ভালোবাসা দিবস: প্রেম করতে সাহস লাগে

বসন্তের হাওয়া লাগিয়ে আমার জীবনেও অনেক ১৪ ফেব্রুয়ারি বা ভালবাসা দিবস এসেছিলো। সময়ের স্রোতে অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে, কিন্তু রেখে গেছে প্রিয় কিছু স্মৃতি যা কখনই ভোলার নয়।

শাহীন আক্তার স্বাতী, জাপানের কানাগাওয়া থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Feb 2017, 07:30 AM
Updated : 12 Feb 2017, 08:00 AM

ভালবাসা দিবস এলে স্মৃতিরা ডানা মেলে উড়ে চলে যায় পুরনো সেই ফেলে আসা দিনগুলোতে। বহুদিনের ধুলো পড়ে থাকা অ্যালবামটা খুলে দেখি, আজও নতুনের মতো চির বসন্তের ডালপালা মেলে ভালবাসা প্রকাশ করে যাচ্ছে কোন এক প্রেমিক যুগল।

সময়টা ২০০৪। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ঐ সময়ে চারপাশে পাণিপ্রার্থীর অভাব ছিল না। হয়তো গোবেচারা টাইপের মেয়েদের তখন ছেলেরা একটু বেশি পছন্দ করতো। তাই আমার বিড়ম্বনাও কম ছিল না। চারদিকে এত এত রোমিওর আনাগোনায় জীবন যখন অতিষ্ঠ, তখন এলো ফেব্রুয়ারি মাস।

এই মাস ভাষার মাসের পাশাপাশি তরুণ সমাজের কাছে প্রেম-ভালবাসার মাস হিসেবে আসতো। এই বিশেষ দিনে নিজ স্বপ্নকন্যা বা পছন্দের মানুষকে প্রেম প্রস্তাব করতে অনেকেই ওঁত পেতে ছিলো। কিন্তু আধুনিক যুগের মেয়েদের মতো এত সাহস আমার কখনও ছিলো না।

যখনই কেউ প্রেম নিবেদনের চেষ্টা করতো, ভয়ে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যেত। তাদের ত্রিসীমানার পা রাখতাম না। আমার একটাই শপথ ছিলো, ছাত্রজীবনে কেবল মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করবো, প্রেম করবো না। আর একটা মস্ত বড় শপথ ছিলো, আর তা হলো- জীবনে কোনদিন কারো প্রেমপত্র পেলে তা আমি পড়ে দেখব না। কাজেই যখনই প্রেমপত্র হাতে পেতাম, না পড়েই ছিঁড়ে ফেলতাম।

এভাবেই চলছিলো। হঠাৎ ১২ ফেব্রুয়ারি ২০০৪, আমার এক বান্ধবী আমার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিল। খামের উপর এক মেয়ের নাম লেখা। বুঝতে পারলাম না। খুলে দেখলাম শিরোনামে লেখা ‘পরশু ১৪ ফেব্রুয়ারি’। কম্পিউটারে কম্পোজ করা রঙিন এক চিঠি। শুরুটা বুঝতে পারিনি। ভাবলাম, ভেলেন্টাইন ডে উপলক্ষে কোন ফ্যাশন হাউজের লিফলেট।

কিন্তু পড়া শুরু করার পর বুঝলাম ইহা একখানা জ্বলজ্যান্ত প্রেমপত্র! আমার শত জনমের শপথ মুহূর্তেই ভেঙে খান খান হয়ে গেলো। চিঠির ভাষা আর ভালবাসা প্রকাশের যে চরম প্রচেষ্টা, সেটাই আমাকে বাধ্য করেছিলো পুরো চিঠিটা গলঃধকরণ করতে। নামহীন কোন এক অজানা প্রেমিক তার ভালবাসার কথা জানিয়েছিলো চিঠিতে।

সেখানে সে আমাকে প্রথম দর্শনে ভালবেসেছিলো, সে কথা লিখেছিলো। আমাকে সে ভালবাসে এটা জানানোই তার উদ্দেশ্য। চিঠিতে আরো লেখা ছিলো- এ জন্ম কেন, পরজন্মেও নাকি আমাকে তার পাওয়া হবে না। সে আশাও নাকি সে করে না। আরো কতো কি আবেগঘন কথায় ভরা ছিলো সে চিঠির প্রতিটি লাইন!

চিঠি পড়ে চিন্তায় পরে গেলাম, কে এভাবে নাম না লিখে চিঠি লিখলো? চিঠিতে অবশ্য সে আমার ডিপার্টমেন্টের সেটা লিখা ছিলো। কিন্তু আমি আমার প্রতিজ্ঞায় অনড়, বিয়ের আগে কোন সম্পর্কে জড়াবো না।

চিঠির এক জায়গায় লেখা- ‘জানি দেখা হবে’। তাই ঠিক করলাম ১৪ তারিখ ভালবাসা দিবসে বিশ্ববিদ্যালয়েই যাবো না। যাইওনি।  আমার বাকি শিক্ষা জীবনে আর কখনই ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাইনি। তথাকথিত ভালবাসা দিবস আমার কাছে তখন ‘আতঙ্ক দিবস’ নামেই পরিচিত ছিলো।

আমার সেই পত্রলেখকের পরিচয় পরে জানতে পেরেছিলাম । কিন্তু সে আর কখনই ভালবাসার দাবি নিয়ে সামনে আসেনি। পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে দেশ ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিলো সুদূর প্রবাসে। আমিও প্রকৃতির নিয়মে আমার পড়াশোনা, চাকরি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

তবে সেই প্রেমপত্র আমি কোনদিন ফেলতে পারিনি। একাকী, নিঃসঙ্গ মুহূর্তে কতবার যে সেই চিঠি লুকিয়ে লুকিয়ে পড়েছি! চিঠির ভাষাগুলো আমি  মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়তাম। কাউকে কোনোদিন সে কথা বলিনি। মানুষটা তার মনের আবেগের কথা জানিয়ে এভাবে হারিয়ে যাবে ভাবিনি।

চিঠির শেষের কথাগুলো আমি বারবার পড়তাম, ‘একাকী, নিঃসঙ্গ মুহূর্তে যদি এই স্বল্পচেনা আমাকে ভেবে তোমার কিছুটা সময় ব্যয় হয়, তবে তা হবে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।’ কেন জানি মনে মনে খুব আফসোস করতাম, কেন সেদিন তাকে ফিরিয়ে দিলাম!

২০০৪ সালে তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিলো। আট বছর পর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আবারো আমাদের যোগাযোগ হয়। কেউ কাউকে ভুলিনি। মানুষটি হারিয়ে গিয়েও আমাকে মনে রেখেছিলো। আজ যখন ২০১৭ সালে এসে  ভালবাসা দিবস উপলক্ষে আমার অনুভূতির কথা লিখছি, তখন আমি সেই পত্রলেখকের দুই সন্তানের জননী।

মাঝে মাঝে ভাবি, ভাগ্য বিধাতার উদ্দেশ্য যদি আগেই জানতাম তাহলে কি আর সেই ১৪ ফেব্রুয়ারি বাসায় বসে থাকতাম? জীবনের কতগুলো বসন্ত একা কাটিয়ে দিয়েছি! ভালবাসা দিবসে পাশে কাউকে নিয়ে ভালবাসার রঙে মন রাঙাইনি। যোজন যোজন দূর হতে কেবল দুজন না পাওয়ার বেদানায় দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়েছি।

এখনও চিঠিটা আমার কাছে আছে। মাঝে মাঝে খুলে পড়ি। ভালবাসা দিবস এলে পুরোনো সেই স্মৃতি চাঙ্গা হয়ে ওঠে। প্রতিটি ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালবাসা দিবসে এখন আমরা একসঙ্গে কাটাই। সে আমাকে নানাভাবে সারপ্রাইজ দেয়।

ছোট্ট দুটো ছানা নিয়ে হেসেখেলে কেটে যায় আমাদের প্রতিটি দিন। আমাদের কাছে এখন আর ভালবাসা দিবস শুধু একটি দিনে সীমাবদ্ধ নেই। আমাদের কাছে প্রতিদিনই ভালবাসা দিবস।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!