গার্মেন্টস শ্রমিকের মজুরি !

ফেরদৌস আহমেদ উজ্জলফেরদৌস আহমেদ উজ্জল
Published : 30 July 2018, 01:10 PM
Updated : 30 July 2018, 01:10 PM

বস্তির মানুষের জীবন জীবিকা ও তাদের বেঁচে থাকা নিয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণায় আমি যুক্ত ছিলাম। সেই গবেষণার কাজে ঢাকার অধিকাংশ বস্তিতে আমার যাবার অভিজ্ঞতা  হয়েছিল।  বস্তিবাসী ও নিম্নআয়ের বড় অংশ মানুষই ছিল গার্মেন্টস শ্রমিক। যারা ঢাকা শহরের বিভিন্ন গার্মেন্টস এ কাজ করেন। তাদের জীবন, জীবিকা, বেঁচে থাকা, পরিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য নিয়ে অনেক তথ্য আমরা সংগ্রহ করেছি প্রায় ৬ মাসের এই গবেষণায়।

গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য উপাত্তের মধ্যে একটি হলো ঢাকা শহরের সবচেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করেন যারা তাদের মধ্যে অন্যতম হলো গার্মেন্টস শ্রমিকরা। তাদের মধ্যে আবার অধিকাংশই হলো নারী শ্রমিক।  এই বস্তির তালিকায় ঢাকার গুলশান, বনানী, মহাখালী, মগবাজার, আগারগাঁও, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, কমলাপুর, আদাবর, কামরাঙ্গীরচরসহ বিভিন্ন অঞ্চল। এসকল বস্তির অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই তাদের জীবনযাপন করতে হয়। তাদের শিশুরা বেড়ে ওঠে এক  অসুস্থ পরিবেশের মধ্যে দিয়ে। যদিও আমাদের দেশের সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক আয় আমরা তাদের হাত দিয়েই করে থাকি।

প্রতিদিন ভোরবেলা এই সকল অঞ্চল থেকে অধিকাংশ গার্মেন্টস শ্রমিকরা হেঁটে তাদের কর্মক্ষেত্রে যায়। প্রাত্যহিক তাদের দিন শুরু হয় ভোরের আলো ফুটবার আগেই। এই সময়ে তারা নিজেদের প্রস্তুত করে, সন্তানদের খাইয়ে দাইয়ে নিজেদের খাবার প্রস্তুত করে কাজে চলে যান। সারাদিন তারা একভাবে কাজ করে রাতে ঘরে ফেরেন। তারা যেসকল ঘরগুলোতে বসবাস করেন সেই ঘরগুলোর গড় ভাড়া ২৫০০ থেকে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত । কোথাও কোথাও এর থেকেও বেশি ভাড়ায় থাকতে হয়।

বস্তিতে তাদের নেই স্বাস্থ্যকর পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা, পানির ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত আলো বাতাসের ব্যবস্থা। অস্থায়ী বস্তি হওয়ার কারণে অধিকাংশ বস্তিতে তাদের বসবাস স্থায়ী নয়। যেকোন সময় সরকারি বুলডোজার, অগ্নিকাণ্ড (ইচ্ছেকৃত) তাদেরকে বাস্তুচ্যূত করে। তাদের সন্তানরা শিক্ষার ন্যূনতম অধিকার থেকে বঞ্চিত। প্রতিবছরই নানা রকমের জ্বর, চিকুনগুনিয়া, টাইফয়েড, ডায়েরিয়াসহ নানান মহামারিতে তারাই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। এক কথায় সব থেকে প্রান্তিক অবস্থায় গার্মেন্ট শ্রমিকদের বসবাস করতে হচ্ছে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতিসহ নাগরিক ব্যয়ভারে তাদের বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়ে।

এই কথাগুলো বলার অর্থই হলো বাংলাদেশের অন্যতম বৈদেশিক অর্থ উৎপাদনকারী সেক্টরের গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হয়েও এ দেশের গার্মেন্টস শ্রমিকরা যে মজুরি পান তা বিশ্বের যেকোন জায়গার তুলনায় নগন্যই।  শুধু নগন্যই নয় এই মজুরি দিয়ে তাদের পরিবারের প্রতিদিনকার খাওয়া পড়াই কঠিন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে প্রায় ৪০ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিক এ পেশায় নিয়োজিত। মজুরির হিসাব করলে বাংলাদেশের শ্রমিকরা মাসে মাত্র ৬৬ ডলার যা টাকায় দাঁড়ায় ৫৪১২ টাকা। যা এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। অন্যদিকে কম্বোডিয়ায় ন্যূনতম মাসিক মজুরি ১৪০ ডলার, ভিয়েতনামে ১৪৭ ডলার, ফিলিপাইনে ২০২ ডলার, ইন্দোনেশিয়ায় ১৬০ ডলার, মালয়েশিয়ায় ২২৩ ডলার, থাইল্যান্ডে ২৬৫ ডলারচীনে ২৩৪ ডলার, মিয়ানমারে ৭০ ডলার, ভারতে ১৪৪ ডলার, পাকিস্থানে ১০৬ ডলার, শ্রীলংকায় ৬৯ ডলার, নেপালে ৭৪ ডলার এবং এমনকি আফগানিস্থানে ৭৩ ডলার। বিগত চারদশকে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে রপ্তানি আয় বেড়েছে বহুগুণ কিন্তু সেই অনুপাতে শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত হয়নি। এক্ষেত্রে মালিকদের অর্থ বিত্ত বহুগুণে বৃদ্ধি পেলেও চরম অবহেলার শিকার শ্রমিকরা।

বর্তমান সময়ে আবারো মজুরি প্রশ্নটি সকলের সামনে চলে এসেছে। শ্রমিক সংগঠনগুলো আবারো রাস্তায় নেমেছে মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে। এক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য স্পষ্ট। তাদের দাবি হলো শ্রমিকদের ন্যূনতম বেঁচে থাকার মতো মজুরি ব্যবস্থা তৈরি হওয়া জরুরি। গত কয়েক বছরের মূল্যস্ফীতিতে জীবনযাত্রার  ব্যয় বেড়ে গেছে অনেকগুণ। এক্ষেত্রে তাদের দাবি ন্যূনতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা। আমরা জানি, এদেশের প্রধান শিল্পখাত পোশাক শিল্পে ১৯৮৫ সালে মজুরি ছিল মাত্র ৫৪২ টাকা। ১৯৯৪ সালে তা বাড়িয়ে করা হয় ৯৩০ টাকা। তারও প্রায় একযুগের বেশি সময় পরে ২০০৬ মজুরি বাড়িয়ে করা হয় ১ হাজার ৬৬২ টাকা। এরপর ২০১০ সালে নিম্নতম মজুরি বাড়িয়ে করা হয় ৩ হাজার টাকা আর সর্বশেষ ২০১৩ সালে ৫ হাজার ৩০০ টাকা করে মজুরি কমিশন।

