উদীচী ও সত্যেন সেন

কামরুল আহসান খান
Published : 29 Oct 2021, 12:48 PM
Updated : 29 Oct 2021, 12:48 PM

বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ৫৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। মানুষের আত্বপরিচয় ও অধিকার নিয়ে বাঁচার লড়াইয়ে উদীচীর ভূমিকা অনন্য ও অভিনন্দনযোগ্য। দীর্ঘ পাঁচ শতাব্দী শেষেও নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যেও উদীচীর পথ চলা বন্ধ হয়নি। বোমা হামলা, হত্যা, জেল জুলুম, সন্ত্রাস কোনো কিছু দিয়েই রোখা যায়নি উদীচীর পথ চলা।

ষাটের দশকের শেষ দিকে সত্যেনদার সঙ্গে প্রথম দেখার কালে আমি ছিলাম তরুণ ছাত্র। সারা দেশে আইয়ুববিরোধী তুমুল সংগ্রাম চলছে। ছাত্রদের আন্দোলন তুঙ্গস্পর্শী। সবে কলেজে ভর্তি হয়েছি। একদিন বড় ভাই জানালেন আমাদের একটা গানের রিহার্সেলে যেতে হবে। এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার। আমাদের বাসায় গানের একটা চমৎকার আবহ ছিল। আমাদের বাবা গান পছন্দ করতেন। সে সুবাদে আমরাও। তের ভাইবোনের কারো-না-কারো জন্মদিন কিংবা কোনো জাতীয় দিবসে আমাদের বাসায় গানের আসর বসত। বড় ভাই গান ধরতেন আমরা ওনার সঙ্গে গলা মেলাতাম। এভাবেই শুরু হয়েছিল। গানের মাধ্যমে মানুষকে ভালোবাসা যায়, যায় উজ্জীবিত করা। বাড়িতে গান গাইতে গাইতেই একদিন আমরা কেমন করে যেন দেশের কাজে মানুষের কাজে নিজেদের জড়িয়ে ফেলি। 'ধনধান্য পুষ্পে ভরা', 'নওজোয়ান নওজোয়ান- বিশ্ব জেগেছে নওজোয়ান' বা নজরুলের 'জাগো অনশন বন্দি'সহ ভারতীয় গণনাট্য এর বিখ্যাত গানগুলি ছিল আমাদের প্রিয়। আত্মীয়স্বজন বা গুরুজনরাও আমাদের সঙ্গে গণসংগীতে গলা মেলাতেন।

যাইহোক, বড় ভাই বললেন, গানের রিহার্সেলে যেতে হবে সেখানে সত্যেনদা অর্থাৎ সত্যেন সেন থাকবেন। সত্যেনদার কথা শুনে আমরা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠি। ইতোমধ্যে তার লেখা বই পড়ে ত্রিশের দশক থেকে ব্রিটিশ ভারতে ওনার বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের কথা শুনে মনের মাঝে ওনার প্রতি একটা রোমাঞ্চকর শ্রদ্ধা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কাজেই আমরা দুই ভাই অর্থাৎ আমি ও বদরুল তক্ষুণি রাজি হয়ে যাই। বড় ভাই বললেন ছোট বোন পারুলের হারমোনিয়ামটা নিয়ে যেতে। পারুল হারমোনিয়াম দিয়ে বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে গান শিখতে যেত। হারমোনিয়ামটা নিয়ে দুই ভাই বাসে চেপে সোজা নারিন্দা গিয়ে একটি মেসবাড়িতে হাজির হই। আর সেখানেই প্রথম দেখা আমাদের পরম শ্রদ্ধাভাজন সত্যেনদার সঙ্গে। হালকা-পাতলা ছিপছিপে গৌরবর্ণের সঙ্গে একজোড়া বুদ্ধিদীপ্ত চোখ একবার দেখে মুগ্ধ হয়ে মনে রাখার মতো একজন মানুষ। বড় ভাই আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলে তিনি হাসিমুখে আমাদেরকে বরণ করে নিলেন। ওই আসরেই একে একে পরিচিত হই শ্রমিক নেতা সাইদুল হক ভাই, করিম ভাই, আবেদ ভাই, শুভ ভাই, এলাহী বক্স ভাই, খালেদ ভাইসহ আরো অনেকের সঙ্গে। সেখানে থাকা ইদু ভাই ও আখতার ভাইয়ের সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় ছিল। ইদু ভাই হারমোনিয়াম টেনে নিলেন। শুরু হলো সত্যেনদার লেখা ও সুর করা গান দিয়ে "ওরে ওরে বঞ্চিত সর্বহারা দল, শোষণের দিন হয়ে এল ক্ষীণ, নবযুগ এল…."। সবার মনেপ্রাণে যেন শিহরণ বয়ে গেল। আমরা জোর গলায় সবার সঙ্গে গলা মেলাই আর আড় চোখে তাকিয়ে ছিলাম সত্যেনদার দিকে। যেন এক মহামানবকে দেখছি। বন্ধ চোখে তিনিও প্রাণভরে গান করছেন। যেন স্বপ্নের মাঝে বিভোর হয়ে আছেন। মানুষের শোষণ মুক্তির স্বপ্নে ডুবে আছেন। আমরা সবাই মিলে তাকে গান শোনানোর আবদার জানালাম। তিনি মৃদু হেসে রাজি হলেন। গান ধরলেন, 'মানুষেরে ভালোবাসি এই মোর অপরাধ, মানুষের কাছে পেয়েছি যে বাণী তাই দিয়ে রচি গান/ মানুষের লাগি ঢেলে দিয়ে যাব/ মানুষের দেয়া প্রাণ। ' হারমোনিয়াম বাজাচ্ছিলেন ইদু ভাই। তন্ময় হয়ে সবাই গান শুনছে ভিজে যাচ্ছে চোখের পাতা। গানের কথা ও সুর ধ্বনিত হলো আমাদের অন্তঃস্থলে। আমরাও হয়ে গেলাম মানবমুক্তির সংগ্রামে তার সহযাত্রী। সেদিন ওই ঘরে আমরা যারা উপস্থিত ছিলাম তাদের মধ্যে দু'একজন প্রয়াত হয়েছেন। যারা বেঁচে আছি তারা আজও সে পথের পথিক। সাইদুল হক ভাই নিজের লেখা কিছু গান শোনালেন। জারি গানের মতো সুর করা সাধারণ শ্রমিকদের জন্য লেখা। আমরাও গাইলাম। প্রায় তিন ঘণ্টা আমাদের রিহার্সেল চলল। সন্ধ্যা হয়ে এলে মেসের বাসিন্দারা আসতে শুরু করলে আমাদের উঠতে হলো।

