যুক্তরাষ্ট্রের বিএনপি নেতারা বলছেন, আরেফী তাদের কেউ নন। আর আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, বিএনপির আরেকটি ‘ষড়যন্ত্র’ মাঠে মারা গেল।
Published : 01 Nov 2023, 11:05 PM
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ‘উপদেষ্টা’ পরিচয় দিয়ে ঢাকায় বিএনপি অফিসে সংবাদ সম্মেলন করার পর মিঞা জাহিদুল ইসলাম আরেফী ওরফে বেল্লালের গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা এখন নিউ ইয়র্কে বাঙালি কমিউনিটির আলোচনার কেন্দ্রে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিএনপি নেতারা বলছেন, আরেফী তাদের কেউ নন। আর আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, বিএনপির আরেকটি ‘ষড়যন্ত্র’ মাঠে মারা গেল।
৫৮ বছর বয়সী আরেফী বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যান গত শতকের আশির দশকে। দীর্ঘদিন তিনি বিভিন্ন স্টোরে ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করেছেন।
গত কয়েকবছর তিনি থাকতেন ওয়াশিংটন ডিসি সংলগ্ন ম্যারিল্যান্ড স্টেটের দামাস্কাস সিটির নিকেলবী ড্রাইভের এক বাসায়। সেই বাসা এখন তালাবন্ধ।
স্থানীয় বাঙালিরা জানান, বছর দশেক আগে ত্যাগ করে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে চলে গেছেন তার স্ত্রী। তারপর থেকে আরেফী একাই ছিলেন।
দুই বছর আগে তাকে মধ্যপ্রাচ্যের এক নারীর সঙ্গে দেখা যাচ্ছিল। সম্প্রতি বাংলাদেশে ফিরে আরেফী এক নারীকে বিয়ে করেছেন বলে শুনেছেন যুক্তরাষ্ট্রে তার পরিচিতজনরা। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত তাদের জানা নেই।
আরেফীর ছবি দিয়ে ফেইসবুকে অন্তত চারটি অ্যাকাউন্ট পাওয়া যায়, যেখানে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য।
একটিতে দাবি করা হয়েছে, আরেফী ক্যাপিটল হিলে (কংগ্রেস ভবন) কাজ করেন এবং তিনি ডেমক্র্যাটিক পার্টির জাতীয় কমিটির সদস্য।
এর কোনোটিই সত্য নয় বলে জানালেন ম্যারিল্যান্ড স্টেট ডেমক্র্যাটিক পার্টির নির্বাহী কমিটির সদস্য আনিস আহমেদ।
তিনি বলেন, “আরেফী কখনো কোনো ফোরামে ছিলেন না। এক সময় থাকতেন মন্টগোমারি কাউন্টিতে, সেই কমিটির সাথেও আমি দীর্ঘদিন কাজ করেছি। কখনো তাকে দেখিনি। সাম্প্রতিক সময়ে কমিউনিটির কোনো অনুষ্ঠানেও তাকে দেখিনি।”
গত শনিবার ঢাকায় সংঘর্ষের মধ্যে বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর দলটির নয়া পল্টনের কার্যালয়ে গিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে আলোচনায় আসেন বাংলাদেশি-আমেরিকান আরেফী।
নিজেকে জো বাইডেনের ‘উপদেষ্টা’ দাবি করে তিনি বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাথে তার দিনে ১০-১৫ বার যোগাযোগ হয় এবং মার্কিন সরকারের সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে।
যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আইন ও বিচার বিভাগের ওপরও ‘নিষেধাজ্ঞা দিতে যাচ্ছে’ বলে দাবি করেন আরেফী।
আরেফীর সংবাদ সম্মেলনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে শুরু হয় আলোচনা। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়, ওই ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কেউ নন। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস থেকে কারও যাওয়ার তথ্য পুরোপুরি ‘মিথ্যা’।
আর বিএনপির মিডিয়া সেল থেকে দেওয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, যে ব্যক্তি সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেছেন, তার সম্পর্কে বিএনপির কাছে কোনো তথ্য নেই।
এরপর রোববার দুপুরের পর দেশের বাইরে যাওয়ার সময় ইমিগ্রেশন পুলিশ আরেফীকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। ওইদিনই ‘মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বিশ্বাসভঙ্গের’ অভিযোগে আরেফীর বিরুদ্ধে মামলা করেন মহিউদ্দিন শিকদার নামের এক সাবেক ছাত্রলীগ নেতা।
