ঘণ্টার পথ এই পর্বতশৃঙ্গ।
একটা মঠের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো, এটাতে শুধু পুরুষরা প্রবেশাধিকার রাখে, মহিলাদের জন্য নিষিদ্ধ। এটার ‘সারোমনির মঠ’ হিসেবে পরিচিত। তবে পুরুষরা শুধু সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত এই মঠ পরিদর্শন করতে পারেন।
লারানাকার সল্টলেকের একদিকে বিশেষ ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ একটা গির্জা এবং আরেকদিকে একটা বিশেষ ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ। গির্জাটা লেকের পাড় থেকে ঠিক ১.১ কিলোমিটার দূরে আর মসজিদটা একবারে লেকের পারে, কিন্তু মসজিদ আর গির্জার দূরত্ব ৫.৪ কিলোমিটার। সাইপ্রাসে যতগুলো ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ গির্জা আছে তার মধ্যে অন্যতম। লারনাকা অতিক্রম করার সময় আমরা আধ ঘণ্টা এখানে পেয়েছিলাম ঘুরে দেখার জন্য।
ঋষি লাজারাস যিশুখ্রিস্টের খুব ভালো বন্ধু ছিলেন। যিশুখ্রিস্টের পৃথিবীতে পুনরায় আবির্ভাবের পর জাহাজে করে তিনি সাইপ্রাসে এসেছিলেন। ঋষি লাজারাস লারনাকার প্রথম বিশপ ছিলেন, এজন্য তার নামানুসারে ৯০০ সালের দিকে এই গির্জার নামকরণ করা হয়েছিল। এই গির্জার মধ্যেই অট্টালিকার ভূগর্ভস্থ অংশে উনি সমাহিত।
মসজিদটার নাম ‘হালা সুলতান’ বা ‘উম হারাম’। এই মসজিদটাকে সাইপ্রাসবাসিরা মক্কা, মদিনা ও জেরুজালেমের পর বিশ্বে চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ মনে করে। উম হারাম ছিলেন নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর একজন ঘনিষ্ট সহচর উবাইদ ইবনে আল সামিতের স্ত্রী। তার নামানুসারে এই মসজিদের নামকরন হয়েছিল ‘উম হারাম’। এই মসজিদ চত্বরে পুরুষ এবং মহিলাদের থাকার ব্যবস্থা ছিল।
লারনাকাতে বেশ সমতল ভূমি আছে। এখানেও লালচে মাটি আছে, আলু ফলানোর জন্য এই মাটি খুব উর্বর। এখানে অনেক ব্যক্তিমালিকানাধীন ঘরবাড়ি আছে। এরপর আমরা পৌঁছলাম রাজধানী নিকোশিয়াতে। বাসে বসেই আমরা দেখতে পেলাম বিভক্ত রাজধানী। আগে পর্যটকদের তুরস্ক অধিকৃত অংশে যাওয়ার কোন অনুমতি ছিল না, কিন্তু এখন সেটা শিথিল করা হয়েছে। বাস থেকে নামার আগেই গাইড আমাদের জানিয়ে দিলেন কতক্ষণ যাত্রাবিরতি আর কী কী দেখার আছে রাজধানীতে।
আর উনি আমাদের সতর্ক করলেন যারা তুরস্ক অধিকৃত অংশে যেতে চায় তারা যেন পাসপোর্ট বা পরিচয়পত্র সঙ্গে নিতে না ভুলি। আরও জানালেন দর্শনীয় স্থান কী কী আছে যা আমাদের দেখা উচিৎ। এদিন প্রচণ্ড গরম ছিল এবং রোদও ছিল প্রখর। মাথা ঝিমঝিম করছিল, চোখে অন্ধকার লাগছিল। হাতে সময় বেশি ছিল না, আমাদের ৪৫ মিনিট সময় দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে যতবেশি দেখে নেওয়া যায়।
