ঢাকা-৯ আসনে আট জন প্রতিদ্বন্দ্বী থাকলেও আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো আলোচনায় কেউ নেই। তবে ঝুঁকি নিতে চান না সাবের।
Published : 22 Dec 2023, 07:09 PM
সবুজবাগ থানার মানিকনগর ৭ নম্বর ওয়ার্ডে সড়কজুড়ে কেবল সাবের হোসেন চৌধুরীর পোস্টার। ঢাকা-৯ সংসদীয় আসনে এই চিত্রই বলে দিচ্ছে অনেক কিছু।
বিএনপির বর্জনের এই ভোটে যারা আসনটিতে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী, তাদের মধ্যে ভোটারদের কাছে সেভাবে পরিচিত বা গোটা নির্বাচনি এলাকায় প্রভাব আছে, এমন কেউ নেই।
এবারের জাতীয় নির্বাচনে বহু আসনে নৌকা মার্কার প্রার্থীদের কপালে ভাঁজ তৈরি করেছে আওয়ামী লীগ নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তবে এই আসনটিতে সাবেরের এমন কোনো দুশ্চিন্তা নেই।
তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা হলেন লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির কাজী আবুল খায়ের, সোনালী আঁশ প্রতীকে তৃণমূল বিএনপির রুবিনা আক্তার (রুবি), টেলিভিশন প্রতীক নিয়ে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফের মোহাম্মদ শফি উল্লাহ চৌধুরী, কাঁঠাল প্রতীক নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির মো. আনোয়ারুল ইসলাম, একতারা নিয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির মো. মাহিদুল ইসলাম, আম নিয়ে ন্যাশনাল পিপলস পার্টির মোহাম্মদ কফিল, ছড়ি প্রতীক নিয়ে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের মো. নূরুল হোসাইন এবং মাছ নিয়ে গণফ্রন্টের তাহমিনা আক্তার।
দৃশ্যত ফুরফুরে সাবের। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার নির্বাচনে নেমে বাজিমাত করার পর এখন পর্যন্ত বড় কোনো বিতর্কে জড়াননি তিনি। ২০০১ সালে হারলেও পরের তিনটি নির্বাচনে জিতেছেন। তার পরিচিতি ভোটারদের কাছে অন্যদের তুলনায় বেশি, সেই সঙ্গে আছে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি।
তবে ভোটে অপ্রত্যাশিত ফলাফল হয়েই থাকে, ভোটের আগে অচেনা প্রার্থীও নানা সময় বাজিমাত করে ফেলেন- এই বিষয়টি অজানা নয় সাবেরের কাছে। তাই তিনি কোনো প্রার্থীকেই দুর্বল মনে করছেন না। আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হতেই তার কর্মী সমর্থকরা নেমে গেছেন ভোট প্রার্থনায়। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন ভোটারদের কাছে দেখা গেল সাবেরকেও।
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মানিকনগর মডেল হাই স্কুলের মাঠে উঠান বৈঠক করেন নৌকার প্রার্থী। সেখানেই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা তার।
সাবের চৌধুরী বলেন, “আমার প্রতিদ্বন্দ্বী যারা আছেন, তাদের প্রতি আমার সম্মান রয়েছে। তারাও ভোটের প্রচারে সরব থেকে মানুষের কাছে গিয়ে আমার কাজের কোনো ভুল-ত্রুটি থাকলে সেটা বলুক।
“আমি আশা করছি একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এটাই তো গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। জনগণ ভোটকেন্দ্রে আসুক এবং তারা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করুক। এটাই আমার চাওয়া।”
খিলগাঁও, মুগদা, সবুজবাগ ও মানিকনগরের ১২টি ওয়ার্ড নিয়ে এই ঢাকা-৯ আসন।
বিএনপি না থাকায় ভোটের আমেজ সেভাবে না থাকলেও ভোটারদের মধ্যে তর্ক বিতর্ক, যুক্তি-পাল্টা যুক্তির শেষ নেই।
শুক্রবার সকালে কমলাপুর স্টেডিয়ামের পাশে উত্তর মানিকনগরে একটি চায়ের দোকানে কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা মোবারক আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, “এই এলাকায় সাবের চৌধুরীই পাস করবেন। অন্য প্রার্থী যারা আছেন, তারা তার মতো জনপ্রিয় না।”
পাশ থেকে শামীম নামের একজন বলেন, “বিএনপি তো নাই। সারা দেশেই তো নৌকা পাস করব। নির্বাচন করে এত টাকা নষ্ট করার দরকার কী? আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করলেই তো হয়।”
এই তরুণের বাড়ি নোয়াখালী। ঢাকায় মোটর সাইকেলে রাইড শেয়ার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিনি বলেন, “আমি কোনো দল করি না। আওয়ামী লীগ অনেক উন্নয়ন করছে, এটা সত্য। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণে তো আমরা হিমশিম খাইতেছি। যা ইনকাম করি, তা দিয়া সংসার চলে না। জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে এই সরকার তো ভালোয় কাজ করছে।”
মানিকনগর মডেল হাই স্কুল গেটের সামনেই আঁখের রস বিক্রি করছিল কিশোর রাসেল। তার ভাষ্য, “এখানে আর কারো তেমন মিছিল-টিছিল হইতে দেখি না। নৌকার পোস্টারই বেশি।”
সাবেরকে কাছে পেয়ে দাবিনামা
স্থানীয় ভোটাররা তাদের সংসদ সদস্যকে সব সময় কাছে পান এমন না। তবে নির্বাচনকে সামনে রেখে সেই তিনিই এখন তাদের দুয়ারে। এই সুযোগে এলাকার সমস্যা আর দাবি তুলে ধরছেন তারা।
সেই উঠান বৈঠকে মোস্তাফিজুর রহমান নামের একজন বলেন, মুগদা হাসপাতালের পাশের একটি রাস্তা অনেক দিন ধরে সংস্কার হয় না।
উত্তর মানিকনগর স্টেডিয়ামের পাশে একটা রাস্তা করে দেয়ার দাবি করেন মোস্তফা নামে আরেকজন। তিনি বলেন, “১৯৯৬ সাল থেকেই আপনাকে আমরা এমপি হিসেবে মনোনীত করে আসছি। আপনি এই রাস্তাটা আমাদেরকে করে দেন।”
গ্যাস সংকটের কারণ বেশিরভাগ পরিবারকেই দুর্ভোগে পড়তে হয় বলেও অভিযোগ করেন একাধিক বাসিন্দা।
সাবের চৌধুরীর এসব দাবি ও স্থানীয় সমস্যার কথা টুকে রাখেন খাতায়।
উঠান বৈঠকে আওয়ামী লীগের এক কর্মী সাবের চৌধুরীর উন্নয়ন কাজের প্রশংসা করতে শুরু করলে তাকে থামিয়ে দেন সঞ্চালক। তিনি বলেন, “দলীয় নেতাকর্মীদের নয়, সাধারণ মানুষের কথা আমরা বেশি শুনতে চাই।”
সাবের চৌধুরী বলেন, “আমি একটা রাজনৈতিক দলের রাজনীতি করি। নৌকা আমার প্রতীক। কিন্তু আমি যখন এমপি, তখন আমি সবার। সব দলের মানুষের কথা আমি শুনি এবং সমাধান করার চেষ্টা করি। আমার ভুল-ত্রুটি নিয়েও সবাই সমালোচনা করুক।”
ভোটারদের দাবির বিষয়ে কোনো আশ্বাস না দিয়ে তিনি বলেন, “নির্বাচনি আচরণবিধি অনুযায়ী আমি কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে পারব না। তবে আমাদের সরকার বিগত সময়ে মানুষের পাশে থেকেছে, এটা বলতে পারি।”
তিনি সংসদ সদস্য থাকার সময় এলাকায় কী কী হয়েছে, সেই উদাহরণও তুলে ধরেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। তিনি বলেন, ‘মুগদা হাসপাতাল যখন শুরু করেছি, তখন এটি ছিল ৫০০ শয্যার, এখন হয়েছে ৭৫০, সরকারের সিদ্ধান্ত হয়েছে, এটি এক হাজার শয্যার হবে। এখানে ১০টাকার টিকেট কেটে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে পারছেন। ঢাকার কয়েকটা অত্যাধুনিক সরকারি হাসপাতালের মধ্যে এটি একটা।”
যোগাযোগের ক্ষেত্রে উন্নয়নের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “মেট্রোরেলের এমআরটি লাইন ৬ এর স্টেশন আছে এই আসনে। এমআরটি ৫ এর স্টেশনও হবে এই এলাকায়।”
একটি কলেজ স্থাপনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, “একটা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ যেন হয় এটা আমি চাই।
“মানিকনগর মডেল স্কুল ১৫ বছর আগে টিনের ঘর ছিল। এখানে এখন দুটি ছয় তলা ভবন, আরেকটি ১০তলা হবে।”
গ্যাসের সমস্যার থাকার কথা স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে তিনি বলেন, “শুধু আমাদের এলাকার না, এটা পুরো ঢাকা শহরের সমস্যা। সারা দেশেই এই সমস্যাটা আছে।”
আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে সবাইকে নিয়ে এমন সভা করে আগামী ৫ বছরের জন্য পরিকল্পনা সাজাবেন বলেও জানান নৌকার প্রার্থী।
মাদক, সন্ত্রাস, জমি দখলের বিষয়ে জিরো টলারেন্স থাকবে বলেও অঙ্গীকার করেন তিনি।
সবাইকে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “কাকে ভোট দেবেন, সেটা আপনাদের বিষয়। কিন্তু কেউ যেন ভোট প্রদানে বাধা দিতে না পারে তার ব্যবস্থা করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করব।”