জাপানে আমার দীর্ঘ ২৬ বছরের প্রবাস জীবনে কিয়োটো কয়েকবারই গিয়েছি। এবার গিয়েছি অন্য এক কারণে।
Published : 24 Aug 2017, 10:56 AM
ভাবলাম কিয়োটো যাবো, অনেক নতুন মুখের দেখা হবে, পরিচয় হবে, হবে সম্পর্কও। তাদের বলা যাবে, আমার জাপান প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটির অনলাইন পত্রিকা ‘বিবেকবার্তা’র কথা। সেখানে তাদেরকে দেওয়া যাবে আমার লেখা বইও।
টোকিওতে প্রতি সপ্তাহান্তে একাধিক অনুষ্ঠান থাকে। এক মুখ-এক বক্তব্য দেখতে দেখতে কিছুটা হাওয়া বদলানোর ইচ্ছে বেশ কিছুদিনের। এরই মধ্যে কানসাই-বাংলাদেশ সোসাইটির সভাপতি মো.নিজাম উদ্দিন ফোন দিয়ে বললেন, এবার ছুটিতে তাদের ওখানে অনুষ্ঠান আছে। পারলে আমি যেনো তাদের সাথে অনুষ্ঠানে অংশ নেই।
মনে মনে ভাবলাম, এমনিতেই আমি যাবার কথা চিন্তা করছিলাম। এর মধ্যে বাংলাদেশি কানসাইবাসীদের অনুষ্ঠানও আছে যেহেতু, ভালোই হলো। এক যাত্রায় দুই-তিন কাজ সেরে আসা যাবে।
বাসা থেকে আগেরদিন ১১ অগাস্ট আমি রওনা দিলাম। সফরসঙ্গী করলাম ফটোগ্রাফার সহিদুল হককে। তার গাড়ি নিয়েই আমাদের রওনা দেওয়া। মাঝ পথে একদিন সিজোওকা প্রিফেকচারের হামামাৎস্যু বেড়ালাম। সেখান থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তায় একস্থানে তাবু গেড়ে রাত কাটালাম।
এরপর সকালে ঘুম ভাঙলে রওনা দিলাম নীচের পথ ধরে। যেতে যেতে একসময় মনে হলো, পথ আর যেন শেষ হচ্ছে না। মূলত আমরা খরচ বাঁচানোর জন্য নীচ দিয়ে যেতে শুরু করলে মাঝ পথে যেতে মনে হলো, যে উদ্দেশ্যে কিয়োটো যাচ্ছি তাই যদি না পাই, তাহলে কোন লাভই নেই যে গিয়ে। তাই তারাতারি করে হাইওয়েতে চড়ার রাস্তা খোঁজ করলাম।
হাইওয়েতে উঠার আগে দেখতে পেলাম, দূরে ধান ক্ষেতের মাঝখানে একটা লাল হেলিকপ্টার দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার ধারে গাড়ি থামিয়ে চলে গেলাম সেখানে। হেলিকপ্টার কেন সেখানে থামানো, তা জানার জন্য। ভাবলাম আমাদের ভ্রমণকে আরো বেশি সফল ও আনন্দদায়ক করতে হেলিকপ্টারে চড়তে হবে।
চড়ার আগ্রহ জাগলো অন্য কারণে। সবাইকে বলা যাবে, জাপানেও হেলিকপ্টারে চড়েছি।
তাছাড়া আমাদের আজকের এই ভ্রমণ সম্পর্কে লিখলে লেখার মধ্যে বিষয়টি যোগ করতেই ছুটে যাওয়া। দেশে আমি জাপানিজ টেলিভিশনের জন্য একটি চলন বিলের উপর প্রামাণ্যচিত্র করেছি। তখন কাজ করার সুবিধার্থেই আমাকে হেলিকপ্টারে চড়ে কাজ করতে হয়েছে। সুতরাং জানা আছে হেলিকপ্টারে চড়ার আনন্দ।
হেলিকপ্টারের কাছে গিয়ে দেখি স্কুলের ছেলেমেয়েদের সেটা প্রদর্শন করা হচ্ছে। আমার পরনে ছিল লুঙ্গি আর গলায় গামছা। সেই পোশাকে হেলিকপ্টারের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই খেয়াল করলাম, কেউ কেউ হেলিকপ্টার না দেখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তখন লজ্জা নয়, মনে মনে গর্ববাধ করলাম আমার দেশের পোশাকের।
সুযোগ করে জেনে নিলাম, সেটা অ্যাম্বুলেন্স হেলিকপ্টার। থেমে না, থামিয়ে রাখা হয়েছে ছেলেমেয়েদের দেখানোর জন্যই। সেটার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। ছবি তোলার পর চড়ে বসলাম সেটাতে। পাইলটকে এবার বললাম, চালাও ভাই। থেমে আছো কেন?
