Published : 17 Aug 2023, 11:40 PM
খন্দকার মোশতাক আহমেদের ‘কূটবুদ্ধির’ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুও যে সচেতন ছিলেন, সে কথা এক আলোচনায় স্মরণ করলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
তিনি বলেছেন, মোশতাকের মাথায় ছিল ‘অনেক প্যাঁচ ও শয়তানি’। তাই তাকে বঙ্গবন্ধুর ‘বগলের তলায়’ রাখতেন, যেন শয়তানি না করতে পারে। বঙ্গবন্ধু নিজেই সে কথা বলে গিয়েছিলেন।
জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) বৃস্পতিবার ‘বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখা’ শিরোনামে এ আলোচনা সভার আয়োজন করে।
বিআইডিএস মহাপরিচালক বিনায়ক সেনের সঞ্চালনায় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, জ্বালানী বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, ওয়ার্কার্স পাটির সভাপতি রাশেদ খান মেননসহ আরও অনেকে অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেনে।
একাত্তরে মুজিবনগর সরকার গঠনের সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে ছিলেন খন্দকার মোশতাক। দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু তার সরকারের বিদ্যুৎ, সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন মোশতাককে।
১৯৭৫ সালে তাকে বাণিজ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি বাকশালের কার্যকরী কমিটিরও সদস্য ছিলেন।
ওই বছর ১৫ অগাস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনার পর খন্দকার মোশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দায়মুক্তি দিতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম তখন কমিউনিস্ট পার্টির সহযোগী সংগঠন ক্ষেতমজুর সমিতির নেতা। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের কথা তিনি অনুষ্ঠানে স্মরণ করেন।
“বঙ্গবন্ধুর সাথে সেদিন ছিলেন খন্দকার মোশতাক। তিনি (বঙ্গবন্ধু) মোশতাককে দেখিয়ে বলেন, ‘এই মোশতাক থেকে খুব সাবধান। মাথার ভেতরে প্যাঁচ। তারকাটা ঢোকাইলে বের করলে দেখবা স্ক্রু হয়ে গেছে। এত প্যাঁচ।’
“তার মত লোককে সঙ্গে নিয়ে ঘোরেন কেন জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বোগলের তলায় না রাখলে পরে কখন কি শয়তানি করে ফেলে’।”
সেলিম বলেন, বঙ্গবন্ধুকে যেদিন হত্যা করা হয়, তার আগের দিন খন্দকার মোশতাক তার জন্য হাঁসের ভুনা মাংস পাঠিয়েছিলেন।
“বঙ্গবন্ধুর বাবা যেদিন মারা যান, সেদিন কেবিনেট মিটিং ছিল। বঙ্গবন্ধু চলে যাওয়ার সময় বলেছিলেন, ‘আমি চলে যাচ্ছি, তোমরা কেউ আসবা না আমার সাথে।’ মুশতাক কিন্তু গেছিল।
“এরপর আমরা টেলিভিশনে দেখেছি, (বঙ্গবন্ধুর বাবার) লাশ কবরে নামানো থেকে শুরু করে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কান্না… সেই তার (বঙ্গবন্ধুর) ঘাতক মোশতাক।”
সেলিম বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিবাদ মিছিল করার জন্য তারা হাতিরপুলে মুফিদুল হকের বাসায় গিয়েছিলেন তারা। সেখানে ছাত্র লীগেরও দুয়েকজন ছিলেন, বাকিরা সবাই ছাত্র ইউনিয়নের।
“সবাইকে ফোন করে বললাম রেডি থাক, মিছিল করতে হবে। এরপর দেখলাম একে একে তিন বাহিনীর প্রধান (মোশতাকের প্রতি) আনুগত্য করল। এরপর দেখা গেল আওয়ামী লীগের একের পর এক মন্ত্রী, ৬/৭ জন নেতা বাদে সবাই আনুগত্য ঘোষণা করেছে। তখন মানুষের মধ্যে ইম্প্রেশন হল, আওয়ামী লীগ সরকারই টিকে আছে।”
ছাত্র ইউনিয়নই সে সময় মুজিব হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল করেছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “ইউনিভার্সিটি যেদিন প্রথম খুলল, সেদিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে মধুর ক্যান্টিনে এক মিনিটের বক্তব্য শেষে ‘মুজিব হত্যার বিচার চাই’, ‘এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে’ স্লোগান দিয়ে ঝটিকা মিছিল করেছিলাম।”
সেলিম জানান, তারা ঠিক করেছিলেন, ৪ নভেম্বর ধনমন্ডি ৩২ নম্বরে গিয়ে ফুলের মালা দিয়ে আসবেন। সেজন্য লিফলেটও ছাপানো হয়েছিল। লিটফেট বিলি করতে গিয়ে অনেকে গ্রেপ্তার হন।
“এরপর ‘রুশ ভারতের দালাল সেলিমের কল্লা চাই’ বলে স্লোগান দিয়েছিল। কারা এই স্লোগান দিয়েছিল, নিশ্চয় আপনার ধারণা করতে পারেন।”
বামপন্থি এই রাজনীতিবিদ বলেন, “আমাদের মিছিলে যোগ দেওয়ার জন্য আমরা পল্লী কবি জসীম উদ্দীন এবং শিল্পী জয়নুল আবেদিনের কাছে প্রস্তাব দিই। তারা ওই মিছিলের সাথে একাত্মতার কথা বললেও বার্ধক্যের শরীর নিয়ে মিছিলে যেতে পারেননি।
“কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতারা এসে আমাকে বলল, ‘সেলিম প্লিজ এই মিছিলটা করো না। বঙ্গবন্ধুকে তো আর ফেরত পাব না। মাঝখান থেকে আওয়ামী লীগের কেবিনেটটা বাতিল করো না।”
সেলিম বলেন, “মোশতাকের কেবিনেটকে তারা আওয়ামী লীগের কেবিনেট বলে আখ্যায়িত করতেছে এবং সেটা যাতে বাতিল না হয় সেটার জন্য আমার কাছে সুপারিশ করতেছে। ট্র্যাজেডির ওপরে অধিকন্তু ট্র্যাজেডি হল এটা।”
বঙ্গবন্ধুর বাকশাল গঠনের সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দিয়ে সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, “বঙ্গবন্ধু এদেশের কৃষক শ্রমিক মানুষের জন্য কল্যাণময় একটি রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিলেন। তিনি মনে করেছেন, সমাজতন্ত্রের মাধ্যমেই এটা সম্ভব। এজন্য তিনি বাকশাল গঠন করেছিলেন। ওই সময়ে তিনি চেয়েছেন, বাকশাল জাতীয় দল হিসেবে থাকবে, দেশের সকল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ওই প্ল্যাটফর্মে থাকবে।”
আলোচনায় রাশেদ খান মেনন বলেন, ১৯৬৬ সালে এবং ১৯৬৭ সালের ১৯ মাসের বন্দি জীবনের সময়ে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পান তিনি। সে সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
“ওই সময়ে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রদ্রোহী, দেশভাঙার ষড়যন্ত্রসহ অনেক ধরনের মামলা দিয়ে অনেক দিনে জেল আটকে রাখা হয়েছিল। তখন দেখেছি, তিনি কেমন রাজনীতিবিদ। আমি ছাত্র ইউনিয়ন করতাম, কিন্তু তিনি আমাকে কখনো বাইরের কেউ মনে করেন নাই।”
মেননের ভাষায়, সে সময় পাকিস্তানি শাসকদের নির্যাতনের মধ্যেও বাংলাদেশের সকল পক্ষের রাজনীতিবিদদের ঐক্যবদ্ধ করে সম্মিলিতভাবে এক দফায় নিয়ে আসার ‘প্রধান পুরুষ’ ছিলেন বঙ্গবন্ধু।
“বাকশাল করার ৩/৪ মাস আগে থেকেই দেশের প্রায় সকল রাজনীতিবিদের সঙ্গে তিনি আলোচনা করেছেন। এরমধ্যে আমার সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। একদিন এরকম এক আলোচনায় তিনি আমাকে বললেন, ‘তোরা সমাজতন্ত্র চেয়েছিলি। এখন আমি বাকশাল করব। সমাজতন্ত্র কায়েম করব। সবাই আমার সাথে চলে আয়’।”
মেনন বলেন, বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন, বাকশাল একটি জাতীয় দল হিসেবে থাকবে। যত রাজনৈতিক দল ও আদর্শের দল আছে, সবাই আলাদা আলাদা গ্রুপ হিসেবে রাজনীতি করবে।
“বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একান্তে আলাপের সময় আমরা বলেছিলাম, আপনি যেভাবে চিন্তা করছেন, তাতে বিশ্ব রাজনীতির বিভিন্ন অংশের বিরাগভাজন হওয়ার প্রসঙ্গ আসবে। তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি বাংলাদেশ গড়ব। আমার মত আমার বাংলাদেশ গড়ব। ওয়াচ অ্যান্ড সি, আমি কি করি‘।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান এক সময় কাজ করেছেন তার বাবা শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু তার বিরোধী রাজনীতিবিদদের প্রতিও মানবিক ছিলেন।
“ফজলুল কাদের চৌধুরীর মৃত্যুর সময় তার ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বিদেশে ছিলেন। তার দেশে আসার সুযোগ ছিল না। তারপরও বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি দেশে আসেন। কিন্তু তার দেশে আসায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাকে এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে দিচ্ছিল না।
“এই খবর বঙ্গবন্ধু পেয়ে আমাকে বললেন, ছেলেটা তার বাবাকে দেখতে চায়। ব্যবস্থা করে দাও না। তবে তাকে দেখানোর পর আবার দেশ থেকে বের করে দেওয়ার কথাও আমাকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন “
“কিন্তু সালাউদ্দিন কাদের পরে দেশ থেকে আর বের হয়ে যাননি,” বলেন তিনি।