সাবেক সেনা কর্মকর্তা চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী এবং বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকেও ওই মামলায় আসামি করা হয়। মঙ্গলবার সারওয়ার্দীকে গ্রেপ্তার করা হলে বুধবার আদালত তাকে রিমান্ডে পাঠায়।
আরেফী বিএনপির সঙ্গে কবে থেকে ভিড়লেন, তা নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীদের মধ্যে চলছে আলোচনা।
ম্যারিল্যান্ড স্টেট বিএনপির সেক্রেটারি মোহাম্মদ কাজল জানান, ৩০ বছর ধরে তিনি বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত। আরেফীকে তিনি কখনও বিএনপির সাথে দেখেননি।
“কী কারণে এবং কারা তাকে বিএনপি অফিসে নিয়ে এমন মিথ্যাচার করিয়েছে, সেটা আমরা জানি না।”
ওয়াশিংটন ডিসি বিএনপির সভাপতি হাফিজ খান সোহায়েলও বলেছেন, আরেফী যুক্তরাষ্ট্রে বিএনপির কোনো ফোরামে কখনো ছিলেন না। তার দাবি, আরেফী বিএনপির ‘কেউ না’।
আরেফীকে দিয়ে কোন উদ্দেশ্যে বিএনপি ‘মিথ্যাচার করিয়েছে’, সেই প্রশ্ন তুলেছেন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক নিজাম চৌধুরী।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের সামনে ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশে তিনি বলেন, “একটি দল কতটুকু দেউলিয়া হয়ে গেলে, কতটুকু জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে এ ধরনের কাজ তারা করতে পারে। বিএনপি এর আগেও এ ধরনের আজগুবি প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছিল কিন্তু তা বেশিক্ষণ টেকেনি।
“মিথ্যার বেসাতিই শুধু নয়, মার্কিন কংগ্রেসম্যানদের স্বাক্ষরও জাল করেছিল বিএনপি। জাল স্বাক্ষরের সেই বিবৃতিতে বিএনপির পক্ষে যতসব অবান্তর কথা রটানো হয়। ভারতীয় জনতা পার্টির প্রধানের সাথে তারেক রহমানের টেলি সংলাপ হয়েছে এবং তারেকের নেতৃত্বে বিএনপিকে ভারত ক্ষমতায় দেখতে চায় বলে ওই টেলি-সংলাপে শোনানো হয়। বিজেপি প্রধান তা অস্বীকার করেছিলেন।”
নিজাম চৌধুরী বলেন, “এক সময় তারেক রহমান প্রচার করেছিলেন যে, তার সাথে নাকি স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তাদের কথা হয়েছে। প্রকৃত অর্থে সেটাও ছিল এবারের মতই ভুয়া।”
প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আরেফী ২০১৬ সাল থেকে ম্যারিল্যান্ডের বিগ লট স্টোরে কাজ করছিলেন সহকারী ম্যানেজার হিসেবে। এর আগে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সোয়া বছর কাজ করেন একটি স্টোরের ম্যানেজার হিসেবে।
তার আগে ২০১১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত এক বছর ৯ মাস নিউ জার্সি স্টেটের প্যারামুস সিটির একটি স্টোরের জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন আরেফী। ২০১৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ওয়াশিংটন ডিসি সংলগ্ন ভিয়েনায় মাইকেল আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটের স্টোর ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছেন।
গত বছর ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে আমেরিকান পাসপোর্টে ‘নো ভিসা রিকোয়ার্ড’ সিল নেন আরেফী। সেই অনুমোদন নিয়েই তিনি বাংলাদেশে যান।
সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাক হোসেন এবং সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দীর সঙ্গে আরেফীর যোগাযোগ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে প্রবাসীদের মনে।
যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা এম ফজলুর রহমান বলেন, “হাজারটা মিথ্যা দিয়েও যেমন একটি সত্যকে ঢেকে রাখা যায় না, তেমনি মিথ্যাচার করে বাংলাদেশের মানুষকে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার আরেকটি কৌশল মাঠে মারা গেল। এটা বুমেরাং হয়েছে বিএনপির রাজনীতির জন্যে।”