আবার ফিরে এসে জানতে চাইলো আমাদের দেশ সম্পর্কে। কোথায় আছি, কী করি, যাচ্ছি কই ইত্যাদি। এসব এমনিতেই কথা জমানোর জন্য মাত্র আলোচনা করা। সেখানে বেশি দেরি করিনি আর আমরা। চলে গেলাম গাড়ির কাছে।
কিছু সময় পর হাইওয়েতে উঠে দেখি, যে জন্য হাইওয়েতে উঠা, তার উল্টো চেহারা এখানে। হাইওয়েতে ঢাকার রাস্তার মতনই ভিড় লেগে আছে। জাপানে এ সময় লম্বা ছুটি। সবাই যে যার মতো করে নিজেদের স্থায়ী ঠিকানার দিকে রওনা হয়েছে। গাড়িতে স্পিড আর বাড়াতে পারছিলাম না। খুব ধীর গতিতে গাড়ি এগোচ্ছে।
ফোন দিলাম রুমীকে। বললাম, ১২টা বেজে যাবে পৌঁছতে। খুব বেশি হলে সাড়ে ১২টা। উত্তরে বলল, আসেন। আমরা যেতে থাকলাম। সহিদুলের সাথে বলাবলি করছি গাড়ির নেভিগেটর নিয়ে। হাইওয়েতে উঠার আগে নেভিগেটর মাথা খারাপ করে দিয়েছিল। মাঝে মধ্যে এই নেভিগেটর এমনটাই উল্টাপাল্টা করে যে, মনে হয় সব ভেঙ্গে চুরে গাড়ি থামিয়ে রাস্তার মাঝখানে বসে থাকি। আজকেও তেমনটাই হলো।
গাড়ি থেকে নামার আগেই দৌড়ে আমার সামনে এসে প্রশ্ন করলেন, ভাই আপনি এখানে? এই এলাকায় থাকেন নাকি? বললাম, না, এখানে বাংলাদেশিদের বারবিকিউতে আসলাম। আমার কথা শুনে যেন স্বস্থির নিশ্বাস ছেড়ে বললেন, চলেন তাহলে হাঁটা ধরি। এখান থেকে সোজা লেকের দিকে হাঁটলে ওদের পাওয়া যাবে বলল।
নাম তার মাসুম। থাকেন টোকিও। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হয় প্রায়ই। পেয়ে ভালো লাগছে। সহিদুল গাড়ি পার্কিং করতে রয়ে গেলেন। আমরা হাঁটতে শুরু করলাম লেকের দিকে। এদিকে আমার সেল ফোনে চার্জ নেই, পুরোটাই অকেজো। সেল ফোন অফ থাকলে আমি মনের দিক থেকে আধা মরা হয়ে যাই যেনো। কোন কিছুই আর ভালো লাগে না তখন। এবারেও তাই হলো।
বন্ধ সেলফোন হাতে নিয়ে মন খারাপ করে হাঁটতে থাকলাম। আমরা যেদিকে যাচ্ছিলাম, সেদিকে মানুষ লাইন দিয়ে লেকের দিকে হাঁটছিল। সামনে গিয়ে দেখি ছেলে-মেয়ে সবার গায়ের অর্ধেক কাপড় খোলা। ছেলেদের থেকে মেয়েরাই কাপড় খোলায় যেনো এগিয়ে। এখানে এটি তেমন কোন বিষয় নয়। ওদের সাগর বা লেকের পানিতে নামার কালচার বলা যায়।
কষ্ট করে হাঁটছি আর কাপড় খোলা মেয়েদের দেখতে দেখতে কানসাইবাসীদের আয়োজন স্থল খুঁজছিলাম। একসময় পেয়েও গেলাম। এক সাথে অনেক বাংলাদেশি দেখে বুঝতে আর কষ্ট হয়নি, এটাই কানসাইবাসীদের আয়োজন।
বিদেশ-বিভূঁইয়ে এভাবে এক সাথে দেশের এত বাংলাদেশি দেখে অনেক ভালো লাগে। মনে হয়, দেশের বাইরে যেনো আরেক বাংলাদেশ। গিয়েই দেখা হলো কানসাই-বাংলাদেশ সোসাইটির সভাপতি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মো.নিজাম উদ্দিন এবং সংস্কৃতিকর্মী খন্দকার রুমীর সাথে।
কয়লার চুলায় আগুন জ্বালিয়ে মাংস পুড়ছে আর রুটি গরম করছিলেন সবার জন্য। কেউ কেউ সেখানে লাইন দিয়ে খাবার নিচ্ছিলেন। আমি যাবার পরপরই নিজাম ভাই কথা না বলেই বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। কোন বিষয়েই কথা হলো না তার সাথে। যদিও আমাকে আগেই বলেছিলেন, প্রোগ্রাম শুরু করে দিয়েই চলে যাবেন অন্যত্র। তাই বিষয়টিকে আমি অন্যভাবে নেইনি।
পেটে তখন ক্ষুধার জ্বালা। সকাল থেকে পেটে কিছু পরেনি। আমি কিছুটা লজ্জা ভেঙে খাবার আনতে এগিয়ে যাবো ভাবছিলাম, তখনই কয়েকজন কাছে এসে আমার হাতে কাগজের প্লেট দিয়ে খাবার নিতে অনুরোধ করলেন। আমি খাবার নিয়ে খেয়ে নিলাম। একবার-দুইবার-তিনবার, পোড়া মাংস এবং স্প্যাগেটি।
খাবার শেষে সেখানে পানি খেলাম। পানি খেয়ে পানির প্রশংসা করলাম। বোতলে ভরা পানি, তার স্বাদ এবং গন্ধ ছিল ভিন্ন রকম। বলতে পারি, জাপানে এতো স্বাদের পানি আমি এই প্রথম খেলাম। ভাবছি কানসাই এলাকাতেই এই পানি শুধু পাওয়া যায় কিনা? টোকিওতে পেলে নিশ্চয়ই এর মধ্যে খাওয়া হতো কিংবা জানা হতো এর স্বাদ সম্পর্কে।
কাছেই আমার সামনে একজন তরমুজ কাটলেন। আমার প্রিয় ফলের একটি এই তরমুজ। তরমুজ খাবার সময় সবসময় আমি আমার মায়ের কথা স্মরণ করি। মায়ের খুব প্রিয় এই তরমুজ। তরমুজ খেয়ে সবাই একে একে লেকের পানির দিকে যাচ্ছিলেন। কেউ কেউ তখন নিজেদের মধ্যে লেকের পানিতে সাঁতার কেটে আনন্দ করছিলেন। লেক হলেও এটি সাগরের চেয়ে কম দেখায় না। গোসল করে পাড়ে ঘুরে বেড়ানো বিকিনি পরাদের সাথে মজা করে একাই ঘুরে ঘুরে আবার চলে গেলাম স্পটে।
এতোক্ষণে নিজে থেকে পরিচয় হলাম হেলাল ভাইয়ের সাথে। উনি বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন দেখে আমি তাকে আমার দু’টি বই দিলাম। খুব খুশি হয়ে বইয়ের মূল্য পরিশোধ করতে চাইলে বললাম, এটা সৌজন্য কপি। বই পেয়ে বললেন, বই পড়তে খুব পছন্দ করেন। জাপানে এই বই পড়া লোকের সংখ্যা যেন কেবল গুণতে শুরু করলাম হেলাল ভাইকে দিয়ে।
তখনই পরিচিত এক ভাবি আমাকে দেখে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, “আরে ভাই, আপনি এখানে? কেমন আছেন? আপনার বই আমি পড়েছি।” ভাবির সাথে কথা বললাম। ভাবিরাও তখন চলে যেতে বিদায় জানাচ্ছিলেন রুমীর কাছ থেকে। ভাবিকেও আমার ‘নিশি গুচি পার্ক; বই উপহার দিয়ে চলে গেলাম গাড়িতে। আশেপাশে সেল ফোন চার্জ দেবার কোনো ব্যবস্থা আছে কিনা খুঁজলাম, পেলাম না।
এরপর গাড়িতে জামা পরিবর্তন করে আবার চলে গেলাম বাংলাদেশিদের আয়োজন স্পটে। যাবার সময় এক দোকানে অনুরোধ করে বললাম, সেল ফোনে একটু চার্জ দিতে সহযোগিতা করতে। দোকানী রাজি হলে আমি সেল ফোন রেখে স্পটে চলে গেলাম। গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। এরপর একাই আবার লেকের পাড় ঘেঁষে বালির উপর হাঁটাহাঁটি করি।
এখানে বালির উপর হেঁটে মনে হলো, বালি বেশ বড়। অনেকটা পায়ে লাগে। লেকের পানি বেশ পরিষ্কার। ঢেউ নেই। ছেলেমেয়েরা ওয়াটার বাইক নিয়ে দূরে বেশ মজা করছে। পাড় ঘেঁষে পুরোটা সবুজ ঝাউ গাছ। মনোরম পরিবেশ। গাছের ফাঁক-ফোকর দিয়ে সূর্যের আলো ঢুকছে। পুরো পাড়ে কোথাও মেয়েরা বিকিনি পরে প্লাস্টিকের শিট বিছিয়ে শুয়ে আছে। ছেলেরা পাশে মাংস পুড়ে খাচ্ছে বা নাচানাচি করছে।
ঘুরে ঘুরে লেক সম্পর্কে কিছুটা তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করলাম। লেকের নাম ‘বিওয়া লেক’। জাপানের এদো পিরিয়ডের সময়কাল (১৬০০-১৮৬৭) থেকে এই ‘বিওয়া লেক’ খুব বিখ্যাত। এই লেকের বিশেষত্ব হচ্ছে, সাগরের সাথে এই লেকের সরাসরি সংযোগ থাকলেও এর পানি লবণাক্ত নয়। এটি জাপানের সবচেয়ে বড় মিঠা পানির লেক হিসাবে বেশ জনপ্রিয়।
আমরা যে প্রান্তে ছিলাম, তার উল্টোদিকের পরিবেশ অনেকটা শহর শহর মনে হচ্ছিলো। আগে এখানে তাবু টানিয়ে থাকা যেতো। আজকাল আর সেই সুযোগ নেই। ৯টার মধ্যেই লোকজন সবাইকে স্থান ছেড়ে চলে যেতে হয়।
বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে সন্ধ্যার সময় ছেলেমেয়েদের নিয়ে ফায়ার ওয়ার্কস করার প্রস্তুতি চলছিল। বাংলাদেশিদের মধ্যেও তাই চলছিল। তার আগে উপস্থিতিদের মধ্যে লটারি ড্র-র ব্যবস্থা করা হলো। লটারি ড্র দেখার জন্য সকলেই প্রায় বেশ আনন্দ উত্তেজনায় রয়েছে যেনো। আমার সেখানে অংশ নেওয়া সম্ভব না থাকায় আমি ওদের ছবি তুলে ক্ষ্যান্ত রইলাম। রাত ৮টা পর্যন্ত চলল ফায়ার ওয়ার্কস। সব কিছু শেষ করে পরিচিতদের সাথে হাত মিলিয়ে বিদায় নিয়ে রওনা দিলাম সভাপতি নিজাম উদ্দিন সাহেবের বাসার দিকে।
এখানে উপস্থিতদের মধ্যে যাদের নাম না নিলেই নয় তারা হলেন- সৈয়দ জাহিদুর রায়হান, সিরাজুল ইসলাম, এস এম আরশাদুল হক, রাসেল রহমান চৌধুরী, মাহবুব রশীদ মিঠু, কামরুজ্জামান দুলু, আবুল কালাম আজাদ, গুলজার হোসাইন, রাশেদ মাহমুদসহ অন্যরা। এখানে সবাইকে প্রায় আমার বই দিলাম। সবাই আমার লেখা বই পেয়ে বেশ খুশি হলেন।
রুমীদের গাড়ি সামনে। আমরা তাদের ফলো করছি। হঠাৎ দেখি গ্যাসোলিনের ট্যাংকি খালি। লাল বাতি জ্বলছে। রুমীকে কয়েকবার জানালাম, আশেপাশে গ্যাসোলিন স্ট্যান্ড থাকলে যেনো থামায়। মনে হলো সে আমাদের কথা বুঝতেই চাইছে না। অবস্থা বেগতিক দেখে আমরা তখনই সুযোগ পেয়ে হাইওয়ে থেকে নেমে পড়লাম। নামতেই সামনে পড়লো গ্যাসলিন স্ট্যান্ড।
তাড়াতাড়ি করে আমরা সেখানে ঢুকে পড়লাম। গ্যাসোলিন নিয়ে আবার রওনা দিলাম সামনের দিকে। এবার আর হাইওয়ে নয়, নীচ দিয়ে। যেতে যেতে রুমীর কাছে নিজাম উদ্দিন সাহেবের অফিসের ল্যান্ড ফোন নম্বর চেয়ে নিয়ে তা নেভিগেটরে সেট করে আবার দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাতে থাকলাম। প্রায় বিশ মিনিটের পথ যেতেই পেয়ে গেলাম নিজাম উদ্দিন সাহেবের অফিস।
অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে রুমী আর দু’জন নতুন ছাত্র ফজলে বারি ও মো.ফকরুল ইসলামের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এমন সময় নিজাম উদ্দিন সাহেব এসে দ্রুত তাকে অনুসরণ করে সামনে যেতে বললেন। তার গাড়ির গতির সাথে তাল মেলাতে কষ্ট হয়নি। সামনে পেছনে তিনটি গাড়ি আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে যেতে থাকলাম। এক পর্যায়ে মনে হলো, তার বাসার কাছ দিয়ে আমরা যাচ্ছি।
অনেক আগে একবার আমার ছেলে থাইও (সূর্য)-কে নিয়ে এসেছিলাম এখানে তার বাড়িতে বেড়াতে। ছেলেকে বেশ আদর-যত্ন করেছিলেন নিজাম ভাই এবং তার পরিবার। সে কথাই মনে পড়লো আমার তখন। আরেকটু সামনে গিয়ে সোজা উঠে গেলেন পাহাড়ে। আমরা বলাবলি করছিলাম, নিজের বাসাও কি ভুলে গেলেন কিনা! যেহেতু এখানে আসতেই আমি তার বাড়ির লোকেশন মনে করতে পেরেছি, তাই। বলতে বলতে এক পার্কিং-এ নিয়ে গাড়ি থামালেন। আমরাও গাড়ি থামালাম।
গাড়ি থেকে নামতেই বুঝতে পারি, আশেপাশে যে বাঙালিদের কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে। জোরে কথা বলায় বুঝতে সমস্যা হয়নি। সেখানে কাছেই এক জঙ্গল এলাকায় নিজাম ভাই আমাদের নিয়ে গেলেন। গিয়ে দেখি, সেখানে সত্তর-আশি জনেরও বেশি বাংলাদেশি বেশ হৈ-হুল্লোর করছেন।
কাছে যেতেই কয়েকজন এগিয় এসে আমার কুশলাদি জানতে চাইলেন। এদের মধ্যে মোহাম্মদ লুৎফর রহমান মাসুম ভাই দেখেই আমাকে বললেন, আমি আপনাকে চিনি। বুঝতে আর কষ্ট হয়নি, এখানেও যে আমার পরিচিত কয়েকজন আছেন। এটা দেখে সহিদুল হক বললেন, আপনার তো দেখছি জাপানে ভালোই পরিচিতি আছে। যেখানে যান, সেখানেই কেউ না কেউ আপনাকে চিনেন। সহিদুলের কথা শুনে আমি হাসলাম।
নিজাম ভাই সবার সাথে আমাদের দু’জনকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করতে বললে। আমাদের জন্য এতো রাতে আবার খাবার তৈরি করলেন রাসেল রাসেল রেহমান চৌধুরী ভাই। আমরা রাতের খাবার খেয়ে গাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। রুমী ডেকে নিয়ে গেলো আবার সকলের সাথে আনন্দ করতে।
সারা রাত প্রায় সকলে লুডু খেলা, কার্ড খেলা, গান গাওয়া- যে যেভাবে পারছিলো সেভাবেই আনন্দ-উল্লাসে মেতেছিলেন। এখানে সকলেই প্রায় ছিলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র এবং গবেষক। ভিন্ন পেশারও ছিলেন কেউ কেউ। এত বাংলাদেশিকে এখানে এতটা সুশৃংখলভাবে ছুটির সময় কাটাতে দেখে সত্যিই মুগ্ধ হলাম। কারণ, সকলেই এখানে এসেছিলেন এক সাথে সামার ভ্যাকেশন কাটাতে।
নিজেদের মধ্যে নিজেরা সব কিছু ভাগ করে রান্নার কাজ, পরিষ্কার করার কাজ, খাবার পরিবেশনের কাজ করছিলেন। তাদের সবার রবিবার বিকাল পর্যন্ত থাকার কথা থাকলেও আমরা দু’জন কিয়োটো স্বর্ণ মন্দির দেখার উদ্দেশ্যে বিদায় নিয়ে চলে গেলাম।
রাসেল ভাই বেশ আন্তরিকতার সাথে বললেন, “আপনাদের জন্য বিরিয়ানী তুলে রাখা হবে, ফিরে এসে খাবেন কিন্তু।” আমি সম্মানার্থে সম্মতি দিয়ে বললাম, অবশ্যই ফিরে এসে আপনাদের সাথে বসে বিরিয়ানী খাবো। এরপর রওনা দিলাম কিয়োটো স্বর্ণমন্দির দেখতে যাবার উদ্দেশ্যে।
এখানে এসে যাদের সাথে পরিচয় হলো, তারা হলেন- কামরুজ্জামান দুলু, রাসেল রহমান চেীধুরী, কালাম আজাদ, মাহমুদা আজাদ, গুলশান পারভিন, শিবলী সাদিক, ফয়সাল শ্রাবণ, মিজানুর রহমান, সাঈদা দিনা, জুহেলী নাজনিন, তোবা, যাদবসহ আরও অনেকে। আর গ্রুপটির নাম কিয়োটো বাংলাদেশি কমিউনিটি। এখানেও সবাইকে প্রায় আমার বই উপহার দিলাম।
পি.আর. প্ল্যাসিড: জাপান প্রবাসী লেখক
এই লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন। |