সাইপ্রাসে সপ্তাহখানেক: প্রথমদিনের ঘোরাঘুরি, একটুখানি সাগরস্নান

এ বছরের পহেলা অগাস্ট জার্মানির নুরেনবার্গ থেকে উড়লাম সাইপ্রাস প্রজাতন্ত্রের উদ্দেশ্যে। গের্মানিয়া এয়ারের বিমানটা কানায় কানায় পূর্ণ ছিল খালি আসন চোখে পড়েনি। আমাদের বিমানটা সঠিক সময়ে অর্থাৎ দুপুর পৌনে ২টায় উড়ল জার্মানির নুরেনবার্গ থেকে আর সাইপ্রাসের পাফোস আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে গিয়ে নামল সন্ধ্যায় ।

মমতাজুল ফেরদৌস জোয়ার্দার, জার্মানির নুরেনবার্গ থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Oct 2018, 02:35 PM
Updated : 11 Oct 2018, 02:37 PM

আমরা সময় এর বিপরীতে যাচ্ছিলাম সাইপ্রাস জার্মানি থেকে এক ঘণ্টা এগিয়ে বাংলাদেশ সময় থেকে তিন ঘণ্টা পিছিয়ে। জার্মানির নুরেনবার্গ থেকে সাইপ্রাসের পাফোস বিমান বন্দর পর্যন্ত তিন ঘণ্টার উপরে সময় লাগে। বিমান মাটি ছোঁয়ার আগে আমি আমার স্ত্রীকে বলছিলাম আমরা কি বাংলাদেশে নামছি? রানওয়ের পাশের ঘাসগুলো যেভাবে রোদে পুড়ে গিয়েছিল তা দেখে ভ্রম হতেই পারে যে ইউরোপের কোনও দেশ নয়, যেন বাংলাদেশেই নামছি। এরকম দৃশ্য আমি ইউরোপের কোনও দেশে আগে দেখিনি।

পাফোস বিমানবন্দরটা ছোট কিন্তু প্রতিদিন প্রচুর বিমান ওঠানামা করে, পর্যটকরা আসছেন প্রতিদিনই। কয়েক বছর আগেও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলোর মধ্যে পর্যটকরা নিয়ন্ত্রনহীনভাবে প্রবেশ করতে পারত। অভিবাসনে কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না, আভ্যন্তরীণ বিমানের মত ছিল ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের একদেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়া। কিন্তু বেশকিছু সন্ত্রাসী হামলা হওয়ার পর থেকে প্রত্যেকটা দেশ কড়া অভিবাসন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পর্যটকদেরকে ছাড়পত্র দিয়ে থাকে। জার্মানি থেকে উড়ার সময়ও সবার কাগজপত্র ঠিকমত পরখ করে তারপর ছেড়েছিল।

বিমান থেকে নেমে বাসে ওঠার সময় গরমের একটা ধাক্কা সামলাতে হল বাংলাদেশের মত। তারপর বিমানবন্দরের অভিবাসনের দিকে যাত্রা। আমার গায়ের রঙয়ের কারণে অভিবাসন কর্মীরা সহজেই বুঝে ফেলেন আমি ইউরোপিয়ান না, আগ্রহ সহকারে একজন পথপ্রদর্শক আমার দিকে এগিয়ে এলেন, দেখিয়ে দিলেন কোন লাইন দিয়ে আমাদের যেতে হবে। সাধারণভাবে যাদের ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কোনও দেশের পাসপোর্ট নেই তাদের জন্য অন্য সারিতে অপেক্ষা করার কথা কিন্তু আমার সফরসঙ্গীরা অর্থাৎ বউ এবং বাচ্চা জার্মান নাগরিক বিধায় আমাকেও তাদের সাথে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নাগরিকদের সারিতে পাঠিয়ে দিল। আমার পাসপোর্টটা হাতে নিয়ে অভিবাসন কর্মকর্তা কি যে দেখছিলেন বুঝলাম না। আমার পাসপোর্টটাও যন্ত্রে পাঠযোগ্য ছিল, সাথে ছিল আমার আজীবন জার্মানিতে বসবাসের অনুমোদনপত্র। সবকিছুই ডিজিটাল, এগুলো পরখ করে দেখতে অতোটা সময় নেওয়া উচিৎ ছিল না। ওই অভিবাসন কর্মকর্তার বয়স একটু বেশি ছিল। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কোন দেশে এর আগে আমি এজাতীয় কোন ধীরগতি সম্পন্নকর্মীকে কাজ করতে দেখিনি। দেশের কথা মনে হচ্ছিল অহেতুক দেরি করানো, বা খুঁত বের করা। 

অভিবাসন থেকে বেরিয়ে আমাদের ব্যাগ সংগ্রহ করে বাইরে বেরোলাম। বাইরে এসে দেখলাম যে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের অবকাশ যাপন করতে আসা তাদের একজন দাঁড়িয়ে আছেন। জানালেন, আমাদের বাস বাইরে অপেক্ষা করছে। বাস পর্যন্ত সামান্য রাস্তাটুকু যেতেই আবারও গরমের ধাক্কাটা ভালই অনুভব করলাম, শরীর ঘামে চ্যাটচেটে হয়ে গেল যা ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোতে বিরল।

আমাদের গন্তব্য 'হোটেল লুইস লেডরা বিচ'। সাইপ্রাসে যানবাহনগুলো আমাদের দেশের মত বামদিক দিয়ে চলে, যা আমার দেখা ইউরোপের অন্যদেশগুলোতে দেখিনি। কারণ সাইপ্রাস একসময় ব্রিটিশ কলোনি ছিল।

প্রধান সড়কগুলো তেমন চওড়া না। গাড়িঘোড়ার ভিড় খুব বেশি নেই পাফোসে, যানজটও চোখে পড়েনি। যদিও সাইপ্রাসের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটা পাফোস শহরে, তবুও এটা সাইপ্রাসের সবচেয়ে ছোট শহর আয়তনের দিক দিয়ে। বিমানবন্দর থেকে হোটেল পর্যন্ত যেতে সর্বোচ্চ গতি দেখলাম রাস্তায় ৬৫ কিলোমিটার। শহরের মধ্যে রাস্তাগুলোর পাশে সাইকেলে যাতায়াতকারিদের জন্য আলাদা পথ আছে। রাস্তার দুই ধারে প্রচুর জলপাইয়ের গাছ, বেশকিছু গবাদি পশুর খামারও চোখে পড়লো।

তারপর এক জায়গায় সাইনবোর্ডে লেখা দেখলাম ‘পর্যটন এলাকা’। কোনও দেশের পর্যটন এলাকায় ঢুকে গেলে নিবিড়ভাবে দেশটার সাথে পরিচিত হওয়া যায় না। সেখানে সবকিছু থাকে সাজানো গোছানো ছবির মত। বিশ মিনিটেই আমরা হোটেল পৌঁছে গেলাম। আমরা বাস থেকে নামতে না নামতেই বাক্স পেটরা নিয়ে গেল হোটেল কর্তৃপক্ষ, আর আমাদেরকে বসার জন্য জায়গা দেখিয়ে হাতে কিছু কাগজপত্র ধরিয়ে দিল পূরণ করার জন্য।

এরমধ্যেই আমাদের টেবিলে পানীয় সরবরাহ করলো। সকল আনুষ্ঠানিকতা সারার পর অভ্যর্থনাকারী আমাদেরকে চাবি দিয়ে ঘরে চলে যেতে বললেন আর জানালেন আমাদের ব্যাগ কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে পৌঁছে যাবে। এর আগে অবশ্য উনি আমাদেরকে সংক্ষিপ্ত ধারণা দিয়ে দিলেন হোটেলে সম্পর্কে কোথায় কি আছে, রেস্টুরেন্ট বা বার কোথায় কয়টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। আমাদেরকে শুধু একটা চাবি দেয়া হয়েছিল।

