অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধা ফরিদ আহমদ ও আমাদের লজ্জা

Published : 11 Feb 2022, 01:24 PM
Updated : 11 Feb 2022, 01:24 PM

স্বাধীনতার  ৫০ বছর পেরিয়েছে। এই তো ২০২১ সাল জুড়েই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করেছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম আর একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম তো একই সুতোয় গাঁথা। 

আর তার ডাকে সাড়া দিয়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার বঞ্চিত, শোষিত, নির্যাতিত অন্তত সাত কোটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য যারা আত্মসুখ, ঘর-সংসার, পরিবার-পরিজন, জীবনের মোহ পরিত্যাগ করে যুদ্ধে গিয়েছিলেন তারা আমাদের পরম বন্ধু, পরম আত্মীয়, পরম কল্যাণমিত্র, পরম হিতৈষী, পরম আপনজন। 

শুধু তাই নয় মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের স্বাধীনতার জন্য যে যেভাবে অংশ নিয়েছেন তারা সকলেই আমাদের দেশের দেশপ্রেমী বীর সন্তান। তাদের প্রতি আমাদের দায় কখনো শেষ হবার নয়। রাষ্ট্র, সরকার এবং জনগণ আমরা সবাই তাদের কাছে চিরদিনের মতো দায়বদ্ধ। 

আমরা যারা একাত্তর ধারণ করে পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে গড়ে উঠেছি আমাদের নিজেদের ভেতরে এক ধরনের আত্মগ্লানি আর হাহাকার তৈরি হয় যখন শুনি, দেখি যে কোনও মুক্তিযোদ্ধা চরম অবহেলা-অমর্যাদায়, অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। স্বাধীনতা লাভের ৫০ বছর পরে এসে যখন কোনও মুক্তিযোদ্ধাকে তার স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য রাষ্ট্রের দপ্তরে দপ্তরে আকুতি-মিনতি জানাতে হয়, ধর্ণা দিতে হয়- তখন জাতির কাছে এটা অত্যন্ত লজ্জাজনক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যদি তার এই আকুতি-মিনতি আর আবেদনকে মূল্যায়ন করা হতো, সম্মান করা হতো- তাহলে হয়তো কিছুটা গ্লানিবোধ কমতো। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ স্বীকৃতি পাওয়ার আশায় আশায় জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলোও কাটিয়ে দিয়ে এক বুক কষ্ট আর অভিমান নিয়ে চিরবিদায় নিচ্ছেন।

জীবনের শেষ প্রান্তে চলে আসা তেমনই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হলেন ফরিদ আহমদ। তিনি ১৯৫৪ সালের ১০ এপ্রিল রামু উপজেলার মন্ডলপাড়া গ্রামে জন্ম নেওয়া ফরিদ আহমদ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। তিনি এক নম্বর সেক্টরের অধীন পার্বত্য চট্রগ্রামের বান্দরবানের জুমখলা, সোনাইছড়ি এবং নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকার প্রশিক্ষণ শিবিরে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। এ শিবিরের প্রশিক্ষক ও কমান্ডার ছিলেন সুবেদার নূর আহমদ (মৃত)। রামু উপজেলার কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের সিপাহী মোক্তার আহমদ (গেজেট নং- ৩৪২১), আবদুল জব্বার (গেজেট নং- ৩৪২১), ভোলা নাথ শর্মা (গেজেট নং- ৩৪২১)। তারা সবাই ফরিদ আহমদের সাথে একই শিবিরে একই প্রশিক্ষকের অধীনে প্রশিক্ষণ নেন এবং যুদ্ধ করেন। একথা সহযোদ্ধা হিসেবে তারা নিজেরাই লিখিতভাবে জানিয়েছেন। ফরিদ আহমদের কাছে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি আতাউল গনি ওসমানী স্বাক্ষরিত দেশ রক্ষা বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্রও আছে। এছাড়াও অস্ত্র জমাদানের রশিদ, উপজেলা কমান্ডারের প্রত্যয়নপত্র, জেলা কমান্ডারের প্রত্যয়নপত্র, ইউনিয়ন কমান্ডারের প্রত্যয়নপত্র, প্রশিক্ষণ সনদসহ একজন মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে প্রমাণ হিসেবে যেসব প্রমাণাদি প্রয়োজন হয় তার সবকিছুই ফরিদ আহমদের কাছে আছে। সমস্ত প্রমাণাদিসহ আবেদনের পরও তিনি আজ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভূক্ত হতে পারছেন না কেন?

সবশেষ গত ২০১৭ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় 'মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি'কে দশ কার্য দিবসের মধ্যে অর্থাৎ ১৮.০১.২০১৭ থেকে ২৮.০১.২০১৭ তারিখের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই প্রতিবেদন প্রেরণ করার জন্য আদেশ দেয়। সেই আদেশ মোতাবেক রামু উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি যে প্রতিবেদন তৈরি করে সেই প্রতিবেদন তালিকাতেও সাত নম্বরে ফরিদ আহমদের নামও আছে। উক্ত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটিগুলোতে স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী অফিসারের পাশাপাশি জেলা কমান্ডারের প্রতিনিধি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, কেন্দ্রিয় কাউন্সিলের প্রতিনিধি, উপজেলা কমান্ডারও ছিলেন।

সমস্ত প্রমাণাদি সরবরাহ এবং সরকার কর্তৃক নিয়োজিত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিশ্চিত করার পরও কী এমন বাধা আছে যে যার জন্য স্বাধীনতা লাভের ৫০ বছর পরও ফরিদ আহমদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি লাভ করতে পারছেন না? এরকম আরো কত ফরিদ আহমদ অগোচরে রয়ে গেছে তাদের সবার খবর রাষ্ট্র কি রাখতে পেরেছে? যারা মুক্তিযোদ্ধা হবার পরও স্বপক্ষে প্রমাণাদি সংগ্রহ কিংবা সরবরাহ করতে পারছেন না বলে হয়তো অনেকে আবেদনও করতে পারছেন না কিন্তু যারা সমস্ত প্রমাণাদি উপস্থাপন করে আবেদন করছেন তাদের এই পরিণতি হবে কেন? রাষ্ট্রের বীর সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা আর সুযোগ-সুবিধা সমূহ অনায়াসে পাবেন সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। যদিওবা এসবের আশায় কোনও মুক্তিযোদ্ধা সেদিন জীবনের মোহ ত্যাগ করে এদেশ এবং দেশের মানুষের জন্য যুদ্ধে যাননি।