সবাইকে শনিবারের সমাবেশে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “যে যেখানে আছেন, ভয় করবেন না। বেরিয়ে আসুন।”
Published : 01 Nov 2024, 04:43 PM
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ‘দোসর’ বলে জাতীয় পার্টিকে সমালোচনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে আরো কয়েকটি দল নির্বাচনে অংশ নিলেও শুধু জাতীয় পার্টির দিকে অভিযোগের আঙুল তোলা নিয়েও প্রশ্ন রেখেছেন তিনি।
জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগের প্রেক্ষাপটে শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে এসে জি এম কাদের শনিবারের পূর্বঘোষিত সমাবেশ কর্মসূচি বহাল রাখার কথাও বলেন।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকার বিজয়নগরে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
এই ঘটনার কিছুক্ষণ আগেই ফেইসবুকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ জাতীয় পার্টিকে উদ্দেশ্য করে লেখেন, “এবার এই জাতীয় বেইমানদের উৎখাত নিশ্চিত।”
শনিবার ওই কার্যালয়ের সামনে সমাবেশের প্রস্তুতির মধ্যেই অগ্নিসংযোগ ঘটনার প্রতিক্রিয়া জানাতে বানানীতে দলটির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন জি এম কাদের।
তিনি বলেন, “২ তারিখে যে প্রোগ্রাম দিয়েছি সেই প্রোগ্রাম চালু থাকবে। নেতাকর্মী ভাই বোনেরা যে যেখানে আছেন একটা কথা মনে রাখবেন, ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করো। হাত দিয়া যদি প্রতিবাদ করতে না পারে মুখ দিয়ে করো। মুখ দিয়ে যদি প্রতিবাদ করতে না পারো অন্তর দিয়ে ঘৃণা করো। আমাদের সেটা করতে হবে। তার জন্য যদি জীবন চলে যায়, আমরা জীবন দিতে প্রস্তুত আছি।”
তিনি বলেন, “দেশের ভালোর জন্য আমরা জীবন দিব। আমরা কোনো অপরাধ করিনি। আমাদেরকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে অপরাধী করা হচ্ছে। কেন করা হচ্ছে আমরা জানি না। কার স্বার্থে আমরা জানি না।”
সবাইকে শনিবারের সমাবেশে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “যে যেখানে আছেন, ভয় করবেন না। বেরিয়ে আসুন।”
দলীয় কার্যালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাটিকে অনাকাঙ্ক্ষিত উল্লেখ করে জি এম কাদের বলেন, “গতকাল ছাত্র-জনতার নামে কিছু মানুষ এসে পার্টি অফিসে সন্ধ্যার পরে হামলার করে। আমাদের যারা কর্মী কাজ করছিলেন, তারা প্রতিহত করে ফিরিয়ে দেয়। পরে তারা আবার সংঘবদ্ধভাবে আবার এসে অগ্নিসংযোগ করেছে, ভাঙচুর চালিয়েছে।”
রাজু ভাস্কর্য থেকে ‘ছাত্র অধিকার পরিষদ’র এক নেতার নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, “২৯ অক্টোবর রাতেও মশিউর, আনোয়ার ও ইসমাইলের নেতৃত্বে কিছু মানুষজন এসে ভাঙচুর করে। বর্তমানে তারা নাগরিক কমিটিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন বলে জানা গেছে।”
জাতীয় পার্টি রাজনৈতিক সহাবস্থানে বিশ্বাসী উল্লেখ করে চেয়ারম্যান বলেন, হঠাৎ করে সম্প্রতি জাতীয় পার্টিকে ‘অপবাদ দিয়ে ব্র্যান্ডিং করার চেষ্টা চলছে’।
জিএম কাদের বলেন, “বলা হচ্ছে আমরা আওয়ামী লীগের দোসর। সে হিসেবে তাদের সব অবপর্মের জন্য আমরা দায়ী। এজন্য আমাদের শাস্তি ভোগ করা উচিৎ, রাজনীতি থেকে বের করে দেওয়া উচিৎ। এটা একটা ক্ষুদ্র গোষ্ঠী দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছিল, যেটির কোনো সত্যতা নেই, কোনো জাস্টিফিকেশন নেই। সেটার জন্য গুরুত্ব দিয়ে দেখিনি এতোদিন। তবে ইদানিং খুব বড়সড়ভাবে বলা হচ্ছে, আমাদের পেছনে ষড়যন্ত্র চলছে।”
“আমরা আওয়ামী লীগের দোসর কীভাবে? নবম সংসদ ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সাথে মহাজোট গঠন করেছিলাম। মহাজোটের নির্বাচনটি ছিল সুষ্ঠু ও অবাধ, পৃথিবীময় গ্রহণযোগ্যতা ছিল। সে নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে শেখ হাসিনার মন্ত্রী ছিলাম। তার কাজের সাথে ছিলাম। কিন্তু না, আমি ওনার কোনো অপকর্মে ছিলাম না। আমি শুধু জাতীয় পার্টিকে প্রেজেন্ট করছি মহাজোটে।”
