চিকিৎসার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে অনুদান পেলেও অব্যাহত কষ্টের জীবনে প্রয়োজনের সময় দলীয় নেতাদের পাশে না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।
তাদেরই একজন পুরান ঢাকার বাসিন্দা রাশিদা আক্তার রুমা, যার এক পা দিয়ে এখনও রক্ত ঝরে। ঘটনার সময় কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা রাশিদা এখন দলের কোনো পদে নেই।
দুর্দশার কথা তুলে ধরে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পায়ে শত শত স্প্লিন্টার হাড়ের ভিতরে, এই হাড়ের ভিতরের স্প্লিন্টারগুলো যখন উপর নিচে চলাচল করে তখন মনে হয় নিজের পা নিজে কেটে ফেলি। পায়ে খুব যন্ত্রণা করে। ২১ অগাস্ট ঘটনার পরই আমার পা কেটে ফেলতে চেয়েছিল তখন সাবের ভাইসহ কয়েকজন পা কাটতে দেয়নি। আবার যখন কাটতে চাইছিল তখন আপা (শেখ হাসিনা) না করেছেন। তখন আপা বলছে, পা রাখ, যত টাকা লাগে আমি দেব।
“এখন ডান পা কিছুটা ভালো কিন্তু বাঁ পায়ের ক্ষত এখনও শুকায়নি, এই যে দেখেন রক্ত ঝরছে। ১৫ বছরে মধ্যে এই ঘাঁ শুকায়নি। এখন ডাক্তার বলছে, এই পা কেটে ফেলতে হবে, এছাড়া কোনো উপায় নাই।”
রাশিদা জানান, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে সহায়তা হিসেবে এককালীন ১০ লাখ টাকা দেওয়া হয়, যা ব্যাংকে রয়েছে। তার থেকে মাসে আট হাজার টাকা করে পান, যা সংসারের পেছনে ব্যয় হয়। এর বাইরে চিকিৎসা খরচ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়।
“কিন্তু এখন মাসে ১২-১৪ হাজার টাকা খরচ যাচ্ছে, নিজের জায়গা বিক্রি করে চিকিৎসা করছি। দলের কোনো নেতা আমার খবর নেয় না। আমি মরে যাচ্ছি, কেউ খবরও নেয় না।”
চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে গিয়েও লাঞ্ছনার শিকার হতে হয় বলে অভিযোগ করেন রাশিদা।
তিনি বলেন, “যেহেতু আমার পায়ে ঘাঁ, সব সময় পানি ঝরে তাই দুই দিন পর পর হাসপাতালে যেতে হয়, হাসপাতালে গেলে গ্রেনেড হামলার রোগী বললে তারা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, ঠিকমতো চিকিৎসা করে না। বিছানা তো দূরের কথা ফ্লোরে শুয়ে থেকে চিকিৎসা করতে হয়। আমি গত কয়েক দিন আগেও ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে এমন লাঞ্ছনা-বঞ্চনার শিকার হয়েছি।”
ওই হামলার ভয়াবহতা নিয়ে রাশিদা আক্তার রুমা বলেন, “ওই দিনটির কথা মনে হলেই আমার মনে হয় মৃত্যুর খুব কাছ থেকে বেঁচে আসছি। স্প্লিন্টারের আঘাতের সাড়ে ১৫ বছর পর শরীরের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, আত্মহত্যা করে মরে যাই।
“এখন উন্নত চিকিৎসা ছাড়া আমার পা কাটতে হবে।”
তার মতোই দলীয় নেতাদের প্রতি ক্ষোভের কথা জানালেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক মাহবুবা পারভীন, শরীরে প্রায় সাড়ে পাঁচশ স্প্লিন্টার বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।
“নেত্রী ব্যতীত অন্য কোনো একজন মানুষ আমার খোঁজ-খবর নেয় নাই। আমি স্বেচ্ছাসেবক লীগ করেছি অথচ আমার সংগঠনের কেউই আমার খোঁজ নেয়নি।”
ওই হামলায় আহত হওয়ার পর থেকে ওষুধ ছাড়া কোনো রাতেই ঘুমাতে পারেননি জানিয়ে মাহবুবা বলেন, “হামলার প্রায় তিন বছর পর একদিন রাত ৩টার সময় আমি ব্লেড দিয়ে কেটে স্প্লিন্টার বের করতে চেয়েছিলাম। এরপর ইনফেকশন হয়ে সেখানে পচন ধরে গিয়েছিল। এতো যন্ত্রণা আর ভেতরে কামড়াচ্ছিল। ২০০৪ থেকে এই পর্যন্ত একটা রাতেও ঘুমাতে পারি না। রাতে অনেক পাওয়ারের ঘুমের ওষুধ খেতে হয়।”
“সেই গ্রেনেডে শুনেছি আমি হার্ট অ্যাটাক করেছি। পরে জানলাম আমাকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য কাপড়ের ব্যানারে করে দুই পাশ থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমার এক পাশ প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছিল। বাম হাত বাম পা অবশ হওয়ার কারণে দাঁড় করাতে পারছিল না। এজন্য আমাকে ব্যানারে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। স্বেচ্ছসেবক লীগের প্রচার সম্পাদক আশীষ কুমার মজুমদার আমাকে সেখান থেকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যান। আমি ৭২ ঘণ্টা আইসিইউতে ছিলাম, মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েছি।
“আমার ভাই যখন ডাক্তারের কাছে আমার অবস্থা জানতে চাইলেন ডাক্তার বললেন, সে বেঁচে আছে না কি মরে গেছে তা ৭২ ঘণ্টা পর বোঝা যাবে। আমার ভাই তখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।”
বক্তব্য শেষে শেখ হাসিনা যখন মঞ্চ থেকে নামতে উদ্যত হন সে সময় সিঁড়ির পাশেই ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য সাংসদ ইকবাল হোসেন অপু। গ্রেনেড বিস্ফোরণে তার দুই পা স্প্লিন্টারে ঝাঁঝরা হয়ে যায়। ডান পায়ের মাংসপেশি, বাঁ হাঁটু ও পায়ের পাতায় এখনও স্প্লিন্টারের ব্যথা অনুভব করেন।
তিনি বলেন, “স্প্লিন্টারের ব্যথা শরীরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। সারা বছরই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। স্প্লিন্টারের কারণে শারীরিকভাবে কোনো শান্তি নেই। সব সময় নেতাকর্মীদের সাথে সময় কাটিয়ে ব্যথা ভুলে থাকার চেষ্টা করি।”
ওই ঘটনা এখনও মনে গেঁথে রয়েছে জানিয়ে অপু বলেন, “১৫ বছরে এক মুহূর্তের জন্যও ভুলিনি। নেত্রী মঞ্চ থেকে নামছেন।হঠাৎ মুহুর্মুহু শব্দ। আমি পড়ে গেলাম। শরীরের কোথাও আঘাত পেয়েছি কি না বুঝতে পারছি না। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছিলাম না। তবে বুঝতে পারছিলাম, এই বুঝি সবাইকে মেরে ফেলা হচ্ছে।
“২১ অগাস্টের কথা মনে পড়লেই মনে হয়, আল্লাহর অশেষ রহমতে আমাদের নেত্রী বেঁচে গেছেন। সাথে অমিও মৃত্যুর খুব কাছাকাছি থেকে ফিরে এসেছি।”
শরীরে প্রায় আড়াইশ স্প্লিন্টার বয়ে বেড়াচ্ছেন মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সদস্য জোবায়দুল হক রাসেল।
তিনি বলেন, “গ্রেনেড হামলার চিকিৎসা নিয়ে ফেরার পর থেকে ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় আমার ওজন ৬০ কেজি বেড়ে যায়। কোনোভাবেই ওজন কমাতে পারছি না। মনে হয় যত দিন যাচ্ছে স্প্লিন্টারের ব্যথা বাড়তেছে। মাঝে মাঝে শরীরের ব্যথা এতই বেশি হয় যে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মনে হয়, মনে হয় এই বুঝি আমি মরে যাচ্ছি। বাবা, মা, স্ত্রী-সন্তানরাও শরীরের বিভিন্ন অংশে মালিশ করে দেয়।”
ইকবাল হোসেন অপুর মতো শেখ হাসিনার মঞ্চ থেকে নামার সিঁড়ির পাশেই ছিলেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য এস এম কামাল হোসেন।
তিনি বলেন, “সেদিনের বিরোধী দলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঞ্চ থেকে নামতে যাবেন এমন সময় আমরা একটি বিকট শব্দের আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমরা তখন ট্রাকের সিঁড়ির কাছে আমাদের নেতা ওবায়দুল কাদের, বাহাউদ্দিন নাছিম, আমি, এনামুল হক শামীম, পান্না, পঙ্কজ দেবনাথসহ অনেক সাবেক ছাত্রনেতা ছিল যে আপাকে নিয়ে আমরা মিছিল সহকারে যাব। সেই সময়ে এই আওয়াজ শোনার পর আমি পড়ে গেলাম। এরপর প্রায় ১১-১২টি আরও গ্রেনেডের আওয়াজ পেলাম।
“চারদিকে প্রচণ্ড ধোঁয়া, মানুষের আহাজারি, দৌড়াদৌড়ি। আমাদের ধরে সেদিন নিয়ে যাওয়া হল। আমাকে প্রথমে আপার ড্রাইভার আলী হোসেন আর শাহজাহান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। তখন আমার সারা শরীর রক্তে ভেজা। জ্ঞান ছিল, তবে প্রচন্ড যন্ত্রণা আর ব্যথা। ঢাকা মেডিকেলে ডাক্তার নাই, ওষুধ নেই। তখন আমার কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষী আমাকে ডেলটা হাসপাতালে নিয়ে যায়।
“পরের দিন আমার অপারেশন করে। শুনেছি আমার খাদ্যনালীর নাড়ি ৯ ইঞ্চি কেটে ফেলে দিতে হয়েছে। এরপর আমার নেত্রী শেখ হাসিনা ভারতে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠান। সেখানে চিকিৎসা করি, তবে আজও স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা সারা শরীরে আছে। রাতে খুব কামড়ায়। ঘুমের খুব সমস্যা করে। পা টিপতে টিপতে একটু ভালো লাগে। তখন ঘুমাই। গ্রামে শিং মাছে কাঁটা ফুটলে যেমন লাগে ওই ধরনের। প্রচণ্ড রকম ব্যাথা ভিতরে।”
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে চালানো ওই হামলার লক্ষ্য যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাই ছিলেন, তা পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে।
হামলায় জড়িত থাকার দায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত। এছাড়া তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এ মামলার আসামি ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকেও বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
গত বছর ১০ অক্টোবর রায় ঘোষণা করে বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন তার পর্যবেক্ষণে বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায়’ ওই হামলা ছিল দলকে ‘নেতৃত্বশূন্য করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা’।
“রাজনীতিতে অবশ্যম্ভাবীভাবে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে শত বিরোধ থাকবে। তাই বলে বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য করার প্রয়াস চালানো হবে? এটা কাম্য নয়।”