ওই অডিও ‘সুপার এডিটেড’: নিক্সন চৌধুরী

ভোটের মাঠে দায়িত্বরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে গালি ও হুমকি দেওয়ার যে অডিও ফেইসবুকে ভাইরাল হয়েছে, তা ‘সুপার এডিটেড’ বলে দাবি করেছেন ফরিদপুরের সংসদ সদস্য মুজিবর রহমান চৌধুরী নিক্সন।

নিজস্ব প্রতিবেদকও ফরিদপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Oct 2020, 02:22 PM
Updated : 6 Dec 2020, 01:57 PM

গত শনিবার চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদের উপনির্বাচন ঘিরে সরকারি কর্মকর্তাদের হুমকি দেওয়ার জন্য এই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা।

এর কয়েক ঘণ্টা পর মঙ্গলবার বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে উল্টো নির্বাচনে ‘পক্ষপাতিত্বের’ অভিযোগে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তিনি।

নিক্সন চৌধুরী নামে পরিচিত স্বতন্ত্র এই সংসদ সদস্য ভোটের দিন সকালে চরভদ্রাসনের ইউএনওকে ফোন করে হুমকি-ধমকি দেন এবং অপর একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে ‘শুয়োরের বাচ্চা’ আখ্যায়িত করে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তার ওই টেলিফোন আলাপের অডিও ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে, এ ধরনের বক্তব্যের জন্য ওই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন অনেকে।

ওই অডিওর বক্তব্য তার নয় দাবি করে নিক্সন চৌধুরী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “বিভিন্ন সোশাল মিডিয়ায় আমার যে বক্তব্য ও কথা প্রকাশিত হয়েছে, এই বক্তব্য পুরোপুরিভাবে এডিট করা। সকাল ১১টার দিকে আমি টিএনওকে ফোন করেছিলাম যে, আমার একজন কর্মীকে তারা সে মাঠে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল, সেই অপরাধের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট এবং বিজিবি ধরে নিয়ে গিয়েছিল। সেই বিষয়টা অবগত করার জন্যই আমি ফোন করেছিলাম। আর যেটা ছড়ানো হয়েছে সেটা সুপার এডিট করা।

“আপনারা এখানে দেখতে পারবেন যে টিএনওর সঙ্গে আমার আলাপটা দেওয়া হয়েছে। টিএনও একজন বিসিএস ক্যাডার। যদি আমার সঙ্গে টিএনওর কথা সোশাল মিডিয়ায় দেওয়া হয়, উনি তো আইন সম্পর্কে সব জানেন। হাই কোর্টের সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে, রায় আছে সেখানে কারও ফোনের রেকর্ড সোশাল মিডিয়ায় দেওয়া যাবে না। আমার টিএনও এত বোকা না যে, তিনি আইনের লোক হয়ে আইন ভঙ্গ করে সোশাল মিডিয়াতে এটা দিয়ে ভাইরাল করবে। এখন পর্যন্ত আমার টিএনওর কোনো বক্তব্য কিন্তু আসেনি।

“উনার সঙ্গে আমার এ রকম আচরণ করার কোনো প্রশ্নই উঠে না। যে অডিও ক্লিপ বানানো হয়েছে এটা পুরো ভিত্তিহীন। আপনারা চরভদ্রাসনের ইউএনকে জিজ্ঞেস করেন, আমি এমন কোনো আচরণ করেছি কি না। হ্যাঁ, আমি ফোন করেছিলাম একজনকে ধরে নিয়ে গেছে সেই বিষয়ে। বাকি যে বিষয়টা সেটা পুরাই ভিত্তিহীন এবং এটাকে ভয়েস এডিট করে আমার শত্রু পক্ষ যেটা আছেন।”

সম্প্রতি অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে ফরিদপুরে আওয়ামী লীগ নেতা বরকত-রুবেল গ্রেপ্তার হওয়ার পর তিনিই সবার আগে প্রশাসনের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছিলেন বলে জানান নিক্সন চৌধুরী।

“দীর্ঘদিন ধরে আমার বিরুদ্ধে অনেক বড় বড় নেতারা আছেন সবাই এক হয়ে এই ষড়যন্ত্রটা করেছেন। এই যে আমার টিওনও আপা উনার সঙ্গে আমার কিন্তু মধুর সম্পর্ক,” বলেন তিনি।

তবে অডিও নিয়ে তার এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন চর ভদ্রাসনের ইউএনও জেসমিন সুলতানা।

যে অডিও ভাইরাল হয়েছে, তাতে তাকে বলা এই সাংসদের বক্তব্য হুবহু উঠে এসেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদের উপ-নির্বাচন ঘিরে জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে ‘পক্ষপাতমূলক আচরণের’ অভিযোগ তুলে মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য মুজিবর রহমান চৌধুরী (নিক্সন), যার বিরুদ্ধে একজন সরকারি কর্মকর্তাকে হুমকি-ধমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় ইউএনও মঙ্গলবার রাতে বলেন, “উনি ভোটের দিন সকাল সাড়ে ৯টা থেকে পৌনে ১০টার মধ্যে ফোনটা করেন। উনি যে কথা বলেছেন তা হুবহু ওই অডিওতে এসেছে, দাড়ি-কমাও পরিবর্তন হয়নি।”

তিনি জানান, ভোটের সকালে বুথে ঢুকে ভেতরে সিগারেট খাওয়া ও জাল ভোট দেওয়ার চেষ্টা করায় নিক্সন চৌধুরীর এক অনুসারীকে আটক করেছিলেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে আসা ভাঙ্গা উপজেলার একজন সহকারী কমিশনার (এসি ল্যান্ড)।

এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সাংসদ নিক্সন চৌধুরী তাকে ফোন করেন বলে জানান ইউএনও জেসমিন সুলতানা।

ওই অডিওতে তাকে উদ্দেশ্য করে নিক্সন চৌধুরীকে বলতে শোনা যায়, “শুয়রের বাচ্চা, কুত্তার বাচ্ছা.... আমার লোকদের গাড়িতে উঠায়ছে ক্যান; এখনই ছাড়তে বলেন। ওর কত বড় সাহস শুয়ারের বাচ্চা, আমি চরভদ্রাসন আসতেছি, ওরে আমি দেখতেছি।”

সাংসদের এই ফোনের পর আটক ব্যক্তিকে ছেড়ে দেওয়া হয় জানিয়ে ইউএনও বলেন, “৫ ‍মিনিটের মধ্যে তাকে না ছাড়লে লোকজন নিয়ে উপজেলা ঘেরাও করার হুমকি দিয়েছিলেন উনি।”

তবে এই অডিও তিনি সোশাল মিডিয়ায় দেননি জানিয়ে এই সরকারি কর্মকর্তা বলেন, “এটা সোশাল মিডিয়ায় কীভাবে এসেছে আমার জানা নেই। আমিও দেখে অবাক হয়েছিলাম। তবে নির্বাচনের দিন দায়িত্বরত সব কর্মকর্তার ফোন নজরদারিতে থাকে।

“এ বিষয়ে আমি একটা কাজ করেছিলাম। উনার ফোনের পরপরই বিষয়টি জেলা প্রশাসককে লিখিতভাবে জানিয়েছিলাম।”

ভোটের দিন সন্ধ্যায় চরভদ্রাসন উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশে প্রশাসনকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগে নিক্সন চৌধুরীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার।

ওই সমাবেশে নিক্সন বলেছিলেন, “প্রশাসনের মধ্যে লুকাইয়া থাকা ওই জেলা প্রশাসক এ নির্বাচনে ১২ জন ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে নৌকার কর্মীদের অ্যারেস্ট করছে, পিটাইছে ওই জেলা প্রশাসক।”

এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে নিক্সন বলেন, “ভাঙ্গা, সদরপুর, চরভদ্রাসন এই তিন উপজেলা নিয়ে আমার নির্বাচনী এলাকা। চরভদ্রাসন থেকে আমার বাড়ি প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে। নির্বাচন চলাকালে এমনকি নির্বাচনী প্রচার প্রচারণার সময় আমি চরভদ্রাসন এলাকায় যাইনি।ভোট শেষ হওয়ার পর প্রশাসনের তাণ্ডবে ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের শান্ত করতে গিয়েছিলাম, সেটাও প্রশাসনের অনুরোধে।”

তিনি কোনো নির্বাচনী আচরণ বিধি লংঘন করেননি দাবি করে এই সংসদ সদস্য বলেন, “নির্বাচনের আচরণবিধি, আমি বলেছি যে আমি নালিশ করেছি, এইটার বিষয়ে আসি টিএনও আপাকে জানাচ্ছিলাম এইটা অবশ্যই নির্বাচনী আচরণ বিধির মধ্যে পড়ে না।

“আরেকটা জিনিস, নির্বাচনে পরে যখন ফলাফল প্রকাশ করা হল তখন আমার একটা বক্তব্য দিয়েছে যে এটাও পুরাপুরি এডিট করা। আমার কাছে প্রমাণ আছে, আমি যে বক্তব্য দিছি সেটা এডিট করে দিয়েছে।”

উল্টো নির্বাচনে ‘পক্ষপাতিত্ব এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির’ অভিযোগে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসকের বিচার দাবি করেন নিক্সন চৌধুরী।

তিনি বলেন, “এই নির্বাচনে আপনারা খবর নিয়ে দেখবেন বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী একটা অভিযোগও করে নাই যে, তার সাথে কেউ খারাপ আচরণ করেছে, নির্বাচনে কোনো বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে, কেউ হুমকি দিয়েছে, কেউ কোনো ভয়-ভীতি দেখিয়েছে। তাহলে চারজন ম্যজিস্ট্রেটের জায়গায় ইলেকশনের আগের দিন ১৩ জন কেন দেওয়া হল? তারপরেও ১৩ জন দিয়েছে তাতে সমস্যা নেই। নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে এর জন্য আমি ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের চারজনকে চাওয়ার চিঠি আছে, ১৩ জনের কি সেই চিঠি আছে?