মতের অমিলে মন্ত্রিত্ব থেকে অব্যাহতিও নিতে চেয়েছিলেনন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “হজ ফ্লাইটের সময় সেকেন্ডহ্যান্ড প্লেন দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন তিনি (শেখ হাসিনা), যেটি আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু আমি নতুন প্লেন নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলাম। যখন তিনি জোর-জবরদস্তি করার চেষ্টা করেছিলেন, তখন আমি রিজাইন দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম।
“কাজেই ওনাদের যে কাজগুলো জনবিরোধী, অনৈতিক এগুলোতে আমরা শেখ হাসিনার সঙ্গে একাত্ম ছিলাম না। আমি রেজিগনেশন দিয়েছিলাম। পরে রেজিগনেশন গ্রহণ না করে একটা কমিটি গঠন করেন তিনি। সেই কমিটিও আমার সিদ্ধান্তের সঙ্গে সায় দেওয়ায় আমাকে রেজিগনেশন দিতে হয়নি। মন্ত্রী সভায় থাকার পরেও বিভিন্ন সময় তার কাজকর্মের সমালোচনা করেছিলাম।”
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, “অনেকে বলে ১৫ বছরের অবৈধ শাসনকে আমরা নির্বাচন করে বৈধতা দিয়েছি। এখানে একটু কারেকশান আছে। ১৫ বছরের নয়, ১০ বছরের যদি অবৈধ বলেন, সেটি অবৈধ। ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। কারণ ২০০৮ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত সম্পূর্ণ বৈধ ছিল। সরকার হিসেবে খারাপ-ভালো আপনি বলতে পারেন।”
বৈধতা শুধু জাতীয় নির্বাচনে গেলেই দেওয়া হয় কি না এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, “ওই নির্বাচন কমিশনের আন্ডারে, ওই প্রধানমন্ত্রীর আমলে, ওই সরকারের সময় বিএনপি এবং প্রায় সব দল স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। তারা বৈধতা দেয়নি? তারাতো সেই সরকারের ইলেকশান সিস্টেমকে মেনে নিয়েই নির্বাচন করেছে। ২০১৮ সালে প্রায় সব দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে।
“তাহলে শেখ হাসিনার সরকারের আমলে সেই শেখ হাসিনার নির্বচন পদ্ধতির আমলে সব দল বৈধতা দেয় নাই? সমস্ত রাজনৈতিক দল বৈধতা দেয় নাই? খালি জাতীয় পার্টি একাই দিয়েছে? বৈধতার প্রশ্ন যদি বলেন, আইনগতভাবে অবৈধ বলার সুযোগ নাই। আইনগতভাবে এটা বৈধ নির্বাচন হয়েছে। আমাদের দেশের কোনো আইনে নাই নির্বাচনে অংশ নেওয়াটা অপরাধ। এটা অপরাধ কীভাবে আমি জানি না।”
২০২৪ সালে জাতীয় পার্টিকে ‘ব্ল্যাকমেইল’ করে নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় আনা হয়েছে মন্তব্য করে কাদের বলেন, “২০১৪ এর পর থেকে দলটিকে ভাগ করা হয়েছে। একটা টিম করে সরকারি মদতে সব সুবিধা দিয়ে নিজেদের করে নিয়েছে, সে কারণেই জাতীয় পার্টি ভিকটিম। কিন্তু এর সঙ্গে শতকরা দলের ৯০-৯৫ ভাগই যুক্ত ছিলেন না।”
‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করলেও বিএনপির সঙ্গে কখনও জোট করেনি জাতীয় পার্টি’ এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “২০০১ সালেও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে। বিপুল ভোটে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসে পর পর চারবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন। তারা একটি ভবন গঠন করলেন প্যারালাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। র্যাবও ওনারা গঠন করেছেন, এরপর বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছিল। ওয়ান ইলেভেনের পর তো আর বিএনপির সাথে যাওয়ার আর স্কোপ থাকে না।”
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে জাতীয় পার্টির ‘সক্রিয় অংশগ্রহণ’ ছিল দাবি করে তিনি বলেন, “আমরা প্রতিদিন বাচ্চাদের নিরাপত্তার জন্য নামাজ পড়েছি, দোয়া করেছি। সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করেছি আন্দোলনকে সফল করার জন্য। প্রতিদিন স্টেটমেন্ট দিয়েছি। একটা স্টেটমেন্টের জন্যই আমার অনেক ঝুঁকি হতে পারত।”
‘আন্দোলনের সুফল সত্যিকার অর্থে পাওয়া যাচ্ছে কি না এমন প্রশ্ন রেখে জিএম কাদের বলেন, “এখন যেটা দেখতে পাচ্ছি দুর্ভাগ্যজনক। দেশ বিভক্ত হয়ে গেছে। কিছু লোক দেশটা দখল করে ফেলেছে। একটা পবিত্র গ্রুপ, আরেকটা অপবিত্র গ্রুপ সৃষ্টি করেছে। তারা সবাই পবিত্র, ওনারা ঠিক করবেন কে দোষী, কে দোষী না। এভাবে দেশকে বিভক্ত করেছিলেন শেখ হাসিনা। আমার কি রিপিটেশন দেখতে পাচ্ছি?”
“শাসক গোষ্ঠী বিচারের ঊর্ধ্বে থাকবেন, ওনারা ঠিক করবেন কার বিচার হবে। উনি আমার অফিস এসে ভেঙে দিবেন, আগুন জ্বালিয়ে দিবেন, কোনো বিচার হবে না। শেখ হাসিনার সেই বৈষম্যের শিকার যদি আবার হই তাহলে কীভাবে হবে।”