বাড়তি আরেকটা চাবি দেওয়া সম্ভব কিনা জানতে চাইলে অভ্যর্থনাকারী জানালেন, নিরাপত্তার জন্য দুইটা চাবি দেওয়া হয় না। তবে অভ্যর্থনা কেন্দ্র ২৪ ঘণ্টায়ই খোলা থাকে। ফলে সমস্যা হবে না।

ভোরে উঠে হাঁটতে যাওয়া আমার অভ্যাস। দ্বিতীয় চাবি না থাকলে সমস্যা হয়। যখন আমি বাইরে থেকে ফিরে আসি অনেক সময় রুমে যদি কেউ না থাকে অথবা ঘুমিয়ে থাকলে দরজা টোকা দিয়ে ওঠাতে ভাল লাগে না। ছুটি কাটাতে এসে কারো ঘুম ভাঙাতেও আমার ভাল লাগে না। এই কারণেই আসলে দ্বিতীয় চাবির প্রয়োজন অনুভব করেছিলাম। তাছাড়া বিশেষ করে অবকাশের সময়ে আমি কখনও সকালে বিছানায় পড়ে থাকিনা। ভোরের সূর্য সূর্যোদয়, সকালের মুক্ত হাওয়া ও দুর্লভ সৌন্দর্য আমি হারাতে চাইনা কখনও, কারণ এই দেশে আর কখনও আসা হবে কিনা জীবনে তার ঠিক নেই। তাই কম সময়ে যতটা বেশি উপভোগ করা যায়।

ঘর থেকে সরাসরি সমুদ্র দেখা যাচ্ছিল। অপূর্ব দৃশ্য। এর আগে আমি ভূমধ্যসাগর দেখিনি। এই প্রথম। আমরা সবাই খুবই খুশি ছিলাম। অবশ্য আমরা এভাবেই নিবন্ধিত ছিলাম যে আমাদের ঘর থেকে সরাসরি সমুদ্র দেখা যাবে। এজন্য আমাদের খরচও বেড়েছে। কিন্তু ঘুমাতে যাওয়ার আগে সমুদ্রের ঢেউ দেখা, আর সমুদ্রের ঢেউ দেখে ঘুম থেকে ওঠা এর মজাই আলাদা।

আমরা ঘরে পৌঁছানোর ৫ মিনিটের মধ্যেই আমাদের জিনিসপত্র নিয়ে বাহক হাজির হলেন। তাকে বিদায় করে আমরা হাতমুখ ধুয়ে কেউবা গোসল করে প্রস্তুত হয়ে রেস্টুরেন্টের দিকে গেলাম রাতের খাবারের জন্য। বাংলাদেশের সাথে অনেক মিল থাকলেও সাইপ্রাসে ধূলাবালি নেই বাতাসে বললেই চলে। 

রাতের খাবার পর আমরা হোটেলের বারে বসে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম। আড্ডা দিয়ে রুমে ফিরে এক ঝামেলায় পড়তে হল, সাইপ্রাসের ইলেকট্রিক সকেটগুলো ছিল তিন ছিদ্রযুক্ত। অতএব আমাদের সঙ্গে যেসব বৈদ্যুতিক সরঞ্জামগুলো ছিল কোনওটাতেই চার্জ দেয়ার জন্য বা ব্যবহারের জন্য  এর মধ্যে ঢোকানো সম্ভব হচ্ছিল না। চিন্তায় পড়ে গেলাম যদি কোন যন্ত্রপাতি কাজ না করে তাহলে ৭/৮  দিনে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। ছুটলাম অভ্যর্থনা কেন্দ্রে তাদেরকে সমস্যার কথা জানালাম। ওরা বলল- এটা কোন ব্যাপার না আমাদের এখানে ইংল্যান্ডের মত পদ্ধতিতে চলে সবকিছু। যারা ইউরোপের অন্যদেশ থেকে এসেছেন তাদের একটু সমস্যা হয়। ৫ ইউরো জমা রেখে আমাকে একটা অ্যাডপ্টার দিয়ে দিল।

