সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতের জায়েদ সাসটেইনেবিলিটি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন তরুণ উদ্ভাবক মোস্তফা আল মোমিন।
Published : 30 Jan 2025, 02:53 PM
সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতের জায়েদ সাসটেইনেবিলিটি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন বাংলাদেশের তরুণ উদ্ভাবক মোস্তফা আল মোমিন। জামালপুরে জন্ম নেওয়া ৩৫ বছর বয়সী মোমিন পেশায় একজন তড়িৎ প্রকৌশলী। ঢাকার উত্তর বাড্ডায় তৈরি করেছেন বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ‘পালকি মোটরস’। বিশ্বের ১৫১টি দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বিচারকদের রায়ে জয় পায় তারা।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ানের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২০০৮ সাল থেকে জায়েদ সাসটেইনেবিলিটি অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য, খাদ্য, শক্তি, পানি ও গ্লোবাল হাই স্কুল- এ ক্যাটাগরিতে পুরস্কার দেওয়া হয় মনোনীতদের।
এবার এনার্জি ক্যাটাগরিতে বাণিজ্যিকভাবে বৈদ্যুতিক হালকা গাড়ি উদ্ভাবনের জন্য মোমিনের প্রতিষ্ঠান এক মিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্মানজনক এ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। গত ১৪ জানুয়ারি আবুধাবিতে ন্যাশনাল এক্সিবিশন সেন্টারে আয়োজিত অনুষ্ঠানে দেশটির প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের কাছ থেকে পুরস্কার নেন মোমিন।
সম্মাননা নেওয়ার পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মুখোমুখি হন তরুণ এ উদ্ভাবক।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: জায়েদ সাসটেইনেবিলিটি অ্যাওয়ার্ড পাওয়ায় আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
মোস্তফা আল মোমিন: সত্যি খুব ভালো লাগছে। এটা আমাদের কাজের বড় স্বীকৃতি। এক মিলিয়ন মার্কিন ডলার আমাদেরকে আরো গাড়ি তৈরি করতে সহায়তা করবে। স্বীকৃতি কার না ভালো লাগে। তবে এখানে অনেক দেশের প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান এসেছেন, আমাদের বাংলাদেশের যদি একজন কূটনীতিকও আসতেন, আরও বেশি ভালো লাগতো।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: আবুধাবি ন্যাশনাল এক্সিবিশন সেন্টারের মত একটি বৈশ্বিক ভেন্যুতে যখন বাংলাদেশের নাম ঘোষণা করা হলো বিজয়ী হিসেবে তখন আপনাকে দেখা গেল বাংলাদেশের পতাকা উঁচিয়ে ধরে বিজয়োল্লাস করতে, সে সময়টির কথা আরেকটু বলুন।
মোস্তফা আল মোমিন: সত্যি বলতে কি, এটা আমার জীবনে কোন একটা বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে প্রথম দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ। আমার জন্য এটা গৌরবের মুহূর্ত ছিল। এমন একটা প্রতিযোগিতায় যাকে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত কাজের ‘অস্কার’ বলা হয়, সেখানে সবাই আমার দেশকে নতুন করে জানছে, এটা আমার জন্য বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে ছিল অনন্য।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: এই অর্জনের পর আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
মোস্তফা আল মোমিন: এখানে যে টাকাটা পেলাম তাতে আরো বেশি করে গাড়ি বানাতে পারবো। এখন মাসে ত্রিশটা করে গাড়ি বানাই, এরপর ১০০ গাড়ি বানাতে পারবো। দক্ষ জনবল নিতে পারব, যাতে আমাদের মান বাড়ে। দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের বাজার ভেতরে অনেক বড়। এখন আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে সিএনজি চালকরা। থ্রি হুইলার সিএনজির বদলে তারা আমাদের এয়ার কন্ডিশনড গাড়ি চালাবেন। তারা সংখ্যায় ৬ লাখের মতো। আমরা প্রতিবছরে যদি ২০ হাজার গাড়ি বানাতে পারি, তারপরও আমাদের অনেক সময় লাগবে। আশা করছি ২০২৮ সাল নাগাদ আমাদের উৎপাদন ২০ হাজার ইউনিটে চলে যাবে। আমাদের মূল আইডিয়া গাড়ি বানানো নয়, মেশিন বানানো, যেটা পৃথিবীর যেকোনো দেশে রপ্তানি করতে পারব।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: ইলেক্ট্রিক ভেহিকলের (ইভি) মতো একটি সম্ভাবনাময় খাতে সরকারের কাছে কি ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা চান?
মোস্তফা আল মোমিন: আসলে আমাদের ব্যবসায়ীরা তেমন কোন পৃষ্ঠপোষকতা চান না। যেটা দরকার তা হচ্ছে, আমরা যারা উদ্যোক্তা, যারা নতুন করে কিছু চিন্তা করছি, হোক তা মুদির দোকান বা বড় কোন কারখানা, আমরা যেন বাধাপ্রাপ্ত না হই। এখন ট্রেড লাইসেন্স নিতে গেলে দালালদের ঘুষ দিতে হয়। এখানে বিনিয়োগ করলে নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তার জন্য বিদেশে কোম্পানি করতে হয়। দেখবেন বাংলাদেশে যে স্টার্ট-আপগুলো ভালো করছে, সবাই সিঙ্গাপুরে রেজিস্টার্ড। আমরাও সিঙ্গাপুর রেজিস্টার্ড। আমরা বাংলাদেশে থেকে ভালো বিনিয়োগ আনতে পারি না। কারণ মুনাফা করে কেউ টাকা নিয়ে যেতে পারে না। একমাত্র উপায় হচ্ছে অনিয়ম করে টাকা নিয়ে যাওয়া। দেখবেন ‘ডুয়িং বিজনেস’-এর র্যাংকিং-এ বাংলাদেশের স্কোর একেবারে কম। এখানে ব্যবসা করা খুব কঠিন। এক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে আমাদের সহযোগিতা করা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: আপনার যাত্রার গোড়ার দিকের কথা বলুন।
মোস্তফা আল মোমিন: মাত্র ৪ হাজার ডলার সম্বল করে আমি আড়াই-তিন বছর আগে যাত্রা শুরু করি, মিশন ছিল অনেক বড়। আমি দেখেছি বেশিরভাগ বাংলাদেশি স্টার্ট-আপ ফাউন্ডার গুলশান বনানীর সমস্যার সমাধানে উদগ্রীব। এরা দেশের জনগোষ্ঠীর ০.১ শতাংশেরও কম। স্টার্ট-আপ ফাউন্ডারদের দেখি না পুরো দেশের সমস্যা নিয়ে ভাবতে। বিলিয়ন ডলার কোম্পানি হতে হলে মিলিয়ন মানুষের সমস্যার সমাধান করতে হবে। আমরা ৫ হাজার ডলারে গাড়ি বিক্রি করছি। ২৩ হাজার গ্রাহক উপকৃত হয়েছেন। ২০২৭ সাল নাগাদ ২৬০ হাজার টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন কমবে। আমাদের লক্ষ্য বছরে ২০ হাজার বৈদ্যুতিক গাড়ি বানানো। এরপর বৈশ্বিক সম্প্রসারণের দিকে নজর দেব।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: সম্মাননা পাওয়ার পর সবার আগে কার কথা মনে পড়ছিল বেশি?
মোস্তফা আল মোমিন: সবার আগে আমার মনে পড়েছে গত আড়াই বছর আমাকে যে কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তা। বাংলাদেশ থেকে বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদন করব, সে কথা তুলতেই সবাই আমাকে পাগল ভাবতো। এই যে আড়াই বছরে আমার কতগুলো বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে সব চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। আমরা ‘পালকির’ গাড়ি বানিয়েছি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য। মানুষ এটা দিয়ে টাকা আয় করবে।
আমি অনেকদিন আগে ইভি ইকোসিস্টেম বানিয়েছি। আমার কথা হলো মানুষের জন্য গাড়ি কেনা সহজ করে দিতে হবে। দাম কমাতে হবে। পৃথিবীর সব দেশেই বৈদ্যুতিক গাড়ির জন্য সরকার প্রণোদনা দেয়। আমাদের নেই, তাই নিজেদেরই বানিয়ে নিতে হচ্ছে। বের করতে হচ্ছে দাম কমানোর উপায়। আমার হিসাব সোজা। এক হাজার মানুষ যদি গাড়ির মালিক হয়, নিজে আয় করে, তার সন্তানকে ভালো স্কুলে দিতে পারবে। আমার পরিবার, আমার বিনিয়োগকারীরা, ঢাকার উত্তর বাড্ডার কারখানায় আমার টিম, সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। তাদের ছাড়া এ পর্যায়ে আসতে পারতাম না।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্টের হাত থেকে জায়েদ সাসটেইনেবিলিটি অ্যাওয়ার্ডটি নেওয়ার অভিজ্ঞতাটি বলুন।
মোস্তফা আল মোমিন: আমি যখন মঞ্চের দিকে আসছিলাম তখন দেখি প্রেসিডেন্ট নিজেই করতালি দিয়ে হাসিমুখে আমাকে স্বাগত জানাচ্ছেন। এরপর তিনি বললেন, “তোমরা বাংলাদেশে ইলেক্ট্রিক গাড়ি বানাচ্ছো!” আমাদের কাজের প্রশংসা করলেন। বললেন, “যদি দক্ষতার সঙ্গে কাজ করো, একদিন বিশ্বের বৃহৎ গাড়ি নির্মাণ কোম্পানি হবে তোমার।”