“সারা দিনে বিজিবি নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটরা যে অবস্থা করেছেন, এর মধ্যে একজন জুডিশিয়াল ম্যজিস্ট্রেট। নির্বাচনের দিন সকালে অনেক সেন্টারে নির্বাহী ম্যজিস্ট্রেটরা মারমুখী অবস্থান নেয়। তাতে নিরীহ ভোটাররা ভীত হয়ে পড়ে। অনেক ভোটার ভোট দেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। অনেক সেন্টারে নির্বাহী ম্যজিস্ট্রেটের পেশকারদের ভোটকেন্দ্রের ভেতরে বসে থাকতে দেখা যায়। নগরকান্দায় ম্যাজিস্ট্রেটের পেশকার, যিনি ভেতরে বসে আছেন (ছবি দেখিয়ে বলেন)।”

ভোটের দুই দিন আগে অবস্থান বদলে নৌকার প্রার্থীকে সমর্থন করা নিক্সন চৌধুরী বলেন, “ম্যাজিস্ট্রেটরা আমার অনেক কর্মীকে বিনা কারণে আটক করে জরিমানা করেন। তিনজন নৌকার এজেন্টকে ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেন। বিষয়টা হল ১৩ জন ম্যাজিস্ট্রেটকে আনা হয়েছে, অথচ বিগত দিনে যত নির্বাচন হয়েছে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের বেশি কাজ করেনি।

“প্রতিটা সেন্টারে বিজিবি সদস্যদের নিয়ে আতঙ্ক তৈরি করেছে যেন ভোটাররা না আসে। এবং যেই কেন্দ্রগুলোতে নৌকার ভোটার বেশি সেখানেই তাণ্ডব চালিয়েছে। এর জন্য ডিসিরও বিচার চাওয়া আমার গণতান্ত্রিক অধিকার। বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী চর এলাকায়, সেখানে কোনো তাণ্ডবও করে নাই। সেখানে কোনো অ্যারেস্টও করে নাই।”

আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া নিক্সন চৌধুরী বলেন, “উনারা আমার সমর্থনের প্রার্থীকে ঠেকানোর জন্য বিএনপির প্রার্থীকে জেতাতে ডিসি সাহেবের নেতৃত্বে এই তাণ্ডবগুলো চালালো হয়েছে। আমি কোনো আইন ভঙ্গ করে থাকলে অবশ্যই আমার বিরুদ্ধে মামলা হবে।

“আইন তো ডিসিও ভঙ্গ করেছে। সে কি পারে ৪৮ ঘণ্টা অতিক্রম হওয়ার আগে আমার বাড়িতে টিএনওকে পাঠাতে? যদি আমার একার বিরুদ্ধে মামলা হয় তাহলে ডিসির বিরুদ্ধেও মামলা হবে।”

নিক্সন বলেন, “নির্বাচনের পরদিন সকালে ৯টা থেকে ১০টায় ডিসি সাহেব কেন নির্দেশ দিয়ে টিএনওকে আমার বাড়ি পাঠালেন, এই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সে আমার বাড়ি আসতে পারে? তাইলে সেও তো আইন ভঙ্গ করেছে। ডিসি সাহেবও তো আইন ভঙ্গ করেছেন, সে কেন তার ইউএনওকে আমার বাড়ি পাঠালেন? আমি যদি আইন ভঙ্গ করে থাকি তাহলে নির্দেশ দিয়ে ইউএনওকে আমার গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে তিনিও আইন ভঙ্গ করেছেন।

“একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কোনোভাবেই এই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমার বাড়ি আসতে পারে না। আমার বাড়িতে হাজার হাজার মানুষ ছিলেন, সবাই দেখেছে। টিএনও আপা নিজেও স্বীকার করবেন যে, ডিসি সাহেব নির্দেশ দিয়ে আমার বাড়ি পাঠিয়েছিলেন। তাহলে ডিসি সাহেবও আচরণ বিধি লংঘন করেছেন। তার বিরুদ্ধেও ক্যাবিনেটে এবং নির্বাচন কমিশনে ব্যবস্থা নেওয়া, আমি মনে করি আমাদের এই দাবি করা গণতান্ত্রিক অধিকার।”

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ডিসির ‘নানা ধরনের অপকর্মের নির্দেশনার’ অডিও রেকর্ড তার কাছে আছে বলেও দাবি করেন নিক্সন চৌধুরী।

তিনি বলেন, “আমার কাছে, আমার ফোনে অনেক ক্লিপ আছে। ডিসি ও টিএনও আমার সঙ্গে কথা বলেছে এবং ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের ব্যাপারে অনেক রেকর্ডিং আছে। আমি তো সেগুলো সোশাল মিডিয়াতে দিচ্ছি না। আমি তো হাই-কোর্টের আদেশ অবমাননা করতে পারি না।

“অনিয়ম করার জন্য ডিসি টিএনওকে প্রেসার করেছে, সেই ক্লিপগুলো আমার কাছে আছে। আমি জায়গামতো সেই ক্লিপগুলো অবশ্যই দেব। যদি আমার দরকার মনে হয়।”