উদীচীর জন্মকথা

পরের সপ্তাহে সেই মেসে আবার রিহার্সেলের আসর বসল। গানের সুরে আমরা নতুন চিন্তার দিশা খুঁজে পেলাম। আনন্দ আর উৎসাহ আমাদের বড় কিছু করার জন্য তৈরি করে চলছিল। মানবমুক্তির নেশায় আমাদের রক্ত যেন টগবগ করছিল। কিছুদিন পরপর আমাদের রিহার্সেলের জায়গা বদল করতে হচ্ছিল, মূলত প্রতিবেশীদের আপত্তির কারণে। কখনো বাংলাবাজার, কখনো গোপীবাগ। কোথাও স্থির হওয়া যাচ্ছিল না। বিদ্রোহ, লড়াই, বিপ্লবের গান শুনে অনেকে ভয় পেয়ে যেত। আমরা হাল ছাড়িনি। অনেক জায়গা বদলের পরে আমাদের চামেলীবাগের পাড়ায় আস্তানা গাড়া হলো। প্রথমে ছুটির দিনের সকালে আমাদের বাসায়। পরে পাড়ার এক মেসে যেখানে পীর ভাই, মোনায়েম ভাই, মোর্শেদ ভাই থাকতেন। ওনারা সবাই তখন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে ওটাকে বলা হতো ন্যাপের মেস। বাড়িটির মালিক ছিলেন চন্দনের আম্মা দেবী চৌধুরানী যাকে আমরা খালাম্মা ডাকতাম। নিচের তলায় থাকতেন অ্যাডভোকেট আনোয়ারুল হক। নানা কাজে ওনার কাছে যেতে হতো। পাড়ার সবাই আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। এতদিনে একটু স্বস্তিতে রিহার্সেল করার সুযোগ পেলাম। একে নিজেদের পাড়া, তার ওপর দলের মেস। জাঁকিয়ে চলছিল মহড়া। এখান থেকে শুরু হলো নারী কর্মীদের অংশগ্রহণ। রিজিয়া আপা, আমার বোন তাজিম সুলতানা নিয়মিত আসতে শুরু করে। কয়েকদিন পরে সত্যেনদা প্রস্তাব করলেন, একটা কমিটি করে কাজ করার জন্য। তার প্রস্তাব ছিল কমিটিতে আমাকে আহ্বায়ক এবং বাকিদের সদস্য করা। আর সংগঠনটির নাম দিলেন 'উদীচী'। তার প্রস্তাবে এক কথায় সবাই রাজি হয়ে গেল। যাত্রা শুরু করল উদীচী। সত্যেনদার মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রমিক ও কৃষক এলাকা থেকে গানের আসর করার আমন্ত্রণ আসতে থাকে। আমরাও সুযোগ পেলাম এতদিনের রিহার্সেল কাজে লাগানোর। দেশজুড়ে তখন আইয়ুববিরোধী আন্দোলন জোরদার হতে শুরু করেছে। আমি সে সময়ে ছাত্র-আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলাম। ছাত্র-আন্দোলনের নানা অনুষ্ঠানেও গান করার আমন্ত্রণ আসতে থাকে। 'উদীচী' একটি সংগঠিত সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। খেত-খামার, মাঠে-ময়দানে মানুষকে জাগিয়ে তুলবার জন্য আমন্ত্রণ আসতে থাকে বিভিন্ন জায়গা থেকে।

গ্রামে-গঞ্জে, কলে-কারখানায়

সত্যেনদার তত্ত্বাবধানে আমরা শ্রমিক এলাকায় গান করার প্রস্তুতি নিতে থাকি। আবার রিহার্সেল শুরু হলো। 'দুনিয়ার মজদুর ভাইসব/ আয় একসাথে আজ দাঁড়া/ এই খুনে রাঙ্গা লাল ঝান্ডা'সহ আরো কিছু গান আমরা তৈরি করে ফেলি। দশ কি বারো জনের একটা দল নিয়ে আমরা প্রথমবারের জন্য শ্রমিক এলাকায় গেলাম। জনসভার পরে আমরা গান গাইলাম। আদমজীর শ্রমিক খালেক ভাইও আমাদের সঙ্গে গাইলেন। আমাদের গান শুনে শ্রমিকরা উৎসাহিত হয়ে ওঠে। শিল্পীদের তারা বেশ আদর-যত্ন করল। মেহনতি মানুষের মাঝে তাদেরই গান করে সত্যেনদার নেতৃত্বে আমরা ঢাকায় ফিরে এলাম। পরে ডেমরা, পোস্তগোলাসহ ঢাকা শহরের আশেপাশের শিল্প এলাকাগুলো থেকে আমন্ত্রণ এলে আমরা ইদু ভাইয়ের নেতৃত্বে গিয়ে অনুষ্ঠান করি। এ ছাড়া সত্যেনদার উদ্যোগে আমরা গ্রামে গিয়ে কৃষকদের মাঝেও অনুষ্ঠান করেছি। কৃষক সম্মেলনে যোগদান করা ছিল আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কৃষকনেতা জীতেন ঘোষ ছিলেন সত্যেনদার প্রাণের বন্ধু। তারা এক সঙ্গে কারাবরণ করেছিলেন। চল্লিশের দশক থেকে একসঙ্গে কৃষকদের দাবিদাওয়া নিয়ে লড়াই-সংগ্রাম করছেন। সেবার কৃষক সম্মেলন হলো নরসিংদীর রায়পুরায়। পনেরো/বিশ জনের একটা দল আমরা রেলগাড়ি করে নরসিংদী স্টেশনে নামি। সেখান থেকে সন্ধ্যা নাগাদ রায়পুরায় সম্মেলন প্যান্ডেলে পৌঁছাই। লাল ঝান্ডা হাতে হাজার হাজার কৃষক সমবেত হয়েছে দাবি আদায়ের আন্দোলনে। আমাদের সে রাতটা কাটল প্যান্ডেলে কৃষকদের সঙ্গে। সত্যেনদা থাকলেন আমাদের সঙ্গে। এটা অনন্য অভিজ্ঞতা। সম্মেলনে আমরা বেশ কিছু গান করি। এর মধ্যে সত্যেনদার লেখা ও সুর করা গানও ছিল। সে সময়ের জনপ্রিয় গণসংগীতগুলো আমরা সম্মেলনে গেয়েছি। রিজিয়া বেগম, তাজিম সুলতানাসহ বেশ কয়েকজন নারী শিল্পীও আমাদের সঙ্গে ছিল। প্রথমবারের মতো মেহনতি মানুষের এত বড় সমাবেশে তাদের গান গাইতে পেরে আমাদের আনন্দের সীমা রইল না।

শুরু থেকেই কৃষক সমিতি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন ও শ্রমিক সমাবেশ থেকে আমাদের নিয়মিত ডাক আসতে থাকে। কর্মীদের মুখে মুখে তখন আমাদের গানগুলো। অগ্নিকন্য মতিয়া চৌধুরীও আমাদের মঞ্চে গলা মেলাতেন। তার বোন তুলিও আমাদের সংগে দল বেঁধে গান করেছে।

শিল্পীরা নিজ উদ্যগে গণপরিবহন ব্যবহার করে গাইতে আসত। ইদু ভাই আসতেন তার সব সময়ের সঙ্গী সাইকেল নিয়ে। শিল্পী হিসাবে আমাদের যৎসামান্য চা আপ্যায়নেই আমরা খুশি থাকতাম। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ হোটেল ছিল ইন্টারকন্টিনেন্টাল। মনজুরুল আহসান খান ছিলেন সর্ব পাকিস্তান হোটেল ফেডারেশন-এর সভাপতি। সেখানে আমাদের বেশ ভালো খাওয়ার আয়োজন থাকত। বড় পাঁচ তারকা হোটেলে আমাদের বেশ সমাদর করত শ্রমিকেরা। জরিনা বেগম, পল রোজারিও নানাভাবে উদীচীর পাশে দাঁড়িয়েছেন। এখানে উল্লেখ্য যে, মনজুরুল আহসান ছিলেন আমাদের অত্যন্ত কাছের আর উদীচীর সব সময়ের পরামর্শক। সে সময় পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে আমরা বেশ জনপ্রিয় ও পরিচিত। মনজু ভাই, বেলায়েত ভাই সেখানে বেশ জনপ্রিয় নেতা। মে দিবস থেকে শুরু করে সব অনুষ্ঠানে আমাদের ডাক পড়ত। শ্রমিকের লাল পতাকা মিছিলে আমরা হারমোনিয়াম গলায় বেঁধে গান করেছি। সে সময় পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন ছিল সবচাইতে কার্যকরী সক্রিয় সংগঠন। প্রতিটি অনুষ্ঠান ছিল বেশ চমকপ্রদ।

বিপ্লবী কাজের কারিগর উদীচী

৬৮ সালে জেল থেকে বের হয়ে সত্যেনদা আমাদের নিয়ে গড়ে তোলেন গণমানুষের সংগঠন 'উদীচী'। যুদ্ধপূর্ব সেই উত্তাল দিনগুলোতে গ্রাম থেকে গ্রামে, শিল্পাঞ্চল থেকে গান করে 'উদীচী' মানুষকে উজ্জীবিত করেছে। এই সময়ে আমরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও অনুষ্ঠান করার ডাক পেয়েছি। বিশেষত ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনগুলোতে 'উদীচী'র সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল অবধারিত।

গান, নাটক, কবিগানের দল নিয়ে আমরা সে সময়ে ঘুরে বেড়িয়েছি গ্রামবাংলার পথে প্রান্তরে এবং ঢাকা শহরের আপামর মানুষের মাঝে। সত্যেনদার হাত ধরে সুযোগ হয় দেশের খেটে খাওয়া কৃষক-শ্রমিকের টানা পোড়নের জীবনের সাথে যুক্ত হওয়ার। স্বাধীকার আদায়ের লড়াইয়ের আমরা তার নেতৃত্বে বিশেষ ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট ছিলাম। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আমাদের পরিচিতি ও সমর্থন বাড়তে থাকে। গানের অনুশীলনের জন্য জায়গার তেমন আর অভাব হয় না। অনেকেই এগিয়ে আসেন, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। আমাদের সংখ্যা বেড়ে যায় অনেক। এবার সত্যেনদা পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে উদ্যোগী হলেন। গোপীবাগে শাহেদ আলী ভাই ও হোসনে আরা আপার বাসায় বসা হলো। সাবজেক্ট কমিটিতে আমি, ইদুভাই আর সত্যেনদা। সত্যেন সেনকে সভাপতি, মোস্তফা ওয়াহিদ খানকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠন করা হলো 'উদীচী'র প্রথম পূর্ণাঙ্গ কমিটি। আমি তখন ঢাকা নগর ছাত্র ইউনিয়নের সহ সাধারণ সম্পাদক। আমার উপর নির্দেশ এলো ছাত্র ইউনিয়নে বেশি সময় দিতে হবে। তাই মূল দায়িত্ব ছেড়ে কোষাধ্যক্ষ হিসেবে প্রথম কমিটিতে থাকতে হলো।

প্রতিদিন একটু একটু করে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে 'উদীচী'। গানের দল নিয়ে দেশজুড়ে ঘুরে বেড়ানোর মাত্রা বেড়ে গেল। সত্যেনদা ঠিক করলেন বড় করে সম্মেলন করা হবে। ওই সময় ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট ছিল সবচাইতে বড় মিলনায়তন। ইতোমধ্যে উদীচীর কাজে যুক্ত হলেন শেখ লুৎফর রহমান, আলতাফ মাহমুদ, শিল্পী হাশেম খানসহ আরো অনেকে। আলতাফ ভাই আমাদের চমৎকার একটা স্ক্রিপ্ট করে দিলেন। গানও করলেন। সত্যেনদা আমাকে নিয়ে অর্থ সংগ্রহের কাজ শুরু করলেন। খুব ভোরে আমাদের বাসায় এসে আমাকে সাথে করে বেরিয়ে পড়তেন। সকালবেলা ছিল সবাইকে পাওয়ার ভালো সময়। সত্যেনদা আমাকে নিয়ে যেতেন শহীদুল্লা কায়সার, জহির রায়হান, হাসান ইমাম, কবি সানাউল হক, আহমেদুল কবির, বুয়েট অধ্যাপক জহিরুল ইসলামসহ অনেকের বাসায়। তখন লক্ষ করি সত্যেনদাকে সবাই ভীষণ শ্রদ্ধা করছেন, সাধ্যমতো উদীচীর সম্মেলনের অর্থ সাহায্য করছেন। আমি নিজে জনসংযোগের কর্মী। স্কাউটিং এবং নানারকম কাজের মধ্য দিয়ে আমি এটা বেশ রপ্ত করতে পেরেছিলাম। কিন্তু সত্যেনদা'র জনসংযোগের ধরন দেখে অবাক হযেছি। বিভিন্ন জনের ঠিকানা খুঁজে সক্কালবেলা গিয়ে হাজির হতেন। তার সাথে এভাবে অনেকের বাসায় সে সময় নাস্তা সেরেছি। এই সাত সকালে ধর্ণা দেয়ায় একজনকেও বিরক্ত হতে দেখিনি। বরং প্রত্যেকেই তাকে গ্রহণ করেছে পরম শ্রদ্ধায় আর ভালোবাসায়। যেন তার আগমন তাদের সকালটিকে আলোকিত করে দিল। অনেককেই দেখেছি রীতিমতো ওনার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে। মনে আছে একদিন খুব ভোরবেলা সত্যেনদার সাথে গেছি জহির রায়হানের পুরান ঢাকার বাড়িতে। দরজা খুলে জহির রায়হান সত্যেনদাকে দেখামাত্রই মাথা নীচু করে ঢীপ করে পা ছুঁয়ে সালাম করে নিলেন। নিজস্ব ব্যক্তিত্বের স্বকীয়তাই তাকে বসিয়েছিল মানুষের শ্রদ্ধার আসনে। ঢাকা শহরের অলি গলি ছিল তার নখদর্পনে। পরে ঢাকা শহরের ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন 'ঢাকা শহরের ইতিকথা' নামের একটি সুখপাঠ্য বই। সম্ভবত তার আগে এ বিষয় নিয়ে কেউ বই লেখেননি।

সত্যেন সেনের ব্যক্তিত্বে একটা আকর্ষণীয় শক্তি ছিল। সহজেই মানুষের আপন জন হয়ে যেতেন। ছোট-বড় সবার কাছে নিমিষেই প্রিয়জন হয়ে উঠতেন। আমাদের বাসায় রিহার্সেলের দিনগুলোতে লক্ষ করেছি আম্মা সত্যেনদাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করতেন। না খেয়ে তাকে যেতে দিতেন না। আমাদের গান শুনতেন আড়াল থেকে। সত্যেনদার লেখা মেহনতি মানুষের গান শুনে চোখ মুছতেন। মানুষের প্রতি আমার মায়ের অকৃত্রিম দরদ আমাদেরকে উদীচী করতে, ছাত্র ইউনিয়ন করতে নীরব উৎসাহ যুগিয়েছে। তাই আমাদের রাজনীতির সাথে জড়িত হওয়ার পথে বাড়ি থেকে কোনো বাধা আসেনি। মানুষের জন্য নিবেদিত হওয়াটাকে তাদের সন্তানদের জন্য আবশ্যকীয় ভেবেছেন। আর এসব কিছুর পেছনে বোধ করি আমাদের বাড়িতে সত্যেন সেনের মতো ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি একটা প্রত্যক্ষ যোগ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সূচনার পূর্ব পর্যন্ত রাজপথে আন্দোলন সংগ্রামের পাশাপাশি বাঙালির সার্বিক মুক্তির চেতনাকে ধারণ করে 'উদীচী'র পথ চলা আরো উজ্জীবিত করেছে স্বাধীনতার চেতনাকে।

বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজে ১৯৬৯ সালে উদীচীর প্রথম বড় অনুষ্ঠানটি আমরা করি। নাটক, গান, আবৃত্তি ও আলোচনা দিয়ে অনুষ্ঠানটি সাজানো হয়। সত্যনদা, রনেশদা, মতিয়া আপা আলোচক হিসেবে ছিলেন। আক্তার হোসেন এর আলো আসছে নাটকটি পরিবেশন করা হয়। তরুদি, শেলী আপা, শ্রমিক নেতা রব্বানী ভাইসহ অনেকেই নাটকে অভিনয় করেন। একটি ছোট একটি প্রকাশনা সেদিন করা হয়েছিল।

অবরুদ্ধ বাংলাদেশ থেকে সত্যেন সেন উদ্ধারপর্ব

মুক্তিযুদ্ধের সুচনালগ্নে অর্থাৎ ২৬ মার্চ রাতেই আমাকে ঘর ছাড়তে হয়। আমাদের বাসা রাজারবাগ পুলিশ লাইনের কাছে হওয়াতে যুদ্ধের প্রথম প্রহরেই আমরা জড়িয়ে পড়ি। পরদিনই ঢাকা ছাড়তে হয়। সাময়িক আশ্রয় নিতে হয় ত্রিমোহনী এলাকাতে এবং পরে পুলিশের ফেলে যাওয়া অস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি। সেখান থেকে নানা জায়গা হয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে এপ্রিল মাসেই আগরতলা পৌঁছে যাই। সেখানে ততদিনে গড়ে উঠেছে পার্টির মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্প। আমাদের চোখে তখন যুদ্ধে যাবার প্রত্যয়। অপেক্ষায় আছি ট্রেনিং নেবার। এর মাঝে এপ্রিল মাসের শেষদিকে একদিন মোনায়েম ভাই খবর দিলেন আমাকে বাংলাদেশে যেতে হবে। পথের খরচ হিসেবে তিনি কিছু টাকা যোগাড় করে দিলেন লায়লা কবিরের কাছ থেকে। বলা হলো, সত্যেনদা নিজ এলাকা বিক্রমপুরে আটকা পড়েছেন, তাকে সাবধানে কৌশলে নিয়ে পৌঁছাতে হবে সীমান্ত পার করে নির্ধারিত জায়গায়। বিক্রমপুরের কুসুমপুর গ্রামে গিয়ে গাজী ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। কাজটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, ইতোমধ্যে পাক হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসররা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে অবস্থান নিয়েছে। আবার অবরুদ্ধ বাংলাদেশ থেকে সত্যেন সেনকে মুক্ত অঞ্চলে নিয়ে আসার অ্যাডভেঞ্চারে যেমন রোমাঞ্চিত হয়েছি তেমনি এই যুদ্ধদিনে সত্যেনদা'র সঙ্গ পাবো ভেবে উদ্বেলিত হয়েছি। এই কাজে সঙ্গী হয়ে জুটে গেল আমার সহপাঠি বন্ধু শাহাদাত। সে এখন একজন চিকিৎসক ও রাজনৈতিক নেতা।

আমরা দুই বন্ধু বুকভরা উত্তেজনা নিয়ে রওনা দেই বিক্রমপুর পরগণার কুসুমপুর গ্রামের পথে। দীর্ঘপথ অতিক্রম করি নানা রকম দেশি যানবাহনে এবং অধিকাংশ সময় পায়ে হেঁটে। হানাদারদের পাহারা চেকিগুলো এড়িয়ে আমাদেরকে অনেক ঘুরপথে চলতে হয়েছে। যথাসময়ে আমরা গাজী ভাইয়ের কুসুমপুরের বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। ওনার বাসাতেই রাত যাপন করা হলো। সে রাতে গাজী ভাইয়ের কাছ থেকে বিক্রমপুরের অনেক গল্প শুনি। পরিকল্পনা করা হলো সত্যেনদা'কে কিভাবে কোন পথে নিয়ে যাবো। কুসুমপুর গ্রামটি ছিল ছবির মতো। এমন সুন্দর গ্রাম আরেকটি দেখিনি।

পরদিন রাতে আমরা রওনা হই লেনিন ভাইয়ের সাথে দেখা করতে। তিনি তখন নিজ গ্রাম কানসারে অবস্থান করছিলেন। তারই আমাদেরকে সত্যেনদার কাছে নিয়ে যাবার কথা। লেনিন ভাই আমাদেরকে নিয়ে গেলেন অন্য একটি গ্রামে অ্যাডভোকেট কাজী জহিরুলের বাড়িতে। সেখানে গিয়ে সত্যেনদা'র সাথে দেখা হলো। যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়ে লেনিন ভাই চলে গেলেন। সত্যেনদা যাবার জন্য তৈরি হয়েই ছিলেন। এক পরিচিত বাড়িতে দুপুরের খাবার সেরে তাকে নিয়ে আমরা ইছাপুর লঞ্চ ঘাটে যাই। লক্ষ আপাতত দাউদকান্দি। সিরাজদিখান, শিবরামপুর, ষোলঘর, তালতলা হয়ে নৌকায় বিশাল মেঘনা পাড়ি দিতে হলো। এরপর মতলব থানার ব্রাহ্মণচক গ্রামে আমার স্কুলের সহপাঠী নুরুজ্জামানের বাড়িতে ৩/৪ দিন থাকতে হলো। তখন এরকম থাকার জায়গা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এই বাড়িতে দেখা হয়ে গেল ঢাকা থেকে আসা স্কুল শিক্ষিকা বেবি আপা, মিনু আপা, বিনু আপার সাথে। সবাই সত্যেনদার বেশ ভক্ত হয়ে উঠল। সীমান্ত পাড়ি দেবার নিরাপদ সময়ের ও রুটের অপেক্ষায় ছিলাম। প্রতিদিন খোঁজখবর সংগ্রহ চলছিল। কিছুটা বিশ্রামও নেয়া হলো। তিনদিন পরে আমাদের যাত্রা করার এসে গেল। আমরা রওনা দেই ভারতের পথে। মাঝে দাউদকান্দিতে এক বাড়িতে রাতে থাকতে হলো। ওখান থেকে আমরা মুলত হাঁটার ওপর নির্ভর করে এগোতে থাকি। রাস্তা ভালো নয়। নদী পড়লে নৌকায় করে পার হয়ে আবার হাঁটা। অবশ্য দু-এক জায়গায় রিকশা মিলেছিল– অল্প রাস্তার জন্য। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু প্রবীন সত্যেনদার অফুরান্ত প্রাণ আমাদের উদ্দীপ্ত করেছে সামনে এগোতে। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ভারতের সোনামুড়া সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছে যাই। তখন অবস্থা ভালো ছিল না। প্রতিনিয়ত গুলি বিনিময় হচ্ছিল। নিয়মিত টহল চলছে। নিরাপদ সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হলো। এদিকে সত্যেনদা রক্ত আমাশয় আক্রান্ত হলেন। শাহাদাত ও আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম। স্থানীয় বাজার থেকে ঔষধ সংগ্রহ করে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করা হলো। এরই মধ্যে সবুজ সংকেত মিলল। নিরুপায় হয়ে আবার যাত্রা শুরু করতে হলো দুর্বল শরীর নিয়ে। মাইলের পর মাইল হাঁটা। আমরা তরুণরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, কিন্তু সত্যেনদা ক্লান্তিহীন। দৃপ্ত পায়ে টানা হেঁটে চলেছেন। প্রায় ছ'ফুট লম্বা ছিপছিপে শরীরে সাদা শার্ট, সাদা পাজামা পরা সত্যেন সেন বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছেন ক্ষেতের সরু আইল ধরে সীমান্তের দিকে। তার এই এগিয়ে যাওয়া আমাদেরকে উজ্জীবিত করে। আমরাও জোর কদমে এগিয়ে যাই। কখন যে সীমান্ত অতিক্রম করে ওপারে চলে গিয়েছি খেয়াল করা হয়নি। কিছু লোকজন দেখে কথা বলে বুঝতে পারি। পরিচয় পেয়ে আমাদের এক জায়গায় বসার ব্যবস্থা করলেন তারা। মনে মনে একটু স্বস্তি বোধ করলাম সত্যেনদাকে অবরুদ্ধ বাংলাদেশ থেকে উদ্ধার করে আনতে পেরেছি। তখনো মিশন শেষ হয়নি। তাই কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে আবার রওনা দেই আগরতলার পথে। দুপুরের আগেই পৌঁছে যাই আগরতলা ক্রাফট হোস্টেলে। পার্টির যুদ্ধকালীন আস্তানা। নেতাদের কাছে সত্যেনদাকে পৌঁছে দেয়া মাত্র আমাদের মিশন শেষ হলো। তিনি বেশ কাহিল হয়ে পড়েছিলেন। দ্রুত তার সেবা যত্ন শুরু হলো। দুপুরের খাবার খেয়ে আমাদের জন্য নির্ধারিত স্থানে চলে এলাম।

সত্যেনদাকে পৌঁছে দিয়ে আমাদের আবার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ঢুকতে হলো অবরুদ্ধ বাংলাদেশে। কিছু চিঠি আর কিছু মৌখিক নির্দেশ সাথে নিয়ে ফিরে এলাম আমাদের ঢাকা শহরে। দ্রুত চিঠিগুলো যথাস্থানে পৌঁছে দিয়ে অল্প সময়ের জন্য বাসায় যাই। দেখা করি মা-বাবার সাথে। যদি আর কোনোদিন যদি দেখা না হয় …। আমরা ফিরে চলেছি সীমান্তের ওপারে… প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরবো দেশমাতৃকার মুক্তির যুদ্ধে। ফেরার পথে আওয়ামী লীগের নেতা ফকির শাহাবুদ্দিনকে আগরতলা পৌঁছানোর দায়িত্ব পড়ে আমাদের উপর। ফিরে চলি আগরতলায়। মনে পড়ছে সত্যেনদা'র কথা। তার অনুপ্রেরণায় 'উদীচী করেছি, নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখছি। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পেও আমরা গানের দল করেছি। অ্যাসেম্বলি এবং রাতের অনুষ্ঠানগুলোতে আমরা সমবেত গণসঙ্গীত গেয়ে সবাইকে উজ্জীবিত রাখতে সচেষ্ট থাকতাম। আমি প্রায় সত্যেনদা'র লেখা ও সুর করা সেই বিখ্যাত গান গাইতাম-

"মানুষের ভালবাসি এই মোর অপরাধ

মানুষের কাছে পেয়েছি যে বাণী তাই দিয়ে রচি গান

মানুষের লাগি ঢেলে দিয়ে যাবো

মানুষের দেয়া প্রাণ'।

মুক্তিযুদ্ধে উদীচী

মুক্তিযুদ্ধে উদীচীর কর্মীরা নানাভাবে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। যার কিছুটা উল্লেখ আছে কবি হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গন্থে। আমরা ছিলাম গেরিলা বাহিনীর প্রথম ব্যাচ। সেখানে আমিসহ আরো ক'জন ছিলাম যারা প্রশিক্ষণ নিতাম আবার কোরাস গানও গাইতাম ক্যাম্পে। দ্বিতীয় ব্যাচে ছিল অনেক গুণিশিল্পী। সত্যন দা মুক্তির লড়াইয়ে গান রচনা করেছেন, বই লিখছেন ও আমাদের তৈরি করেছেন সম্মুখ লড়াইয়ের জন্য। সে অর্থে তিনি আমাদের সেনাপতি।

'গেরিলা গেরিলা আমরা গেরিলা স্বাধীনতার রক্তে রাঙা আমরা গেরিলা', 'তোমার ভয় নেই মা আমরা', 'জাগো অনশন বন্দী ওঠরে যত জগতের লাঞ্চিত ভাগ্যহত জাগো' এই গানগুলো আমরা করতাম ক্যাম্পে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আমাদের জনপ্রিয় গানগুলো বাজানো হতো।

উদীচী, ছায়ানট, ক্রান্তির শিল্পীরা সেদিন শব্দসৈনিক হিসাবে কাজ করেছে, উজ্জীবিত করেছে বলা যায়। উদীচীর সহযোগী ও পরামর্শদাতা শহীদ জহির রায়হান ও সৈয়দ হাসান ইমাম শিল্পী সৈনিক হিসাবে আমাদের সংগে ছিলেন। সত্যেন দা সংগে ছিলেন আর তার গান করেছি মুক্তিযুদ্ধের সময়। ক্যাম্পে আমাদের গানের দলে ছিলেন মনজু ভাই, ইয়াফেস ওসমান, মাহমুদ সেলিম, মুনজুর আলী নন্তু।

সত্যেনদার শান্তিনিকেতনের শেষদিনগুলি

চিকিৎসায় কোন উন্নতি হবে না নিশ্চিত হবার পরে আত্মীয়-স্বজনরা সত্যেনদাকে আর ঢাকায় ফিরতে দিলেন না। তিনি আশ্রয় নিলেন শান্তিনিকেতনের গুরুপল্লীতে মেজদিদি প্রতিভা সেনের কাছে। দৃষ্টিহীন বা ক্ষয়িষ্ণু শরীর সত্যেন সেনকে নিস্ক্রিয় রাখতে পারেনি। ওই অবস্থায় তিনি লেখাপড়ার কাজ চালিয়ে গেছেন। অন্যের সাহায্য নিয়ে শ্রুতিলিপির মাধ্যমে লিখে ফেললেন "জীববিজ্ঞানের নানা কথা" (১৯৭৭) নামের বইটি। আর সাংগঠনিক কাজ চালিয়ে গেছেন চিঠি লিখে। চিঠি লেখায় তিনি ছিলেন অনন্য। ১৯৬৩ সালে জেলে বসে লেখা "রুদ্ধদ্বার মুক্ত প্রাণ" বইটি মূলত পত্রোপন্যাস। প্রেমিকাকে লেখা এক রাজবন্দীর রোমান্টিক পত্রগুচ্ছ। বাংলা সাহিত্যে এ ধরনের লেখা আর বোধকরি কেউ লেখেনি।

শান্তিনিকেতন থেকে হালকা সবুজ প্যাডের কাগজে লেখা সত্যেনদা'র চিঠি ঢাকায় অনেকেই নিয়মিত পেতেন। আমিও বাদ ছিলাম না। অনেক চিঠি পেয়েছি তার কাছ থেকে। প্রথমদিকে আঁকাবাঁকা হাতে লিখতেন। মনে হয় তখনো কিছুটা দেখতে পেতেন। পরের দিকে চিঠিগুলো লিখেছেন অন্যের সাহায্য নিয়ে। তবে চিঠির নীচের স্বাক্ষরটা দাদা নিজেই করতেন। সবুজ কাগজে লেখা সেইসব চিঠিতে থাকত তার প্রাণের ছোঁয়া। তিনি লিখতেন 'উদীচী'র কথা। বিভিন্ন কর্মীর সম্পর্কে জানতে চাইতেন। দেশের নানা বিষয় নিয়ে উদ্বেগ থাকত। থাকত পরামর্শ-দিকনির্দেশনা। উৎসাহ-উদ্দীপনার কথকথা। চিঠিগুলো পড়ে বুকটা ভরে যেত। মনে হতো সত্যেনদা আমাদের সাথেই আছেন। তার অনুপস্থিতি পূরণ করত চিঠিগুলো। সেগুলো সংরক্ষণ না করে আজ নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে। কেউ শান্তিনিকেতনে গেলে তিনি সবার কথা আলাদা করে জিজ্ঞেস করতেন। দেশের ভালো খবর তাকে শিশুর মতো আনন্দমুখর করে তুলত।

দেশ ছাড়ার আট বছর পরে ৫ জানুয়ারি ১৯৮১ সালে সত্যেনদা শান্তিনিকেতনের গুরুপল্লীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গত শতাব্দীর আশির দশকেও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত ছিল না। তার মহাপ্রয়াণের শোক সংবাদটি ঢাকায় বসে আমরা অনেক দেরিতে পাই। ঢাকার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নিয়ে আসে শোকের দীর্ঘশ্বাস। সত্যেনদা চলে গেছেন তেত্রিশ বছর কেটে গেছে। কিন্তু তিনি আজও বেঁচে আছেন 'উদীচী' কর্মীদের প্রতিদিনের কাজের মাঝে। তার হাতে গড়া আমার মত হাজারো কর্মীদের যাপিত জীবনে তিনি আজও বেঁচে আছেন।

সত্যেন সেনের খোঁজে শান্তিনিকেতনে

শান্তিনিকেতনের সাথে সত্যেন সেনের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ১৯৩১ সালে সত্যেনদা রাজবন্দী হিসেবে কারাগার থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ পাশ করেন। জেল থেকে বের হলে শান্তিনিকেতনের তখনকার উপাচার্য জ্যেঠামশায় ক্ষিতিমোহন সেন তার জন্য 'ভাষাতত্ত্বে' গবেষণাবৃত্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু সত্যেন সেন এই সুযোগ গ্রহণ না করে চলে গেলেন পূর্ববাংলায় শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার ব্রত নিয়ে। শেষজীবনে আবার ফিরে এসেছিলেন সেই শান্তিনিকেতনে।

কয়েকবছর আগে ভারতে গেছি। পৌষমেলা দেখতে শান্তিনিকেতনে যাই। যদিও মনে ছিল সত্যেনদার শেষ বাসস্থান দেখা, স্মৃতিজড়িত জায়গাগুলো দেখা, যেখান থেকে চিঠি লিখে তিনি আমাদের জাগিয়ে রেখেছিলেন। খবর পেলাম মেলা উপলক্ষে সত্যেনদার ভাগ্নে অমর্ত্য সেন শান্তিনিকেতনে এসেছেন। আমি ও নীলু খুব ভোরবেলা চলে গেলাম তার বাসায়। শুনি তিনি প্রাতভ্রমণে বেরিয়েছেন। দ্বাররক্ষী জানালো শীঘ্রই তিনি ফিরবেন। ইতোমধ্যে আরো কয়েকজন বিদেশি এলো, অমর্ত্য সেনের সাথে দেখা করার জন্য। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর তিনি ফিরে এলে পরিচয় দেই। বাংলাদেশ থেকে এসেছি এবং সত্যেন সেনের খোঁজে এসেছি বলায় আমার প্রাণের আবেগ বোধহয় তাকে ছুঁয়ে গেল। বিদেশিদের সাথে পরে দেখা করার আশ্বাস দিয়ে আমাদের নিয়ে ঢুকে পড়লেন ঘরের ভেতরে। বিশাল বাড়ি। সাজসজ্জায় বাড়িটি এখনো ধরে রেখেছে পুরোনো দিনের ঐতিহ্য। নিজে ঘুরে দেখালেন বাড়ির ভেতরটা। কিছু পারিবারিক পুরোনো ছবি দেখা হলো। নিয়ে গেলেন খাবার টেবিলে। প্রাতঃরাশে আমাদের অংশগ্রহণ করতে হলো। খেতে খেতে উনি সত্যেনদা সম্পর্কে অনেক কথা জানতে চাইলেন। বুঝতে পারি সত্যেনদা বাংলাদেশে জীবন কাটানোতে ভাগ্নের কাছে মামা একজন রহস্যময় পুরুষ হয়ে আছেন। আমাকে অনুরোধ করলেন সত্যেন স্মৃতি নিয়ে লিখে তাকে ই-মেইল করে দিতে। নিজ হাতে তার ই-মেইল অ্যাড্রেসটা লিখেও দিলেন। নীলুর সাথে দেশের অবস্থা আর অর্থনীতি নিয়ে কথা বললেন। তাকেও বললেন যোগাযোগ রাখতে। সংস্কৃতে একটা কথা আছে–নরনং মাতুলক্রম। সত্যেন সেন আর অমর্ত্য সেনের ক্ষেত্রে এই প্রবাদ শতভাগ সত্য। দু'জনের চেহারায় ভীষণ মিল আছে। কথাটা বলেই ফেললাম, "আজ আপনার সাথে দেখা হয়ে মনে হচ্ছে সত্যেনদা'র সাথে আবার দেখা হলো।" এই বাড়িটির চারপাশেই ছড়িয়ে আছে সত্যেন সেনের স্মৃতি।

কথা ছিল উদীচীর পুরোনো দিনের কথা লিখব কিন্তু তবুও চলে আসে সত্যেন সেনের স্মৃতি। কেননা উদীচী আর সত্যেনদা ছিলেন অবিচ্ছেদ্য।

আমরা করবো জয় একদিন

সত্যেন সেন ১৯০৭ সালের ২৮ মার্চ জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিক্রমপুর (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলা) জেলার টঙ্গিবাড়ি উপজেলার সোনারং গ্রামে। ১৯২৪ সালে গ্রামের হাইস্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করে কলকাতা যান উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য। ফিরে আসেন দেশকর্মী হয়ে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় তার পরিবারের সবাই ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলেও তিনি শোষণহীন সমাজ নির্মাণের ব্রত নিয়ে রয়ে যান এই বাংলায়। জীবন যৌবনের পুরোটাই কাটিয়েছেন এদেশের মানুষের মাঝে–তাদের মুক্তির লক্ষ্যে। অথচ আমরা কি তাকে যোগ্য সম্মানটুকু দিতে পেরেছি? লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সত্যেনদা' সাহিত্যকর্মের জন্য ১৯৬৯ সালে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। ১৯৮৬ সালে তিনি একুশে পদক পেয়েছেন। তিনটির দুটোই স্বাধীনতার আগে। অপর পুরস্কারটি পেয়েছেন স্বৈরাচারী শাসন আমলে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের চেতনাবাহী দলের শাসন আমলে তিনি রয়ে গেছেন বিস্মৃতির অন্তরালে। কোনোভাবে স্মরণ বা সম্মানিত করা হয়নি জাতির এই নিবেদিতপ্রাণ সন্তানটিকে। আরো কষ্টকর যে, তার গড়া 'উদীচী'ও তার রচনাবলি প্রকাশের কাজটি বছরের পর বছর চলে গেলেও সমাপ্ত করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত উদীচীর বদিউর রহমান ভাই বাংলা একাডেমির সহযোগিতা নিয়ে প্রায় কাজটি শেষ করে এনেছেন।

আমরা হয়তো খুব সহজেই পারতাম সত্যেন সেনের স্মৃতিরক্ষার্থে একটি নাট্যশালা বা মিলনায়তনের নামকরণ করতে; কিংবা একটি সড়কের নামকরণ করতে, তাকে স্বাধীনতা সংগ্রামীর মর্যাদা দান করতে। আবারো চেষ্টা করা যেতে পারি। একদিন হয়তো পারবই।

সত্যেন সেন প্রয়াত হবার পরে তেত্রিশটা বছর কেটে গেছে। ষাটের দশকে তার সংস্পর্শে আসা তরুণের দলটির প্রায় সবাই ছিল মুক্তিযোদ্ধা। অনেকেই ছিল প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রাজনৈতিক কর্মী। তাদের কেউ কেউ আজ আর বেঁচে নেই। যারা বেঁচে আছে তারা আজও পাল্টে দেবার স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখে একদিন সূর্যের ভোর আসবেই।

উদীচী ও সত্যেন দা আজও আমার জীবনে প্রেরণার উৎস হয়ে আছেন।