একটু হাঁটার পরই পুরাকৃতির নিদর্শন চোখে পড়ল, এটা ছিল একটা মসজিদের মিনার। চোখে পড়ল, আর সেটা ধরে এগিয়ে গেলাম। ছবি তুলছিলাম আর ঘুরে ঘুরে মসজিদটা দেখছিলাম। মসজিদ চত্বরে একটা বিড়াল দেখলাম ঘুমাচ্ছে। একসময় উচ্চশব্দে আজান শুরু হল যা গত ২৬-২৭ বছরে ইউরোপের কোন দেশে শুনিনি। এটা একটা ঐতিহাসিক মসজিদ, দুই হাজার পাঁচশ জন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন এক হাজার সাতশ ৫০ বর্গমিটার আয়তনের। মসজিদের নাম ‘সেলিমিয়ে মসজিদ’।
এটা অতীতে রোমান ক্যাথলিক ক্যাথেড্রাল ছিল, পরবর্তীতে এটাকে মসজিদে রূপান্তর করা হয়। উত্তর নিকোসিয়া অবস্থিত এটাই শহরের প্রধান মসজিদ। এটি নিকোসিয়ার বৃহত্তম ঐতিহাসিক ভবন যা এখনও টিকে আছে। উসমানিয় সাম্রাজ্যকালীন মধ্যবর্তী সহস্রাব্দে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে নির্মিত বৃহত্তম গির্জা ছিল বলে মনে করা হয় এই স্থাপনাকে।
মসজিদ দেখে আর বেশি দেরি করিনি, দ্রুত একটা সুভেনিরের দোকান থেকে স্মৃতি স্বরূপ কয়েকটা পোস্টকার্ড কিনে দ্রুত আবার অভিবাসনের দিকে ছুটলাম। আবারও পাসপোর্ট দেখে আমাকে ছেড়ে দিল। যখন তুর্কি অধিকৃত সাইপ্রাসে আমি যাই তখন আমার বউ-বাচ্চা সঙ্গে ছিল না। ওরা নিকোশিয়ার শপিং সেন্টারে কেনাকাটায় ব্যস্ত ছিল। এসব শপিং সেন্টারের কোন একটার উপরে এগারতলায় একটা ছোট যাদুঘর আছে। আর এই যাদুঘর থেকে তুর্কি অধিকৃত অংশ বেশ ভালভাবে দেখা যায়।
আমার বউ-বাচ্চা সেখানে গিয়েছিল, আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি সময়াভাবে। প্রচণ্ড গরমের কারনে এদিন প্রায় ৫ লিটারের উপরে জলপান করতে হয়েছিল। টি-শার্ট ঘামে ভিজে গিয়েছিল, পুরো আমাদের দেশের আবহাওয়া। আমাদের মতো রাজধানীর তাপমাত্রাও এখানে বেশি। রাজধানী নিকোশিয়ার পাঠ চুকিয়ে আমরা আবার বাসে উঠলাম। বাসে উঠার পর একটু স্বস্তি পেলাম আমরা, তারপরও মনে হচ্ছিল শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যেন ঠিকমত কাজ করছে না।
এরপর আমাদের বাস নিকিতারির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। নিকিতারি রাজধানী নিকোশিয়া থেকে ৫০ কিলমিটার দূরে। নিকিতারি পৌঁছে দুপুরের খাবারের আগে আমাদের একটা গির্জা পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া হলো, যেটা এখন ইউনেস্কোর তত্ত্বাবধানে। নিকোশিয়া জেলার নিকিতারি গ্রাম থেকে ৫ কিলোমিটার দক্ষিণে। গির্জাটি ট্রোডোস পর্বতমালার দোচালার মধ্যে একটি।
এই গির্জাকে একটি সন্ত হিসাবে যিশুর মা মেরিকে উৎসর্গ করা হয়। ১৯ শতাব্দীতে পরিত্যক্ত একটি মঠের অন্তর্গত এই গির্জা। অভূতপূর্ব সব চিত্রকর্মে পরিপূর্ণ এই গির্জার দেওয়াল ও ছাদ। ছবিগুলো ধর্মীয় ইতিহাসের হাজারো কাহিনী বহন করছে। গাইড অনর্গল একটা টর্চলাইট হাতে নিয়ে ছবির উপর নির্দেশ করে আমাদেরকে বলে গেলেন কোন রকম বই পুস্তকের সাহায্য ছাড়া। এখানে ছবি তুলতে যখন আমাদের নিষেধ করলেন তার আগেই আমি কাজ সেরে ফেলেছিলাম, একটা দুর্লভ ছবি হয়েই থাকল সেটা।