আমরা জানি পৃথিবীর সকল পেশায় বেতন ও মজুরি বৃদ্ধির একটি সুস্পষ্ট ব্যবস্থা থাকলেও আমাদের দেশে তা অনুসরণ করা হয় না। যার কারণে প্রতিবারই মজুরি বৃদ্ধির জন্য শ্রমিকদের আন্দোলন করতে হয়। আর এক অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হয় পুরো সেক্টর জুড়ে। কিন্তু আমরা দেশি এই পরিস্থিতির জন্য কেবলমাত্র শ্রমিক সংগঠন ও শ্রমিকদেরকেই দায়ী করা হয় সরকার ও মালিক পক্ষ থেকে। মজুরি কমিশনের মাধ্যমে বার্ষিক ৫ শতাংশ হারে মজুরি বাড়ানোর বিধান থাকলেও তা কার্যকর করা হয় নি। গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির জন্য নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠিত হয়েছে গত জানুয়ারিতে। শ্রম আইনে মজুরি বোর্ডের কার্যক্রম ৬ মাসের মধ্যে সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু ইতোমধ্যে বোর্ডের সভা হয়েছে মাত্র একটি। যার কারণে মজুরি বৃদ্ধির পুরো প্রক্রিয়াটিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) হিসেবে, ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের জন্য মূলত তিনটি মডেলকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। এর প্রথম মডেলটি হচ্ছে, দারিদ্র্যসীমার ওপরে অবস্থানকারী একজন শ্রমিকের মাসিক খরচের হিসাব বিবেচনায় নিয়ে ন্যূনতম মজুরি ঠিক করা। দ্বিতীয় মডেলটি হলো, কাঙ্ক্ষিত পুষ্টি অর্জনের জন্য একজন মানুষের যে সুষম খাবার, তা বিবেচনায় নিয়ে ন্যূনতম মজুরি ঠিক করা। তৃতীয় মডেলটি হলো, শ্রমিকদের বর্তমান জীবনধারণের খরচের হিসাব বিবেচনা করে তার ওপর ভিত্তি করে ন্যূনতম মজুরি ঠিক করা।

সিপিডি বলেছে, দারিদ্র্যসীমার ওপরের স্তরে অবস্থানকারী প্রায় পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারে 'জাতীয় খানা আয়-ব্যয় জরিপ' অনুযায়ী খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভুত পণ্য ও সেবা কেনার ব্যয় মাসে ৯ হাজার ২৮০ টাকা। পরিবারের প্রধান উপার্জনকারীকে এক্ষেত্রে আয় করতে হবে ৬ হাজার ৪৪৫ টাকা। সিপিডির হিসেবে পরবর্তী দু'টি মডেলে এই পরিমাণ আরও বাড়ে। কাঙ্ক্ষিত পুষ্টিহার অনুযায়ী খাবার গ্রহণ ও জীবনধারণের জন্য একজন শ্রমিকের প্রতিমাসে ন্যূনতম মজুরি প্রয়োজন ১৭ হাজার ৮৩৭ টাকা।

বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বলকারী কিছু উপাদানের মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প। বাংলাদেশের গার্মেন্টস বিশ্বব্যাপী এক অনন্য জায়গা করে নিয়েছে। আর সে বিবেচনায় এই শিল্পের শ্রমিকদেরকেই এর অন্যতম কৃতিত্ব দিতে হবে। যদিও সাভারের রানাপ্লাজায় ভবনধসে সহস্রাধিক শ্রমিকের নির্মম মৃত্যু এবং তাজরীন ফ্যাশনসে দেশের স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বাংলাদেশের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোকে শ্রমিকদের মৃত্যুকূপ হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি দিয়েছে। পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার সহ নানান সঙ্কটের মধ্যে আমাদের এই শিল্প আবর্তণ করছে। সে বিবেচনা মাথায় নিয়ে সরকার, শ্রমিক ও মালিকপক্ষের উচিত একটি সুষ্ঠু সমাধানের পথ খুঁজে বের করা।

শ্রমিক আন্দোলনে দরকষাকষি যেমন ন্যায্য একইভাবে মালিকপক্ষের বক্তব্যও শুনতে হবে। এক্ষেত্রে সার্বজনীন উদাহরণগুলো ও আন্তজার্তিক মানদণ্ড মেনে মজুরি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া জরুরি। একটি কথা সকল মহলেরই মানতে হবে এই শিল্প আমাদের সকলের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। এটি কেবল মালিকের মুনাফা তৈরির জায়গা নয়। গার্মেন্টস শিল্পকে এগিয়ে নিতে হলে শ্রমিকের ন্যায্য মজুরির প্রশ্নটি ফয়সালা করেই আমাদের এগুতে হবে।