এই অ্যাডপ্টারের মধ্যে আবার ল্যাপটপের প্লাগ ঢুকছিল না। পরের দিন অবশ্য অন্য একটা অ্যাডপ্টার কিনে সে সমস্যার সমাধান হয়েছিল। রাতে অ্যাডপ্টার নেবার সময় আমি বারে এক বোতল জল চাইলে, আমাকে বলা হল আপনাদের কামরায় মিনি বারে জল রাখা আছে। আমি ওদের জানালাম এই গরমে সেটা যথেষ্ট না।

ওরা বললো- আপনি ঘরে চলে যান জল পৌঁছে যাবে। আমি ফিরে আসার কয়েক মিনিটের মধ্যেই জলের বোতল হাতে একজন হাজির।

আমি একটু অবাক হয়েছিলাম সেবা দেখে, এরা হোটেলের অতিথির হাতে জলের বোতল দিয়ে দেওয়া শোভন মনে করেনি। এর আগে যেসব হোটেলে অবকাশ যাপন করেছি তারা পানির বোতল হাতেই দিয়ে দিত। সাইপ্রাসে রাত দিনে তাপমাত্রার খুব বেশি হেরফের হয় না। এজন্য ওখানে আমাদেরকে জল গিলতে হয়েছে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি। রাতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ছাড়া ঘুমানো অসম্ভব।

ভোরের দিকে সাধারণত একটু ঠাণ্ডা হয়ে যাবার কথা কিন্তু ভোরে উঠে আমি যখন বারান্দায় গেলাম প্রথম বাইরের তাপমাত্রা অনুভব করার জন্য তখন গরমের ধাক্কা খেলাম। স্বাভাবিক কারণেই আমি শুধু শর্টস আর টি শার্ট গায়ে দিয়ে ক্যামেরা আর মুঠোফোনটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। হোটেলের পেছনদিক দিয়ে বেরোলে সমুদ্র পাড়, ডানে-বামে দু'দিকেই রাস্তা। আমি প্রথম দিন বাম দিকের রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করলাম। একের পর এক হোটেলগুলো দাঁড়িয়ে আছে। আস্তে আস্তে দেখলাম কিছু মানুষ বেরোনো শুরু করেছেন। কাউকে স্থানীয় মানুষ বলে মনে হল না। সাইপ্রাসে একটা নতুন ব্যাপার দেখলাম। কোনও কোনও জায়গায় সমুদ্রের মধ্যে পাথর ফেলে রাখা হয়েছে, ঢেউয়ের গতি কমিয়ে দেবার জন্য বোধহয়। কোন কোন জায়গায় দেখলাম আবার সাগরের ভিতরে চলে যাবার জন্য পাথর ফেলে একটু রাস্তা তৈরি করে রাখা হয়েছে।

প্রায় প্রত্যেকটা হোটেলই এরকম একটা রাস্তা করে রেখেছে। এরকম একটা রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে একজন মাছ ধরছিলেন বড়শি দিয়ে। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম মাছ কেমন ধরা পড়ে? আলাপ ভাল জমলো না। কারণ উনি ইংরেজি জানেন না। আর আমি গ্রিক ভাষায় শুধু কয়েকটা কয়েকটা বাক্য ছাড়া তেমন কিছু জানিনা। এই মাছ ধরার দৃশ্য মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে। অনেক পর্যটকও মাছ ধরেন। এদের মধ্য একজনের সাথে আমার কথা হয়েছিল।

ভূমধ্যসাগরে একরকম জলজ উদ্ভিদ জন্মে, যা পরবর্তীতে সমুদ্রপাড়ে এসে ভিড় জমায়। আবর্জনা স্তূপের মত সমুদ্রকূলে স্তূপাকারে পড়ে থাকে। প্রথম দেখে আমি একটু আশ্চর্য হয়েছিলাম এ আবার কিরে বাবা এত অপরিষ্কার। প্রথমে দেখলে কারো মনে হবে না যে এটা জলজ কোনও উদ্ভিদ। একেবারে অডিও ক্যাসেটের পরিত্যক্ত ফিতা ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। এগুলোকে আবর্জনা ভেবে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম যে এগুলো কী?

তারা জানালেন, ভূমধ্যসাগরের এটা একটা স্বাভাবিক চিত্র একধরনের জলজ উদ্ভিদ ঢেউয়ের সাথে আসে। বলল দু/এক দিন দেখলে তুমি অভ্যস্ত হয়ে যাবে। আবারও সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। শেষ হোটেলটা পার হবার পর সমুদ্রপাড়ে ছোটখাটো একটা গির্জা। তারপর হাঁটতে হাঁটতে সামনে গিয়ে দেখলাম বাচ্চাদের বড় একটা খেলার মাঠ যেখানে, হরেক রকম খেলার সরঞ্জাম এমনকি ঢাকা শিশু পার্কের মত একটা ‘নাগরদোলা’ দেখলাম।

এরপর সামনের দিকে একটা বড় ফাঁকা জায়গা পড়ল যেখানে কয়েকটা গাড়ি পার্ক করা দেখলাম। এখানে সমুদ্র সৈকত ঘটা করে সাজানো-গোছানো না। প্রাকৃতিকভাবে যেরকম সেরকমই রাখা হয়েছে। হরেক রকম নুড়ি পাথরের সমারোহ দেখলাম। কিন্তু সমুদ্র পাড়ের যেখান থেকে জল শুরু হয়েছে, ওখান থেকে ৫০মিটার বা তার বেশি সমুদ্র গভীরে পাথর ফেলে, একটা বাঁধের মতো করে দেয়া হয়েছে।

অন্যান্য দেশে এরকম ব্যবস্থা আমি কখনো দেখিনি। এখানে প্রচুর মানুষকে দেখলাম সাগরে সাঁতার কাটছে, গোসল করছে। কেউ কেউ গোসল সেরে চলেও গেল। এরা সবাই স্থানীয় বলে প্রথম দেখায় আমার মনে হয়েছিল এবং তাদের সঙ্গে কথা বলে পরে নিশ্চিতও হয়েছিলাম যে তারা সাইপ্রিয়ট। সকালে উঠে সমুদ্রে স্নান করে যে যার কাজে চলে যাবেন, পর্যটকদের মতো দীর্ঘ সময় সমুদ্র সৈকতে পড়ে থাকেন না এরা। সৈকতের বিভিন্ন জায়গায় দেখলাম নিরাপত্তা কর্মীদের জন্য নিরাপত্তা চৌকি আছে, যেখানে বসে তারা পাহারা দেন। যদি কখনো কারও সাহায্যের দরকার হয়, সাথে সাথে যেন ব্যবস্থা নিতে পারেন। তবে সমুদ্র সৈকতে যেসব সাইপ্রিয়টের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে এদের মধ্যে অধিকাংশই ইংরেজি জানেন না। আমি আমার ভাঙাচোরা কয়েকটা গ্রিক শব্দ দিয়ে ইশারায় তাদের সঙ্গে কথা বলেছি।

সাইপ্রিয়টরা এই বিশেষ জায়গায় গোসল করে এর অর্থ এই না যে হোটেল এর কাছে সৈকতের অংশ তাদের জন্য নিষিদ্ধ, তারা ব্যবহার করতে পারবে না। আইন অনুযায়ী সৈকতের কোনও অংশই ব্যক্তি মালিকানাধীন না এবং একজন সাধারণ মানুষ যে কোনও জায়গায়ই সাগরস্নান করতে পারে যদি সেটা সরকারিভাবে নিষিদ্ধ স্থান না হয়। তবে হোটেলের সাজানো চেয়ার শুধু সেই হোটেলের অতিথিরাই ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু সমুদ্রের পানিতে নামতে কেউ তাদেরকে বাধা দিতে পারে না।

বেলা বাড়ছিল আমি হোটেলের দিকে পা বাড়ালাম। ফেরার পথে গির্জাটাকে ভাল করে দেখে নিলাম। গির্জার ডানদিকে ভূমিতে মোজাইকের টিলার মত উপর লেখা ‘সানসেট পয়েন্ট অব সাইপ্রাস’।

একজনের সাথে কথা হল উনি জানালেন- এখান থেকে সূর্যাস্ত নাকি চমৎকার দেখা যায় এজন্য পাকাপাকিভাবে স্থানটাকে নির্দিষ্ট করা আছে। আমি তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম সূর্যাস্তের সময় ছবি তোলার জন্য এখানে আসতে হবে। গির্জার কাছের হোটেলটা চমৎকার সেখানে কিছু ছবি তুলছিলাম।

এমন সময় এক নারী এসে জিজ্ঞাসা করলেন- তুমি কি কিছু মনে করবে যদি আমাদের একটা ছবি তুলে দিতে বলি?

 আমি উত্তরে বললাম, ‘অবশ্যই না, আমার হাতে যথেষ্ট সময় আছে।'

তিনি জানালেন তার বরের সেদিন জন্মদিন। আমি ওদের কয়েকটা ছবি তুলে দিলাম। তাকে বললাম, দেখে নাও ছবি ঠিক আছে কিনা। মহিলা খুবই খুশি হয়েছিলেন।

বললেন- তুমি খুবই পেশাদার চিত্রগ্রাহক। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, আমি কখনোই পেশাদার চিত্রগ্রাহক না সবসময় শৌখিন, হয়তোবা তোমার ক্যামেরাটা পেশাদার তাই ভাল ছবি হয়েছে।

নারীদের সাথে এই ঢংয়ে কথা বললে আমার সাবেক বান্ধবী খুব ক্ষেপে যেত। যাহোক সেই ভদ্রমহিলার স্বামীকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নিলাম। সূর্যের তাপের সাথে সাথে পেটের খিদেও বাড়ছিল। হোটেল ফিরে প্রস্তুত হয়ে আমরা সবাই নাস্তা করতে গেলাম, নাস্তা সেরে আমরা হোটেলের অভ্যর্থনা কেন্দ্রে অপেক্ষা করছিলাম পর্যটন উপদেষ্টার জন্য।

আর আমাদের বাচ্চাটা বিরক্ত হচ্ছিল কখন সে সাঁতার কাটতে যেতে পারবে। পর্যটন উপদেষ্টা আসলেন। আমাদের বিভিন্ন প্যাকেজ সম্পর্কে ধারণা দিলেন। বললেন আপনারা গাড়িও ভাড়া নিতে পারেন। কিন্তু গাড়ি নিয়ে রাজধানী শহরে যাওয়া খুব সুখকর হবে না পার্কিং সমস্যার কারণে।

তবে তার চেয়েও বড় সমস্যা ছিল আমার স্ত্রীর জন্য। উনি বামদিক দিয়ে গাড়ি চালাতে অভ্যস্ত নন বিধায় ঝুঁকি নিতে রাজি হলেন না। আর আমি অবকাশে গাড়ি চালিয়ে ব্যস্ত থাকতে চাইনা। আমাকে সবকিছু উপভোগ করতে হবে তীক্ষ্ণভাবে। তা নাহলে সবার সাথে ভাগাভাগি করা যাবে না। আসলে এই ভাগাভাগি করার ব্যাপারটা আমার অবকাশে একটা চাপ তৈরি করছে আজকাল।

আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম পরেরদিন শুক্রবার বাসে নিকোশিয়া যাবার। এরপর আমরা সাঁতার কাটতে গেলাম। হোটেলে দুইটা পুল আছে সাঁতার কাটার জন্য একটা ভেতরে, একটা বাইরে। সাইপ্রাসেই প্রথম দেখলাম পানিতে নেমে ঠাণ্ডার ধাক্কা সামলাতে হল না। বাইরের পুলের পানি তো রীতিমত গরম। আর ভূমধ্যসাগরের পানির তাপমাত্রাও তেমন ঠাণ্ডা না, সমুদ্র স্নান এখানে বেশ আরামদায়ক। আটলান্টিকে সমূদ্র স্নান প্রচণ্ড একটা ঠাণ্ডার ধাক্কা সহ্য করতে হয়, সেটা আপনি যে দেশ দিয়েই নামেন না কেন আটলান্টিকের জলে।

(চলবে)

লেখক: তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন, জার্মানি।

ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক

ইমেইল: mfjoarder@yahoo.com

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!