“এই সময়ে যদি আমরা রুখে দাঁড়াতে না পারি, তাহলে পুরো দেশ ও জাতির অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে, বলেন বিএনপি মহাসচিব।
Published : 16 Jul 2024, 07:15 PM
দেশের বর্তমান অবস্থাকে ‘ভয়াবহ’ বলে বর্ণনা করে এর বিরুদ্ধে সবাইকে ‘রুখে দাঁড়ানো’র আহ্বান রেখে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলছেন, তার বিশ্বাস জনগণ তাদের অধিকার আদায় করে নেবে।
মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনাসহ দেশের চলমান অবস্থা তুলে ধরে এ আহ্বান রাখেন তিনি।
মির্জা ফখরুল বলেন, “আজকে দেশের অবস্থা ভয়াবহ পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে আইনের শাসন নেই, গণতন্ত্র নেই। এখানে মানুষের ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার নেই, এমনকি কথা বলার কোনো অধিকার নেই। এখন কঠিন সময় আমরা অতিক্রম করছি। এই সময়ে যদি আমরা রুখে দাঁড়াতে না পারি, তাহলে পুরো দেশ ও জাতির অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে।
“আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, এ দেশের মানুষ, ওরা জেগে উঠছে। যে কথাটা মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ সব নেতা বলেছেন যে, আর সময় দেওয়া যাবে না। সকলকে উঠে দাঁড়াতে হবে, রুখে দাঁড়াতে হবে। আমি বিশ্বাস করি যে, জনগন তাদের অধিকার আদায় করে নেবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমাদের অধিকার আমাদের আদায় করে নিতে হবে।”
জাতীয় প্রেস ক্লাবের আবদুস সালাম হলে ভাসানী অনুসারী পরিষদের উদ্যোগে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান যাদু মিয়ার শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এই আলোচনা সভা হয়। যাদু মিয়া বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন।
‘ফ্যাসিবাদ কী চোখে দেখলাম’
বিএনপির মহাসচিব বলেন, “আমরা বরাবরই বলছি, আওয়ামী লীগ আর সেই আওয়ামী লীগ নেই। আওয়ামী লীগ এখন একটা দেউলিয়া রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে আমলাদের ওপরে এবং তাদের তথাকথিত বাহিনীর ওপরে, যারা আজকে রাষ্ট্রকে পুরোপুরিভাবে একটা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।
“ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে আমার ধারণা বই পড়ে, বিভিন্নভাবে। কালকে (সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটাবিরোধীদের ওপরে ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা) আমার মনে হয়েছে, আমি ফ্যাসিবাদ দেখেছি। আমি আমার চোখের সামনে দেখেছি, কোনো কিছু দমন করতে হলে- বিরোধী দলকে, বিরোধী মতকে, এমনকি ছাত্রদের দাবিগুলোকে; তখন এভাবে তাদের দলের লোকজনকে দিয়ে, তাদের বিভিন্ন সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়ে এবং পুরোপুরিভাবে সব স্তব্ধ করে দেওয়া, এটাই হচ্ছে সত্যিকার অর্থেই ফ্যাসিবাদ।”
মির্জা ফখরুল, “আজকে সেই অবস্থা থেকে দেশকে বের করে আনতে হবে। আজকে ৫৩ বছর হয়ে গেছে স্বাধীনতার, এই স্বাধীনতার এতদিন পরও আমাদের অধিকার নিয়ে লড়াই করতে হচ্ছে, সংগ্রাম করতে হচ্ছে। যে কোটার কথা ছেলেরা বলছে, এই কোটা তো প্রধানমন্ত্রীই বাতিল করে দিয়েছিলেন। আবার সেটাকেই আদালত দিয়ে সামনে নিয়ে এসে সেটা ইস্যু তৈরি করা হয়েছে।”
“দুর্ভাগ্য আমাদের দেশের আদালতকে ব্যবহার করা হচ্ছে তাদের শাসনকে স্থায়ী করার মধ্য দিয়ে, এই কথা আমরা বহুবার বলেছি। সে জন্য আমাদেরকে বিভিন্নভাবে কথা বলা হয়েছে।”
‘ওরা পাকিস্তানিদের মত দমন করছে’
কোটাবিরোধী আন্দোলনের বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, “গত এক দিনে শেখ হাসিনা সরকার যে ঘটনাটি ঘটিয়েছে, সেটা বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে জঘন্যতম ঘটনা। আমরা আগে কখনও দেখিনি, হাসপাতালের ভেতরে গিয়ে সরকারি দলের সন্ত্রাসীরা আহতদের আক্রমণ করবে; এটা আমরা কখনও চিন্তাও করতে পারি না, এমনকি পাকিস্তান আমলেও। তিনি (শেথ হাসিনা) বলেছেন, পাকিস্তান আমলে হানাদার বাহিনীর কথা নাকি ছেলেরা ভুলে গেছে।”
“আপনি তো ভুলে যেতে সাহায্য করছেন না, বরং আপনারা নতুন করে মনে করে দিচ্ছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যে আক্রমণ ছিল, সেটা থেকে আপনারা কোন অংশ কম করেছেন? আমরা যখন ঢাকা বিশ্বিদ্যালয়ে পড়ি, তখন ছিল এনএসএফ- আইয়ুব খানের দলের ছাত্রসংগঠন। তারা এভাবে আমাদের আক্রমণ করত, আমাদের সভা ভঙ্গ করত, অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে আমাদের সমস্ত আন্দোলনকে দমন করতে শক্তি প্রয়োগ করত।”
তিনি অভিযোগ করন, “আজকে আপনারা সেই পাকিস্তানিদের মত একইভাবে সাধারণ ছাত্রদের ন্যায়সঙ্গত যৌক্তিক দাবি, সেই দাবির আন্দোলনকে নসাৎ করে দেওয়ার জন্য আজকে তাদের ওপরে অস্ত্রশস্ত্র হাতে নিয়ে আপনাদের বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছেন। এভাবে ভয়াবহ নির্যাতন করে তাদের দমানোর চেষ্টা করছেন।”
‘মূল দাবিকে পাশ কাটাতে নানা কৌশল’
মির্জা ফখরুল বলেল, “একটা জিনিস লক্ষ্য করবেন, মূল যে দাবি জনগণের একটা সুষ্ঠু-অবাধ নির্বাচন চাই ,গণতন্ত্রকে ফেরত চাই, ভোটের অধিকার ফেরত চাই; এই দাবিগুলো পাশ কাটানোর জন্য তারাই (সরকার) একটার পর একটা ঘটনা ঘটিয়ে জনগণের দৃষ্টিকে বিভ্রান্ত করতে চায়।”
“আমাদের জনগণের মূল যে সমস্যা, সেই সমস্যাটা হচ্ছে আমরা সুষ্ঠু জবাবদিহিমূলক সরকার চাই, ব্যবস্থা চাই; যে ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে মানুষের কথা বলার অধিকার থাকবে, যারা ক্ষমতায় থাকবে তাদের জবাবদিহি থাকবে। এই ব্যবস্থাগুলো থাকবে, সেখানে জনগণ তার কথা বলতে পারবে।”
আলোচনা সভায় নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, “লজ্জা হওয়া দরকার তার। এই মহিলা কীভাবে প্রধানমন্ত্রী থাকেন। তার চাইতে দুঃখজনক হচ্ছে, তিনি ও তার চামচা যারা, তারা সবাই বলছেন, এই যে যারা শ্লোগান দিচ্ছে, ‘আমি কে তুমি কে, রাজাকার রাজাকার’। মানে নিজেদেরকে রাজাকার বলছে না।”
তার ভাষ্য- প্রধানমন্ত্রী তাদেরকে রাজাকার বলছেন, তাই বিদ্রূপ করে বলছে, তিনি আমাদের রাজাকার বলেছেন। পাল্টা স্লোগান দিচ্ছে, তুই রাজাকার, তুই রাজাকার। এটাই ঠিক, এইটাই ঠিক। এই রাজাকার আর মুক্তিযোদ্ধার তকমা নিয়ে দেশ শাসন করবার চেষ্টা করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে সারা দেশকে নৃশংসভাবে শোষণ, দমন-নিপীড়ন করবার চেষ্টা করছেন। এই ছাত্ররা তার বিরুদ্ধে জেগেছে।
কোটা আন্দোলকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলায় গুরুতর আহতদের প্রসঙ্গ টেনে মান্না বলেন, “হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আমার আপনার সন্তানরা শিক্ষার্থীরা রক্তাক্ত আহ্বান করেছে, ’১৮ সালেও যখন আন্দোলন হয়েছিল তখন কোটায় যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা বলেছিলেন, উনার মধ্যে আমি মায়ের ছবি দেখি। সামনে তার ছবি দিয়ে মিছিল করেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই। যখন আন্দোলন শেষ হয়েছে, তখন মাইরের চোটে সোজা হয়ে গেছে।”
“আর এখন যারা আন্দোলন করছে, তারা দুই দিনের মধ্যেই সরাসরি ঘোষণা করেছে, তুমি রাজাকার্। আর সমস্ত বাংলার জনগণের কাছে, বুদ্ধিজীবীদের কাছে যারা লেখে, চিন্তা করে, যারা মানুষকে ভালোবাসে, দেশকে ভালোবাসে তাদের কাছে আবারও বলি, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে রক্তাক্ত শিক্ষার্থীরা আমাদের কাছে বলছেন, আমাদের রক্ষা করেন, আমাদের পাশে দাঁড়ান এই আন্দোলনের সাথে থাকেন।
“এটাই আজকে বাংলাদেশের আবেদন। এই স্বৈরাচারকে যদি উৎখাত করতে হয়, এই নৃশংস শাসনের যদি অবসান করতে হয়, তাহলে তাদের সাথে দাঁড়াতে হবে আমাদের সবাইকে, আমাকে আপনাকে প্রত্যেককে এই লড়াইয়ের মধ্যে অংশ নিতে হবে।”
আলোচনা সভায় অন্যান্যের মধ্যে ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, বিএনপির বরকত উল্লাহ বুলু, মোহাম্মদ শাহজাহান, নুর মোহাম্মদ খান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক মাহবুবউল্লাহ বক্তব্য দেন।
২০১৮ সালে সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে কোটা বাতিল করে জারি করা পরিপত্র হাই কোর্ট অবৈধ ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা দুই সপ্তাহ ধরে টানা আন্দোলন চালিয়ে আসছে।
এর মধ্যে রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর এক বক্তব্য ঘিরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পরদিন ক্যাম্পাসে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এর প্রতিবাদে মঙ্গলবারও কর্মসূচি পালন করছেন আন্দোলনকারীরা।