গত ১৬ এপ্রিল টোকিওর প্রাণকেন্দ্র তোশিমা সিটির ইকেবুকুরো নিশিগুচি পার্কে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো ‘বৈশাখী মেলা- ১৪২৪’।
জাপানে বসবাসকারী প্রতিটি বাঙালির কাছে টোকিও’র বৈশাখী মেলা অনেক কাঙ্ক্ষিত একটি উৎসব। নববর্ষকে নবরূপে বরণ করার জন্য জাপানের বিভিন্ন স্থান থেকে দলে দলে সব প্রবাসী বাঙালিরা ভীড় করে টোকিওর নিশিগুচি পার্কে। নিশিগুচি পার্ক হয়ে ওঠে রমনার বটমূল। সকল বিভেদ ভুলে, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে, সব ধর্মাবলম্বীর মানুষেরা মিলিত হন এক আকাশের ছায়াতলে। চারিদিকে বেজে ওঠে বাংলা নববর্ষের গান-
“এসো হে বৈশাখ... এসো এসো..”
দেশে যখন নতুন বছরকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য চলে নানা আয়োজন, তখন প্রবাসে বসে বাঙালি প্রবাসীরা প্রিয় স্বদেশে ফেলে আসা নববর্ষের উৎসবের স্মৃতিকে হৃদয়ে ধারণ করে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। শিকড় ছেড়ে আসা মানুষগুলোকে বৈশাখ যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। রমনার বটমূল, পান্তা-ইলিশ, মিষ্টি-মণ্ডা, বৈশাখী মেলা, আরও কত কী যে বুকের পাঁজরে আটকা পড়ে থাকে প্রবাসীদের!
ঐতিহ্যবাহী শাড়ি অঙ্গে জড়িয়ে,খোঁপায় ফুল, দু’হাত ভরা রিনিঝিনি চুড়িতে বাঙালি নারীরা ভিনদেশের মাটিকে বাংলাদেশে পরিণত করেন। পাশাপাশি পুরুষেরাও দেশিয় ঐতিহ্যকে বিদেশের মাটিতে উপস্থাপন করেন পাঞ্জাবী পরিধান করে। শিশুরাও বাদ পড়ে না স্বদেশী ঐতিহ্যের ছোঁয়া থেকে।
রোববার জাপানে সরকারি ছুটি থাকায় রাজধানী টোকিওতে বৈশাখী মেলা সাধারণত ওইদিনই পালন করা হয়ে থাকে। এবারেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সকাল থেকেই দলে দলে প্রবাসী বাঙালিরা বর্ণিল সাজে মেলায় আসতে শুরু করেন। এ যেন বাঙালির মিলনমেলা!
সুদূর বাংলাদেশ থেকে আগত অতিথি শিল্পীরা যখন শিকড় ছেড়ে আসা মানুষগুলোর সাথে গানের তালে তালে মিলেমিশে একাকার হয়ে যান, তখন মনে হয়- সবাই যেন একই বঙ্গমাতার সন্তান। কারো মাঝে কোন ভেদাভেদ নেই।
ভিনদেশের মাটিতে বাঙালির এই প্রাণের মেলায় যে শুধু প্রবাসী বাঙালিরা উপস্থিত থাকেন, তা নয়। জাপানিরাও স্বত:স্ফূর্তভাবে অংশ নেন। মেলার অন্যতম আকর্ষণ- বাহারি পদের বাঙালি খাবার, যা বিভিন্ন স্টলে থরে থরে সাজানো থাকে। লোভনীয় এবং আকর্ষণীয় এসব খাদ্যদ্রব্য একদিকে যেমন ভোজনরসিক বাঙালিদের আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে রাখে, অন্যদিকে জাপানিসহ অন্যান্য দেশের মানুষদেরও নজর কাড়ে। আর সে কারণেই মেলা প্রাঙ্গনে খাবারের স্টলগুলোতে থাকে উপচে পড়া ভীড়।
একরাশ আনন্দ নিয়ে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করতে যাওয়া অনেক নারীই বাড়ি ফিরেছেন কিছু কুরুচিপূর্ণ মানুষের নোংরা স্মৃতি হাতে নিয়ে। যা কিনা ভবিষ্যতে এসব উৎসবে অংশগ্রহণের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এই বাঙালি নারীরাই ভিনদেশের মাটিতে কতোটা স্বত:স্ফূর্তভাবে প্রতি বছর মেলায় অংশ নিয়ে থাকেন। সকালে যে নারী হাসিমাখা মুখ নিয়ে মেলার উদ্দেশ্যে রওনা দেন, সে নারীই বেলাশেষে একরাশ মধুর স্মৃতি নিয়ে বাড়ি ফেরেন।
মেলায় যতই ভীড় থাকুক না কেন, এত ভীড়ের মাঝেও কখনও কোন নারীর আত্মসম্মানে আঘাত করা হয় না। বরং পুরুষেরাই যথেষ্ট সহযোগিতা করে থাকেন যেন একজন নারী মেলার আনন্দ পুরোপুরি উপভোগ করতে পারেন। ভিনদেশের মাটিতে একজন বাঙালি পুরুষই কিন্তু একজন বাঙালি নারীকে নিরাপত্তা দিয়ে আসছেন। অথচ দু:খজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে এমন চিত্র খুব একটা চোখে পড়ে না।
এ ব্যাপারে সরকারকেও সচেষ্ট হতে হবে। একটি দেশের পরিবেশ-পরিস্থিতি আর সুষ্ঠু আইনই পারে মানুষের অভ্যন্তরের বিবেকবোধকে জাগ্রত করতে। পারে সুন্দরকে আরও সুন্দর ও মনোরোম করে তুলতে।
প্রতি বছর এই বৈশাখী মেলা জাপানে বসবাসকারী হাজারও বাঙালিকে এক কাতারে সামিল করে। বৈশাখী মেলা প্রেম-ভালবাসা আর সৌহার্দের মিলনমেলা। এ মেলা সকল ভেদাভেদ ভুলে মানববন্ধন সুদৃঢ করবার এক চমৎকার ভালবাসার মেলা। আর এই প্রাণের মেলাকে সার্থক করতে যারা নিরলস পরিশ্রম করেছেন, তাদের এবং মেলার প্রধান সমন্বয়ককে জানাই প্রাণঢালা শুভেচ্ছা।
মেলায় আগত একজন দর্শনার্থী হিসেবে প্রত্যাশা করি, আগামীতেও যেন আমরা এমন উপভোগ্য একটি বৈশাখী মেলা উপহার পাই। সকল হিংসা-লোভ-গ্লানী দূর করে নতুন বছরে নতুন সূর্যের আলোয় আলোকিত হোক সবার জীবন। সবাইকে জানাই নতুন বছরের শুভেচ্ছা।
শুভ নববর্ষ ১৪২৪।
লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি
ই-মেইল: shaheen.akter999@gmail.com
এই লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |