Published : 01 May 2025, 08:19 PM
আজ পহেলা মে—বিশ্ব শ্রমিক দিবস। দিনটি বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের ইতিহাস স্মরণে পালিত হয়ে আসছে বহু বছর ধরে। কিন্তু অনেক দেশেই দিনটি কেবল ক্যালেন্ডারে রয়ে যায়—ছুটির দিন নয়, উৎসব নয়, বরং প্রতিদিনের মতোই কঠোর পরিশ্রমে ভরা এক ক্লান্তিকর দিন। তেমনই একটি দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত, যেখানে হাজারো প্রবাসী শ্রমিকের মতো আমিও আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেছি ঠিক ভোর পাঁচটায়—মে দিবসেও কোনো ছুটি নেই, নেই কোনো ব্যতিক্রম।
ভোরের কুয়াশা আর ক্লান্ত চোখ মুছে বেরিয়ে পড়ি নাস্তার জন্য। তারপর শুরু হয় ব্যস্ততার দৌড়। কারণ সাড়ে পাঁচটায় কোম্পানির বাস আসবে, সেটি মিস করলে কাজ মিস হবে—মানে বেতন কাটা যাবে। আমাদের ক্যাম্পে একেক রুমে ২০ থেকে ২৫ জন শ্রমিক থাকি। বড় একটি রুম, তিনতলা লোহার খাটে গাদাগাদি করে বাস, গরমে দম বন্ধ হয়ে আসে প্রায়ই।
সকালে প্রায় ৫০-৬০ জন একসাথে বাসের জন্য লাইনে দাঁড়াই। আজও তাই দাঁড়িয়ে রইলাম, রোদ উঠার আগেই শরীর ভিজে উঠেছে ঘামে। দশ মিনিট পর বাস এলো। উঠেই দেখলাম ভেতরে এসি নেই, ফ্যানগুলোও নষ্ট। জানালা খুললে কেবল উত্তপ্ত মরু হাওয়া ঢুকে পড়ে। কিছু বলার নেই—শ্রমিক যখন, তখন সব সহ্য করেই চলতে হবে।
প্রায় এক ঘণ্টার যাত্রা শেষে সকাল ৭টায় পৌঁছলাম কাজের সাইটে, যা ক্যাম্প থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে। বাস থেকে নামতেই সাইট ইঞ্জিনিয়ার আর ফোরম্যানের চিৎকার—“তাড়াতাড়ি কাজ ধরো!” একটু বসে নাশতা খাওয়ার সময়ও নেই। রোদের তাপ আজ আরও বেশি, অন্যান্য দিনের তুলনায় প্রায় ৫ ডিগ্রি বেশি। গরমে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার আগেই বারবার পানি খেতে হয়।
সকাল ১০টা পর্যন্ত কাজ করে ছোট্ট একটা বিরতি পেলাম নাশতার জন্য। কেউ কেউ একটু কিছু খায়, আবার অনেকেই খায় না। শুনতে অবাক লাগলেও, নাশতার মতো সামান্য খাবারটাও অনেকে এড়িয়ে চলে—বেতনের আগেই যাদের পরিবার থেকে টাকা পাঠাতে বলা হয়, তাদের হাতে নিজে খাওয়ার টাকা আর থাকে না। অনেকে কেবল দুই বেলার ভাতেই বেঁচে থাকে।
দুপুর ১২টায় শুরু হয় লাঞ্চ বিরতি—দুই ঘণ্টা। কিন্তু খাবার পর একটু বিশ্রামের জায়গাটুকুও নেই। রেস্ট এরিয়ায় চারদিকে জুতোর গন্ধ, গাদাগাদি করে বসে থাকে ৩০-৪০ জন। এই অবস্থায় বিশ্রামের চেয়ে আরও ক্লান্তি বাড়ে।
সন্ধ্যা ৬টায় কাজ শেষ। আবার সেই গরম, সেই এক ঘণ্টার বাসযাত্রা। মনে হয় শরীরটা যেন পুড়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা ৭টায় ক্যাম্পে ফিরি। এরপর গোসলের সিরিয়াল, বাজার করা, রান্না, আরেকবার সিরিয়াল। রান্না শেষ করতে করতে রাত ১০টা। খাওয়া-দাওয়া শেষে চোখে ঘুম নামার আগেই মনে পড়ে, বাড়িতে একটু কথা বলা হয়নি আজও। সময় কোথায়?
এই যে কথাগুলো বললাম, এটি কেবল আমার একদিনের কথা নয়। এই চিত্র প্রতিদিনের। আমিরাতের হাজারো শ্রমিকের ঘাম-ঝরা জীবনের প্রতিচ্ছবি। যারা মে দিবসে ছুটি পান না, আনন্দ পান না—শুধু বেঁচে থাকেন কাজের তাগিদে, পরিবারের স্বপ্নে। এইসব নিঃশব্দ যোদ্ধারাই আসল মে দিবসের প্রতীক।