টুকরো স্মৃতি: ‘চাপাবাজ’ ডেভিডকে ধরতে গিয়ে...

তখন সবেমাত্র দেশ থেকে নিউজিল্যান্ড গিয়েছি। শরীর থেকে তখনও দেশের গন্ধ যায়নি। কয়েকজন বন্ধু মিলে একটা বাসা ভাড়া করে থাকি।

নাইম আবদুল্লাহ, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Oct 2017, 06:57 AM
Updated : 5 Oct 2017, 06:58 AM

বন্ধুদের কাজ সকাল থেকে। শুধুমাত্র আমার কাজ বিকাল থেকে মধ্য রাত অবধি। তখনও ইন্টারনেট-মোবাইল তেমন একটা চালু হয়নি। দেশ থেকে যে কয়টা গল্পের বই নিয়ে এসেছিলাম সেগুলো কয়েকবার করে পড়া শেষ। গান ও কবিতার সব কটা ক্যাসেট মুখস্ত করে ফেলেছি।

বিকাল তিনটার কিছু আগে ডাক পিওন চিঠি বিলি করে। ওই সময় বাইরে এসে খুব আগ্রহ নিয়ে পিওনের জন্য অপেক্ষা করি। সে আমাদের চিঠির বাক্সে চিঠি না রাখলে মনে মনে গালি দিতাম।

একদিন চিঠির জন্য অপেক্ষা করছি। এমন সময় হাফ প্যান্ট ও হুডি পরা এক বৃদ্ধ হকার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আমার দিকে তাকিয়ে ভদ্রতা করে ‘হ্যালো’ বললেন। আমিও উত্তরে ‘হাই’ বললাম। উনি বাসায় বাসায় পত্রিকা বিলি করছেন। আমাদের চিঠির বাক্সের নিচে পত্রিকা রেখে যাওয়ার সময় হেসে বললেন, “তোমার বুঝি আজ  ডে অফ?”

আমি বললাম, “না, আমি বিকালের শিফটে কাজ করি।” আমরা নিজেদের নাম বলে পরিচিত হলাম। ভদ্রতা করে কিছু জিজ্ঞেস করতে হয়, তাই ডেভিডকে বললাম, “তুমি বুঝি এই এলাকায় পত্রিকা বিলি করো?”

ছবি: ইন্টারনেট

ডেভিড বললেন, “হ্যা, আজ  থেকেই এই এলাকায় শুরু করেছি। এই এলাকার হকার কাজ ছেড়ে দিয়েছে।”

কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম, “তাহলে আগে কোথায় কাজ করতে?”

“আমি গত বছর অকল্যান্ড বিদ্যুৎ বোর্ডের কনজুমার ডিরেক্টর থেকে রিটায়ার্ড করেছি। একটা কাজ খুঁজছিলাম। পরে এই পত্রিকা বিলির কাজটা পেলাম।”- বললেন ডেভিড।

আমি তাকে ‘সরি’ বলে প্রশ্নটা আবার করলে সে একই উত্তর দিলো। আমি ততক্ষণে নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে বিদেশেও বীর চাপাবাজ আছে।

আমি ডেভিডকে আরেকটু বাজানোর চেষ্টা করলাম। অকল্যান্ডে এসে শুনেছি, যারা খুব বড় পদ থেকে রিটায়ার্ড করে, তারা অনেকেই জেপি সার্ভিস দেয়। জেপি (জাস্টিস অব পিস) সার্ভিস অনেকটা আমাদের দেশের প্রথম শ্রেণির গেজেটেড অফিসারদের মতো। কাগজ-দলিল ইত্যাদি সত্যায়িত করার কাজ। 

বললাম, “দেখো, আমার কিছু কাগজপত্র ভেরিফাই করা দরকার। আমি তো এ দেশে নতুন এসেছি, তেমন কাউকে চিনি না।”

ডেভিড আবার আকর্ণ হেসে মাড়ি দেখিয়ে বললেন, “তুমি ঠিক লোককেই জিজ্ঞেস করেছো। ইউ আর লাকি। আমি নিজেই তো জেপি সার্ভিস দেই। তুমি আগামীকাল ১১টা নাগাদ বাসায় চলে এসো।” তারপর সে পকেট থেকে কাগজ-কলম বের করে তার বাসার ঠিকানা লিখে দিলো।

মনে মনে বললাম, ব্যাটা ডেভিড, তুমি আমাকে বোকা বানিয়ে বেশ মজা নিচ্ছো। যতই প্যারা আমাকে দাও না কেনো, আমিও তোমার চাপাবাজির শেষ দেখে ছাড়বো।

সকালে উঠে ইয়েলো পেইজ (স্থানীয়দের নাম, ঠিকানা ফোন নম্বর লেখা টেলিফোন বুক) দেখে নিশ্চিত হলাম যে ডেভিড ধুরন্ধর চাপাবাজ। কারণ, সেখানে তার লেখা নাম ঠিকানা হুবহু মিলে গেলো।

পরদিন ডেভিডকে এক হাত দেখানোর জন্য কাগজপত্র না নিয়েই তার ঠিকানায় ঠিক সময়মতো পৌঁছে গেলাম। বাসার কলিং বেল টিপতেই এক বৃদ্ধা দরজা খুলে বললেন, “গুড মর্নিং। আমি তোমার জন্য কী করতে পারি?” 

আমি নিজের নাম বলে ডেভিডের সাথে দেখা করতে চাইলাম। মনে মনে ভাবলাম, বাটপার ডেভিডের নাম ভাঙ্গিয়ে খাওয়ার অভ্যাসও আছে।

বৃদ্ধা আমাকে ড্রইং রুম দেখিয়ে বসতে দিয়ে চলে গেলো। অভিজাত ড্রইং রুমটা দামি ফার্নিচার আর নরম কার্পেটে মোড়া। আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ডেভিড পেছন থেকে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে সম্ভাষণ জানিয়ে বসতে বললেন। তারপর তার স্ত্রীকে ডেকে বললেন, “আমাদের এখানে দু’টো ড্রিংকস দিও।”

ছবি: ইন্টারনেট

আমি লজ্জিতভাবে কোনোরকমে বসলাম। আমার সারা মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছে দেখে ডেভিড চিন্তিতভাবে বললেন, “আর ইউ ওকে?” আমি তখন অপমানের হাত থেকে বাঁচার জন্য পালানোর পথ খুঁজছি।

ডেভিড বলে চলেছেন, “জানো, আমি রিটায়ার্ড করার পর রিটায়ার্ডমেন্টের টাকা ও আমার স্ত্রীর কিছু জমানো টাকা একসাথে করে বাড়িটা এই বছরই কিনেছি। সারা জীবন আমরা দু’জন একটা ছিমছাম বাড়ি কেনার স্বপ দেখতাম। কিন্তু সেজন্য আমাদের রিটায়ার্ডমেন্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।”

আমি তখন ভাবছি আমাদের দেশের বড় কর্তাদের কথা। দেশে-বিদেশে নামে-বেনামে তাদের বাড়ি-গাড়ির কথা। এক সময় ডেভিড আমার কাঁধে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললেন, “কই কাগজগুলো দাও?”

আমি সম্বিত ফিরে পেয়ে লজ্জিত ভঙ্গিতে বললাম, “আমি আসার সময় তাড়াহুড়ো করে সার্টিফিকেটগুলো আনতেই ভুলে গেছি। কথাটা বলার পরেই পালানোর একটা রাস্তা খুঁজে পেয়ে উঠে দাঁড়িয়েই বললাম, “আজ  উঠছি। কাগজগুলো নিয়ে অন্য একদিন আসবো।”

এই বলে আমি তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম। গেটের কাছে এসে পেছন ফিরে দেখলাম, ডেভিডও অবাক ভঙ্গিতে আমার পিছু পিছু আসছে।

রাস্তায় এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। রাস্তায় তখন তেমন গাড়ি কিংবা লোকজন ছিলো না। তারপরও আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে হাঁটছিলাম। মনে হচ্ছিলো, আশেপাশের গাড়িগুলো থেকে সবাই আমার লজ্জিত মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

লেখক: সিডনি প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক

ইমেইল: naiem.abdullah65@gmail.com

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!