গির্জার কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্ট ছিল, সেখানে আমরা দুপুরের খাওয়া-দাওয়া করলাম। প্রচণ্ড রোদ এবং গরম ছিল এদিন, গির্জা থেকে রেস্টুরেন্ট পর্যন্ত যেতে আমাদের বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। গত ২৬ বছরে কখনও আমাকে গরমে ইউরোপের কোন দেশে এরকম বেগ পেতে হয়নি। বারবার এদিন দেশের কথা মনে হচ্ছিল।
যাওয়া আসার পথে রাস্তার দুধারে প্রচুর বন আমরা দেখেছি, সেখানে- পাইন, কালো পাইন ও ফাগ গাছের মেলা। এসব গাছ শুষ্ক মৌসুমেও বাড়ে এবং বেঁচে থাকে। উপরের দিকে পাহাড়ের শুধু কালো পাইন গাছের সমারোহ দেখলাম। সাইপ্রাসের রুবিনেন গাছও জন্মায় প্রচুর। বছর দশেক আগে যে পাহাড়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড হয়েছিল দেখলাম এখনও কালো হয়ে আছে। কিন্তু সেখানে আবারও গাছ জন্মানো শুরু হয়েছে ধীরে ধীরে।
এরপর আমাদের গন্তব্য ছিল ওমোডোস গ্রাম। নিকিতারি থেকে ওমোডোসের দুরত্ব ৫৪ কিলোমিটার। ওমোডোস চমৎকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর একটা গ্রাম। এখানেই প্রথম একটা পুলিশের গাড়ি আমার নজরে এসেছিল। এতেই বোঝা যায় এ দেশে অপরাধের সংখ্যা খুবই কম, এজন্য পুলিশকে খুব তৎপর থাকতে হয় না। ওমোডোসকে বলা হয় ‘ওয়াইনের রাজধানী’, কিন্তু এখানে কোন মদ্যপ মানুষ আমার চোখে পড়েনি। এই গ্রামটা বিখ্যাত সাইপ্রিয়ট ঐতিহ্যগত পণ্য উৎপাদনের জন্যও। হরেক রকম মিষ্টান্ন, মধু ও ফল উৎপাদিত হয় এই গ্রামে।
ওমোডোস গ্রামটা আরেকটা কারনে বিখ্যাত, সেটা হলো মঠের জন্য। সাইপ্রাসের আনাচে কানাচে গির্জা-মঠ-মসজিদ, দেশটা আসলে দেব-দেবী, পীর-পয়গম্বরের ইতিহাসে ভরপুর। এই দেশটা ধর্মীয় দিক দিয়ে যেমন খ্রিস্টানদের কাছে গুরুত্ব বহন করে, তেমনি মুসলমানদের কাছেও। তবে এখানে আমি কোন হিজাব পরা বা মাথায় ফ্যাটা বাধা মহিলাকে দেখিনি, এমনকি তুরস্ক অধিকৃত সাইপ্রাসেও না। আসলে ধর্ম এদের মনে, পোশাকে নয়। ধর্ম আত্মশুদ্ধির জন্য, আর তাদের পোশাক তাদের দেশিয় সংস্কৃতি ও আবহাওয়া অনুযায়ী।
ওমোডোস থেকে ২৪ কিলোমটার দূরে একটা অসাধারণ উদ্ভিদ উদ্যান আছে, এটা ‘ট্রুডোস গিওপার্ক’ নামে পরিচিত। এই পার্কের অতিথি কেন্দ্রটা পুরাতন অ্যাসবেস্টস খনিতে অবস্থিত।
এরপর আমাদের পাফোসে হোটেলে ফেরার পালা। পাফোস তখনও আমাদের থেকে ৬২ কিলোমিটার দূরে। আমাদের আর কোন নির্ধারিত যাত্রা-বিরতি ছিল না।
বাস চলা অবস্থায় গাইড আমাদের কিছু গাছ দেখিয়ে বললেন এগুলো ক্যারব গাছ, এটা একটা ঔষধি গাছ যা অনেকটা বিলুপ্তির পথে। ইউনেস্কোর তত্ত্বাবধানে এখন এই জাতের গাছকে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে এই প্রজাতির জন্ম বিস্তারের জন্য। এই গাছের ফলের বীজ থেকে তৈরি ঔষধ পেটের পীড়া এবং অনিদ্রার জন্য খুবই উপকারি। চলন্ত বাস থেকে গাছগুলোর ছবি তোলা সম্ভব হলো না, একটু মনকষ্ট নিয়ে হোটেলে পৌঁছলাম।
লেখক: তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন, জার্মানি।
ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক
ইমেইল: mfjoarder@yahoo.com
এই লেখকের আরও লেখা
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |