জনবান্ধব বাজেট দেওয়ার দাবিতে শনিবার বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক এসেছে বামপন্থিদের পক্ষ থেকে।
Published : 06 Jun 2024, 11:00 PM
প্রস্তাবিত বাজেটকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ এর ‘প্রেসক্রিপশনে দেওয়া বাজেট’ আখ্যা দিয়ে অধিকাংশ বামপন্থি দল তা প্রত্যাখ্যান করেছে, কেউবা ‘গণমুখী’ করার দাবি নিয়ে সরব হয়েছে।
বাম নেতাদের অনেকেই মনে করছেন, আইএমএফের শর্ত পূরণ করা ছাড়া সরকার এ বাজেট দিতে পারেনি। এ বাজেটকে ‘সংকটের চক্রে ঘূর্ণায়মান দিশাহীন বাজেট’ আখ্যা দিয়ে তা প্রত্যাহার এবং জনবান্ধব বাজেট দেওয়ার দাবিতে শনিবার বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক এসেছে বাম দলগুলোর একটি জোটের পক্ষ থেকে।
বৃহস্পতিবার বিকালে জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব উত্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তবে এ বাজেট নিয়ে খুশি নন ক্ষমতাসীসন আওয়ামী লীগের জোট শরিক, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন।
বাজেট উপস্থাপন শেষ হলে সংসদ অধিবেশন থেকে বেরিয়ে তিনি বলেন, “আমি খুব একটা আশাবাদী হইনি এই বাজেট দেখে। বর্তমানে যে বাস্তবতা, সেই বাস্তবতায় জনজীবনে যে সংকটগুলো রয়েছে, সেগুলো নিরসনে বিস্তারিত বিবরণীতে কী আছে আমি জানি না। কারণ আমরা (বাজেটের) সংক্ষিপ্ত বিবরণী দেখেছি।
“এমন কোনো সাহসী পদক্ষেপ আমরা দেখিনি, যার মধ্য দিয়ে অর্থপাচার, ব্যাংকিং খাতে নৈরাজ্য থেকে শুরু করে; যেমন দুর্নীতির প্রশ্নে আলোচনাই এর মধ্যে আসেনি।”
এ বাজেটে সংকটের দায় ‘জনগণের ওপর রেখে দেওয়ার’ মত কিছু একটা দেখছেন মেনন। ‘জনগণ নিজেরা সমাধান করুক’, এ ধরনের একটা জায়গায় বাজেটে রয়ে গেছে বলে মনে করছেন মেনন।
“আমার কাছে মনে হয়েছে, অতীতের ধারাবাহিকতার সঙ্গে নতুন বাজেটের পার্থক্য খুব একটা নেই।”
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি বলেন, “আইএমএফের প্রেসক্রিপশনে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। প্রায় এক ঘণ্টার সংক্ষিপ্ত বিবরণ, তার মধ্যে বিস্তারিত নেই। তবে আমরা জানি যে, আইএমএফের শর্ত পূরণ করা ছাড়া এ বাজেট তারা (সরকার) দিতে পারেনি।”
মেননের মত একই অভিযোগ বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ এর সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজেরও। তারও অকপট মন্তব্য- আইএমএফ এর ‘পরামর্শ মেনে’ এই বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে।
এক বিবৃতিতে এ বাজেটকে ‘সংকটের চক্রে ঘূর্ণায়মান দিশাহীন’ বাজেট আখ্যা দিয়েছেন তিনি।
“সরকারের দুর্নীতি, অপচয় ও লুণ্ঠনমূলক নীতির দায় জনগণের ওপর চাপিয়ে কর ও ভ্যাট বৃদ্ধির বাজেট জনজীবনে দুর্ভোগ আরও বহুগুণ বাড়াবে।”
বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, “জিডিপির অনুপাতে এটি গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ছোট বাজেট। বাজেট ছোট হলেও সরকারি ব্যয় কমবে না, বরং জনগণের ওপর কর ও ভ্যাটের বোঝা চাপিয়ে আয় বাড়ানোর নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
দেশি-বিদেশি ঋণের বোঝা, অর্থপাচার ও ব্যাংক খাত লুটপাটের মত বিষয়ে ২০২৪-২৫ এর বাজেট কোনো দিশা নেই বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “গত অর্থবছরে জনজীবনে দুর্ভোগ বয়ে নিয়ে এসেছিল দ্রব্যমূল্য, মূল্যস্ফীতি, টাকার মানের অবনমন, ডলার সংকট ও ডলার পাচার, দেশি-বিদেশি ঋণ এবং তাদের সুদ-আসল পরিশোধ খাতে ব্যয় বৃদ্ধি, রিজার্ভ সংকট ও ব্যাংক খাতে লুটপাট।
“এসব নিয়ে এত আলোচনার পরও সংকট নিরসনে পদক্ষেপ না নেওয়ায় এবং বাজেটেও সমাধানে কোনো দিক-দিশা না থাকায় সামনে সংকট আরও ঘনীভূত হবে।”
বাজেট নিয়ে নিজ্স্ব মূল্যায়ন দেওয়ার পশাপাশি বাম গণতান্ত্রিক জোট কেন্দ্রীয় পরিচালনা পরিষদের পক্ষে যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন নেতারা।
