জাপায় সমঝোতা: চেয়ারম্যান জিএম কাদের, বিরোধী দলীয় নেতা রওশন

দুই শীর্ষ নেতার বিরোধে বিভক্ত জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছেছে দুই পক্ষ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Sept 2019, 05:56 AM
Updated : 9 Sept 2019, 10:04 AM

ঠিক হয়েছে, প্রয়াত নেতা হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের ‘নির্দেশনা’ অনুযায়ী তার ভাই জিএম কাদেরই দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন। আর সংসদে বিরোধী দলীয় নেতার দায়িত্বে থাকবেন এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ।  

এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া রংপুর-৩ আসনে কে প্রার্থী হবেন, সে বিষয়ে পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিব বসে সিদ্ধান্ত নেবেন। 

শনিবার রাতে বারিধারার কসমোপলিটন ক্লাবে রওশন ও জিএম কাদেরপন্থি নেতাদের বৈঠকে এই সমঝোতা হয়। রোববার দলের বনানীর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ সেই সিদ্ধান্ত জানান।

তিনি বলেন, “প্রথমে আমাদের যে বিষয়টি ছিল, সেটি হল চেয়ারম্যানের দায়িত্ব কে পালন করবেন। এটা নিয়ে একটি বিতর্ক ছিল। সেটি কাল সমাধান হয়ে গেছে।

“চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন জাতীয় পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যন এবং হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের নির্দেশিত যিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ানম্যান… জিএম কাদের সাহেব দলের দায়িত্ব পালন করবেন চেয়ারম্যান হিসেবে।

“এবং বেগম রওশন এরশাদ, যিনি আমাদের চেয়ারম্যানের পত্নী, তিনি সংসদে বিরোধী দলীয় নেতার দায়িত্ব পালন করবেন।”

রাঙ্গাঁ বলেন, “আরেকটি বিষয় এসেছিল, রংপুরের উপ নির্বাচন নিয়ে। সেখানে সাদ এরশাদের (এরশাদের ছেলে) পক্ষে প্রস্তাব রাখা হয়েছিল, বিপক্ষেও কথা হয়েছে।  সিদ্ধান্ত হয়েছে, মহাসচিব ও চেয়ারম্যান বসে রংপুরের বিষয়টি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন- প্রার্থী কে হবে। আজ বা কালকের মধ্যে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেব। তখন জানতে পারবেন।”

রোববার দুপুরে সংসদ ভবনে জাতীয় পার্টির পার্লামেন্টারি কমিটির বৈঠক বসবে। ওই বৈঠকের পর বিরোধী দলীয় নেতা নির্ধারণের বিষয়ে স্পিকারকে নতুন করে চিঠি দেওয়া হবে পার্টির পক্ষ থেকে।

পরে বিরোধী দলীয় নেতাই সংসদে বিরোধী দলীয় উপ নেতা ও বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ নির্ধারণ করবেন।

নেতৃত্বের লড়াই

এরশাদের স্ত্রী রওশন বিরোধীদলীয় উপনেতার পাশাপাশি জাতীয় পার্টির জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন। এরশাদের ভাই জি এম কাদের ছিলেন কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্বে।

পার্টি চেয়ারম্যান এরশাদই সংসদীয় দলের নেতা ও বিরোধী দলীয় নেতার দায়িত্বে ছিলেন।

এরশাদের মৃত্যুর পর কাদের দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন, যদিও তাতে রওশনের আপত্তি ছিল।

রংপুর-০৩ আসনে উপনির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে তাদের বিরোধ চরম আকার ধারণ করে।

রওশনের ছেলে সাদ এরশাদ বাবার আসনে প্রার্থী হতে চাইলেও রংপুরের নেতারা তার বিরোধিতায় নামেন।

এর মধ্যে কাদের তাকে বিরোধীদলীয় নেতা ঘোষণা করতে গত সপ্তাহে স্পিকারকে চিঠি দিলে পাল্টা চিঠিতে তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন রওশন।

জি এম কাদের আবার নির্বাচন কমিশনে চিঠি পাঠিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে দলের প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষমতা তার বলে দাবি করেন। প্রার্থী মনোনয়নে রওশন আবার পাল্টা সংসদীয় বোর্ড গঠন করেন।

এরপর রওশনের উপস্থিতিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তার সমর্থকরা তাকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা দেন।  

দেবর-ভাবির পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপে দলের শীর্ষনেতারা দুই ভাগ হয়ে যান, কর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে বিভ্রান্তি। এ অবস্থায় শনিবার রাতে বারিধারার ক্লাবে সমঝোতা বৈঠকের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

এদিকে রংপুর-৩ আসনে উপনির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী কে হবেন, সেই সিদ্ধান্ত শনিবার হওয়ার কথা ছিল। শনিবার বিকালে মনোনয়ন প্রত্যাশী পাঁচ প্রার্থীর সাক্ষাৎকারও নেন জি এম কাদের।

কিন্তু সমঝোতার বৈঠকের আগে তা ঘোষণা না করে জি এম কাদের বললেন, তারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থী দেখে তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন কাকে করবেন দলের প্রার্থী।

রওশনও ছেলে সাদ এরশাদকে দলের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা না দিয়ে ‘অনিবার্য কারণ’ দেখিয়ে তা স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেন।

রওশন এরশাদ সমর্থকদের মধ্যে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, ফখরুল ইমাম, মুজিবুল হক চুন্নু, সেলিম ওসমান ও এস এম ফয়সাল চিশতী রাতে বারিধারার কসমোপলিটন ক্লাবের ওই বৈঠকে অংশ নেন।

জি এম কাদেরের পক্ষের নেতাদের মধ্যে ছিলেন কাজী ফিরোজ রশীদ, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী ও সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা।

বৈঠকে শুরুতে ‘অনানুষ্ঠানিক’ বলে এড়িয়ে যেতে চাইলেও পরে কাজী ফিরোজ রশীদ দুই পক্ষের সমঝোতার ইংগিত দেন। তিনি জানান, রওশন বিরোধীদলের নেতা হচ্ছেন, দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন জিএম কাদের।

তবে মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাঁই রোববার সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবেন বলে জাতীয় পার্টির প্রেস বিভাগ থেকে রাতে জানানো হয়। 

শনিবার এক সংবাদ সম্মেলন করে জি এম কাদের বলেছিলেন, আগামী ৩০ নভেম্বর ঢাকায় জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হবে। কাউন্সিলে দলের নেতা-কর্মীরাই জাতীয় পার্টির আগামী দিনের নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন। নেতা-কর্মীদের সিদ্ধান্ত তিনি মেনে নেবেন।

তবে কাউন্সিলের তারিখ নিয়ে রওশন সমর্থকদের কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি শনিবার।

‘জাতীয় পার্টি রক্ষা পেয়েছে’

পদ-পদবি নিয়ে দুই শীর্ষ নেতার বিরোধে গত কয়েক দিন ধরে জ্যেষ্ঠ নেতারা যখন পাল্টাপাল্টি বৈঠক আর সংবাদ সম্মেলন করে আসছিলেন, দলের মহাসচিব রাঙ্গাঁ ছিলেন দৃশ্যের বাইরে।  

কয়েক দিন আগেও জি এম কাদেরের পাশে থেকে রাঙ্গাঁ বলেছিলেন, রংপুর-৩ আসনে উপনির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ্বে তিনি তৃতীয় পক্ষের চক্রান্তের আভাস পাচ্ছেন।

কিন্তু রওশন সমর্থকরা দাবি করেন, মহাসচিব রাঙ্গাঁ তাদের সঙ্গেই আছেন। রওশনের সঙ্গে তার ফোনে কথাও হয়েছে।

বৃহস্পতিবার রওশনকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করে এক সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদও বলেন, রাঙ্গাঁই তাদের থাকছেন মহাসচিব।

কিন্তু রাঙ্গাঁর ওই পক্ষে শুনে জি এম কাদেরও অবাক হয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “আমি তো জানি তিনি বিআরটিএ’র মিটিংয়ে। তিনি কী বলেছেন, আমি শুনিনি। আগে জানতে হবে।”

অস্পষ্ট এই অবস্থান নিয়ে রাঙ্গাঁর বক্তব্য জানতে সাংবদিকরা নানাভাবে চেষ্টা করেও তার নাগাল পাচ্ছিলেন না। শনিবার পর্যন্ত তিনি গণমাধ্যমের সামনে আসেননি, ফোনও ধরেননি।

এই পরিস্থিতিতে রাঙ্গাঁর ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও অনেকে রসিকতা করে বিভিন্ন টিপন্নি কাটেন।

জাতীয় পার্টির মহাসচিব রাঙ্গাঁ রোববারের সংবাদ সম্মেলনে রসিকতার সুরেই সে প্রসঙ্গ তোলেন।

তিনি বলেন, “এমনও বলা হয়েছে যে মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ হারিয়ে গেছেন, উনার উচ্চতা ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি না ৯ ইঞ্চি, উনার চুল খাড়া খাড়া, উনার শারীরিক গঠন এইরূপ এইরূপ, উনি এরকম কাপড় পরেন, উনাকে কেউ খুঁজে পেলে বনানীর অফিসে প্রেরণ করবেন।”

আর নিজেকে আড়াল করে রাখার ব্যাখ্যায় রাঙ্গাঁ বলেন, “পরিবারের পিতামাতা যখন বিবাদে জড়ান, তখন সন্তানরা বিপদে পড়েন। দলে বড় ভাই হিসেবে আমি কিছুটা সরে পড়েছিলাম। তবে গত তিন দিনে আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করে গতকালের বৈঠক আয়োজন করেছি। একটা বড় ধরনের ভাঙন থেকে জাতীয় পার্টি রক্ষা পেয়েছে।”