খালেদার রাজনীতি করা নিয়ে শর্ত নেই: আইনমন্ত্রী

“মানুষ মনে করে তিনি অসুস্থ, তার রাজনীতি করার অবস্থা নেই৷ এটাই বাস্তবতা,” খালেদা প্রসঙ্গে বলেছেন আনিসুল হক।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Feb 2023, 10:10 AM
Updated : 23 Feb 2023, 10:10 AM

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, নির্বাহী আদেশে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাময়িক মুক্তির ক্ষেত্রে রাজনীতি করা নিয়ে কোনো শর্ত দেওয়া হয়নি, তবে তার শারীরিক অবস্থা রাজনীতি করার মত নয়।

বৃহস্পতিবার ঢাকায় বাংলাদেশ ইনস্টিউট অব ইন্ট্যারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ আয়োজিত এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এ কথা বলেন আইনমন্ত্রী। 

তিনি বলেন, “উনি (খালেদা জিয়া) ঢাকাস্থ নিজ বাসায় থেকে চিকিৎসা নেবেন, দেশের বাইরে যেতে পারবেন না। এর বাইরে কোনো শর্ত নাই। আপনারা প্রশ্ন করেছেন উনি রাজনীতি করতে পারবেন কি না। আমি সত্য বলি বলেই বলেছি, রাজনীতি করার ব্যাপারে কোনো শর্ত নাই।”

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয় খালেদা জিয়ার। সেদিনই কারাবন্দি হন তিনি। বিএনপি এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। ওই বছরের ৩০ অক্টোবর উচ্চ আদালত সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করে। তার আগে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় বিএনপি নেত্রীর সাত বছরের সাজা হয়।

বিএনপি নেত্রীকে মুক্ত করতে দলটির নেতারা উচ্চ আদালতে যত চেষ্টা করেছেন, তার সবই বিফলে যায়। পরে পরিবারের পক্ষ থেকে ‘মানবিক আবেদন নিয়ে’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে যান খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার। বিএনপি ওই উদ্যোগে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেনি।

খালেদার স্বজনদের আবেদনে প্রধানমন্ত্রী ইতিবাচক সাড়া দেন। ২০২০ সালের ২৪ মার্চ শর্ত সাপেক্ষে সরকার নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেয় খালেদা জিয়াকে। পরের দিন তিনি মুক্তি পান।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর ষষ্ঠবারের মতো ছয় মাসের জন্য সাময়িক মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়। ফলে আগামী ২৫ মার্চ পর্যন্ত খালেদাকে কারাগারে যেতে হচ্ছে না।

খালেদা জিয়া থাকছেন গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের বাসভবন ফিরোজায়। পাশেই ৮৩ নম্বর সড়কে তার রাজনৈতিক কার্যালয়। কিন্তু এই প্রায় তিন বছরে তিনি একবারের জন্যও সেখানে যাননি। রাজনীতি নিয়ে কোনো বক্তব্য বা দিক নির্দেশনা প্রকাশ্যে আসেনি। এমনকি জাতীয় দিবস বা উৎসব পার্বণেও কোনো বার্তা দেননি।

রাজনীতি থেকে বিএনপি নেত্রী কেন দূরে, এ বিষয়টি নিয়েও দলের পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে কেবল দুটি শর্তে মুক্তির কথা জানানো হয়েছে। এর একটি ছিল বাসায় চিকিৎসা নেওয়া এবং দ্বিতীয়টি তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না।

একাধিকবার অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন বিএনপি নেত্রী। তবে দেশের বাইরে যাওয়ার অনুমতি মেলেনি।

গত সোমবার বিকালে ঢাকায় অমর একুশে বইমেলায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের স্টল পরিদর্শনে গিয়ে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

তার কাছে প্রশ্ন ছিল, খালেদা জিয়া নির্বাচন করতে পারবেন কি না। জবাবে কাদের বলেন, “বেগম জিয়ার কারাদণ্ড আছে। এই অবস্থানটা তার নির্বাচন করার পক্ষে নয়। তিনি নির্বাচন করার জন্য যোগ্য না।”

২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়ার পক্ষে ফেনী-১ ও বগুড়া-৬ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়া হয়। তবে সাজার কারণে দুটোই বাতিল হয়ে যায়। উচ্চ আদালতে গিয়েও নিজের পক্ষে আদেশ আনতে পারেননি তিনি। ফলে ভোটে দাঁড়ানো হয়নি।

বিএনপি নেত্রীর রাজনীতিতে ‘ফেরার’ প্রসঙ্গে কাদের বলেন, “তিনি বিএনপির নেতা হিসেবে যদি রাজনীতি করতে চান, সেক্ষেত্রে যে শর্তে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, সেটি মেনে তাকে করতে হবে। নো ওয়ে।”

এই প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার ওই শর্ত নিয়ে আইনমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সাংবাদিকরা।

উত্তরে আনিসুল হক বলেন, “উনি নির্বাচন করতে পারবেন না কারণ উনি দণ্ডিত, রাজনীতি করতে পারবে না এমন কথা কোথাও নাই।”

খালেদা জিয়ার বাস্তব পরিস্থিতিও বিবেচনা করতে হবে মন্তব্য করে আইনমন্ত্রী বলেন, “তার যে আবেদন তার ভাইরা করেছেন, সেখানে বলা আছে তিনি গুরুতর অসুস্থ। তার যদি আরো ভালো চিকিৎসা না হয়, তাহলে তার জীবন বিপন্ন হবে৷ তাকে মানবতার খাতিরে প্রধানমন্ত্রী দণ্ড স্থগিত রেখে মুক্তি দিয়েছেন।

“তিনি অসুস্থ, তিনি রাজনীতি করতে পারবেন কি না, সেটি আমি বারবার বলেছি আপনারা দেখেন। স্বাভাবিকভাবে মানুষ মনে করে তিনি অসুস্থ তার রাজনীতি করার অবস্থা নেই৷ এটাই বাস্তবতা।”

‘অতীতের মতই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে’

বিএনপিকে নির্বাচনে আনার বিষয়ে সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নে আনিসুল হক বলেন, “আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগের আমলে অতীতে যেমন সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে, তেমনই হবে। সংবিধানের আলোকে নির্বাচন হবে। নির্বাচনে যেন সবাই আসে এটা আওয়ামী লীগ চায়৷ কিন্তু কে আসবে কে আসবে না সেটা তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত।

“জাতির পিতা যে গণতান্ত্রিক আদর্শ ও সংবিধান দিয়ে গেছেন, তার বাইরে আমরা এক চুলও যাব না। ১৯৯৬ এর মত ভোটারবিহীন নির্বাচন আমরা করব না। নির্বাচন ২০১৪, ২০১৮ সালের মত সুষ্ঠু হবে।”

নির্বাচন নিয়ে ‘আন্তর্জাতিক চাপ নেই’ মন্তব্য করে আনিসুল হক বলেন, “…বলা হয় ২০১৪, ২০১৮ এর নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। সুষ্ঠু না হলে, জনগণ মেনে না নিলে আমরা ক্ষমতায় থাকতে পারতাম না। নির্বাচন যেন সুষ্ঠু না হয়, সেই চেষ্টা বিএনপি করেছে, অগ্নিসন্ত্রাস করেছে।

“অনেকে অনেক কথা বলবে। কিন্তু শেখ হাসিনার অধীনে আমাদের এই সরকার মনে করে, আন্তর্জাতিক কোনো চাপ নয় বরং জনগণ ও গণতন্ত্রের প্রতি আমাদের যে দায়বদ্ধতা, সেখান থেকেই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হবে।”

তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের রাজনীতি বঙ্গবন্ধু যেটা করে গেছেন, এখন প্রধানমন্ত্রী করছেন তা হচ্ছে জনকল্যাণমুখী। অপরদিকে বিএনপির রাজনীতি হচ্ছে মিথ্যার আর হত্যার।”

রোহিঙ্গা ক্যাম্প প্রসঙ্গ

সাংবাদিকদের সাথে আলাপের আগে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ আয়োজিত ‘রোহিঙ্গা ক্রাইসিস অ্যান্ড দ্যা ইমারজিং সিকিউরিটি চ্যালেঞ্জেস: স্ট্র্যাটেজি অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তব্য দেন মন্ত্রী।

সেখানে তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বাড়ছে। কিছু লোক রোহিঙ্গা তরুণ ও নারীদের টার্গেট করে তাদের উগ্রবাদ, মানবপাচার, মাদকপাচারে ব্যবহার করছে। সেখানে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমে জড়ানো হচ্ছে তাদের। এসব বন্ধে সরকার ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর তিন হাজার সদস্য মোতায়েন করেছে।

“তবে সেখানে জাতিসংঘের যেসব সংস্থা ও এনজিও কাজ করে, তাদেরও এসব বন্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে, রোহিঙ্গাদের কাউন্সেলিং করতে হবে।”

সমস্যাটি এখন আর বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দুই পক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেন, “মিয়ানমার নিয়মিত রোহিঙ্গাদের তাদের ভূমিতে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটি খারিজ করছে। বাংলাদেশকে এর মূল্য দিতে হচ্ছে।“

এর আগে সেমিনারে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা  গবেষকরা তাদের প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। যেখানে ‘রিজিওনাল সিকিউরিটি ডাইমেনশনস অব দ্যা রোহিঙ্গা ক্রাইসিস’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন  প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের সাবেক প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নিলয় রঞ্জন বিশ্বাস ‘দি রোহিঙ্গাস অ্যান্ড ইমারজিং নন-ট্র্যাডিশনাল সিকিউরিটি চ্যালেঞ্জেস’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

‘মিয়ানমার অ্যান্ড দ্যা রোহিঙ্গাস: দি পলিটিক্যাল ইকনমি অব আর্মস অ্যান্ড বিজনেস’ শীর্ষক আলোচনা করেন বিআইআইএসএসের রিসার্চ ফেলো এএসএম তারেক হাসান শিমুল।

পিএসসির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন ‘রোহিঙ্গা ক্রাইসিস অ্যান্ড সিকিউরিটি কনসার্নস: রেসপন্স স্ট্র্যাটেজি অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, “মিথ্যা অভিযোগ করে মিয়ানমার বারবার বাংলাদেশকে একটি ‘ডেমোগ্রাফিক ডাম্পিং স্টেশন’ হিসেবে ব্যবহার করছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ বিষয়টিকে কম গুরুত্ব দিচ্ছে বলেই নামমাত্র নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে, এতে মিয়ানমার কূটনৈতিকভাবে মোটেই দুর্বল হচ্ছে না। আমাদেরকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আরও নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। দীর্ঘকালীন ক্যাম্প ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিতে হবে। দ্বিপক্ষীয় জায়গাতে আটকে না থেকে এই সমস্যা সমাধানে বহুপক্ষীয় কূটনৈতিক কৌশল নিতে হবে। আমাদের স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্যও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।“

সেমিনারে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার পদস্থ কর্মকর্তা, বিদেশি দূতাবাসের প্রতিনিধি, ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা, সাবেক কূটনীতিক, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশ নেন।