জোট সমন্বয়ক ও বাসদের সাধারণ সম্পাদক কমরেড বজলুর রশীদ ফিরোজ, সিপিবি সভাপতি শাহ আলম, সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা শিশু, বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবীর জাহিদ, বাসদ (মার্কসবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নির্বাহী সভাপতি আব্দুল আলীর সই করা একটি বিবৃতিতে বাজেট নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়েছে।
তাদের দৃষ্টিতে নতুন বাজেট ‘গতানুগতিক, ঋণনির্ভর ও ঘাটতির বাজেট’। এটি প্রত্যাখ্যান করে গবির-মেহনতি মানুষের পক্ষে ‘গণমুখী’ বাজেট দেওয়ার আহ্বান রেখেছেন তারা।
বিবৃতিতে নেতারা বলেন, ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি বাজেটে দেশি-বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভর করা হয়েছে। এমনিতেই সরকার ঋণের ভারে জর্জরিত। ঋণের সুদ পরিশোধের জন্যই বাজেটে বিরাট অংকের ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা অর্থাৎ মোট বাজেটের ৭ ভাগের ১ ভাগ বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
তাদের অভিযোগ, ব্যাংকগুলো থেকে সরকার ঋণ করায় এবং খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ভুগে দেউলিয়া হওয়ার পথে। আর্থিক খাতের সংকট নিরসনে বাজেটে কোনো দিক নির্দেশনা নেই। বেকার সমস্যার সমাধান ও কর্মসংস্থানেরও কোনো দিক নির্দেশনা বাজেটে নেই।
বাজেটে শিক্ষা-স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা ও কৃষি খাতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি অভিযোগ করে বাম জোটের নেতারা বলছেন, টাকার অবমূল্যায়, মূল্যস্ফীতি ও জিডিপি বিবেচনায় নিলে বাজেটে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কৃষি এবং সামাজিক সুরক্ষা খাতেও বরাদ্দ বাস্তবে বাড়েনি। টাকার অংকে সামাজিক সুরক্ষা খাতে ১০ হাজার কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হলেও বাস্তবে তা পেনশনভোগী ও মুক্তিযোদ্ধা ভাতায় চলে যাবে। উপরন্তু কৃষি খাতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ ‘কমানো’ হয়েছে।
বাজেটে শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিশ্চয়তার জন্য রেশনিং এর জন্য কোনো বরাদ্দ না রাখায় তারা সরকারের সমালোচনা করেছেন; বলেছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং দুর্নীতি রোধে কোনো কার্যকর দিক নির্দেশনা বাজেটে নেই।
বিবৃতিতে তারা লিখেছেন, যেখানে আজিজ, বেনজীর, আনারে ‘সরকারের দুর্নীতির ভয়াবহতা’ ফুটে উঠেছে, সেখানে এবারও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রেখে দুর্নীতিকে আরও উৎসাহিত করার ব্যবস্থা হচ্ছে।
বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবীর পৃথক বিবৃতিতে বলেন, এ বাজেট জনগণের জীবনে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্বের চাপ বাড়াবে। অর্থনীতির সংকট সামাল দিতে এবারের বাজেটে রাজস্ব আয় বাড়াতে ভ্যাট ও করের ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে। ঋণের শর্তে আইএমএফ যা যা করতে বলেছে অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তব্যে সেগুলোর বেশিরভাগ বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছেন।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এক বিবৃতিতে প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘গতানুগতিক’ আখ্যা দিয়েছেন। স্থিতাবস্থা বজায় রাখায় প্রচেষ্টার বাইরে নতুন বা বেশি কিছু তারা এ বাজেটে দেখছেন না।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ডলার সংকট মোকাবেলা, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতা দূর করা, রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, আভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং খাত এবং বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি বাজেট বাস্তবায়ন ও আগামীর অর্থনীতির জন্য ‘কঠিন চ্যালেঞ্জ’ হবে বলে মনে করছে জাসদ।
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাজেট কাঠামোর প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও সংশোধনের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী ও সরকারকে ‘খোলা মন নিয় ‘ আলোচনা করে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন দলটির নেতারা।