‘সাংবাদিকতা’ কেন কঠিন হয়ে পড়ছে

জামালপুরের সাংবাদিক গোলাম রব্বানি নাদিম হত্যায় কয়েকজন দুর্বৃত্তকে আটক করা হয়েছে। এই দুর্বৃত্তরাও হয়তো সিরাজগঞ্জের সাংবাদিক শিমুল হত্যার আসামিদের মতো কিছুদিন জেল খেটে বেরিয়ে আসবেন এবং সাগর-রুনির মতো নাদিম হত্যা মামলাটিও বছরের পর বছর ঝুলতে থাকবে।

আমীন আল রশীদআমীন আল রশীদ
Published : 16 June 2023, 10:16 AM
Updated : 16 June 2023, 10:16 AM

বলি হলো আরেকটা প্রাণ। বলছি জামালপুরে নিহত সাংবাদিক গোলাম রব্বানি নাদিমের কথা। গত ১৪ জুন রাত সোয়া ১০টার দিকে একদল সন্ত্রাসীর এলোপাতাড়ি মারধরে মারাত্মক আহত হন এবং পরের দিন ১৫ জুন ময়মনসিংহ মেডিকেল মারা যান।সাংবাদিক হত্যা নতুন কোনো ঘটনা নয়, এর পরিণতিতে প্রকৃত সাংবাদিকতা করা এখন যে কোনো সময়ের চেয়ে কঠিন হয়ে পড়েছে।  

কয়েকদিন আগে ব্যক্তিগত কাজে ঢাকার বাইরে গিয়েছিলাম। কথা হচ্ছিল জাতীয় একটি দৈনিকের প্রতিনিধির সঙ্গে, যিনি একজন পুলিশ অফিসারের দুর্নীতির খবর প্রকাশ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় এক মাসেরও বেশি সময় কারাগারে ছিলেন, যাঁর বিরুদ্ধে মামলার বাদী ছিলেন একজন রাজনৈতিক কর্মী। পত্রিকার মালিকপক্ষের উচ্চ পর্যায়ে তদবিরের ফলে তিনি বেরিয়ে আসতে পারেন। তিনি জানালেন, অপরাধবিষয়ক যে কোনো সংবাদ, বিশেষ করে যেখানে রাজনৈতিক, সামাজিক ও আর্থিকভাবে ক্ষমতাবানরা যুক্ত আছেন, তাদের বিষয়ে অনেক অভিযোগ পেলেও তিনি এখন আর সেসব অনুসন্ধানে খুব বেশি উৎসাহ পান না। কারণ অনুসন্ধান করে রিপোর্ট প্রকাশ করলেও ওই রিপোর্টের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় তাকে ফাঁসানো হতে পারে—এমন ভয়ে থাকেন। অর্থাৎ একধরনের স্বনিয়ন্ত্রণ বা সেলফ সেন্সরশিপ তাকে আঁকড়ে ধরেছে। ফলে এখন ভাবছেন ছোট খাটো ব্যবসায় মনোযোগ দেবেন। আর সাংবাদিকতার পরিচয়টি ধরে রাখার জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ বা ঝুঁকিমুক্ত রিপোর্ট করবেন। 

বস্তুত ‘সাংবাদিকতা’ করা এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে কঠিন। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে। ‘সাংবাদিকতা’ শব্দটিকে বন্ধনীর ভেতরে রাখার কারণ এখানে সাংবাদিকতা বলতে প্রকৃত সাংবাদিকতাকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যে সাংবাদিকতার মানে দল-মত-আদর্শ ও ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে ফ্যাক্ট অনুসন্ধান করে নির্মোহভাবে সঠিক তথ্য বের করে আনার চেষ্টা। যে সাংবাদিকতায় প্রশংসার চেয়ে প্রশ্ন বেশি। যে সাংবাদিকতায় প্রশংসা থাকলেও সেখানে যৌক্তিক সমালোচনা, প্রশ্ন ও সংশয় প্রকাশেরও সাহস থাকে। সেই সাংবাদিকতা করা এখন কেন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে কঠিন। কেন কঠিন—তার উত্তর খোঁজার জন্য এই লেখা। 

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা তদন্তের প্রতিবেদন দেওয়ার ব্যর্থতা ‘সেঞ্চুরি’র পথে। সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে আবার ব্যর্থ হয়েছে র‌্যাব। সে কারণে ৯৮ বারের মতো পিছিয়ে আগামী ২২ জুন প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছে আদালত। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার শফিকুল আলম প্রতিবেদন দাখিল না করায় ঢাকা মহানগর হাকিম রাশিদুল আলম গত ২২ মে এ আদেশ দেন। অর্থাৎ আর মাত্র দুবার পেছালেই এটি শততমর মাইলফলক স্পর্শ করবে এবং সম্ভবত পৃথিবীর বিচারিক ইতিহাসে রেকর্ড করবে। 

গণমাধ্যমে এই সংবাদটি আসার এক মাস না যেতেই গত ১৪ জুন রাতে জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলায় গোলাম রব্বানি নাদিম নামে এক সাংবাদিককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তাকে কারা হত্যা করেছেন? যথারীতি ক্ষমতাবানরা। রাষ্ট্রের সাধারণ ও নিরীহ মানুষ কাউকে হত্যা করতে পারে না। হত্যা করতে হিম্মত লাগে। সাহস লাগে। হত্যা করার পরে পার পেয়ে যাওয়ার মতো রাজনৈতিক, সামাজিকও আর্থিক সক্ষমতা লাগে। যে সক্ষমতার কারণেই প্রায় এক যুগেও সাগর-রুনির হত্যাকারীদের ধরা সম্ভব হয়নি। এমনকি কারা তাদের ‍খুন করলো সেটিও জানা সম্ভব হয়নি। অথবা জানা সম্ভব হলেও নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না।

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৭ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে আওয়ামী লীগের দুপক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে গুলিতে নিহত হন দৈনিক সমকালের শাহজাদপুর প্রতিনিধি আবদুল হাকিম শিমুল। শোনা যায়, শিমুল দুই গ্রুপের সংঘর্ষের সময় অস্ত্র মহড়ার ছবি তুলতে গেলে পৌর মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা হালিমুল হক মিরুর অস্ত্রহাতে ছবি তুলছিলেন, এতে পৌর মেয়র মিরু রাগে সাংবাদিক শিমুলকে লক্ষ্য করে গুলি করেন। যেভাবেই হোক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের ফলেই এ ঘটনা, এটিই সত্য। শিমুল লাঙ্গল চালিয়ে চাষাবাদ করে সংসার চালাতেন। উপজেলাপর্যায়ে সাংবাদিকতা করে যেটুকু টাকা পেতেন তা দিয়ে সংসার চলত না । নাট্যকর্মী হিসেবেও তার সুনাম ছিল।

আবদুল হাকিম শিমুলের খুনিরা ছাড়া পেয়ে গেছে। তাদের প্রধান হোতা হিসেবে অভিযুক্ত হয়েছিলেন শাহজাদপুরের তখনকার মেয়র হালিমুল হক মিরু। তিনিও ২ বছর সাড়ে ৯ মাস কারাভোগ করে জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। 

সেই খুনের তালিকায় এবার যুক্ত হলো গোলাম রব্বানি নাদিমের নাম। গত ১৪ জুন রাত সোয়া ১০টার দিকে একদল সন্ত্রাসীর এলোপাতাড়ি মারধরে তিনি নিহত হন। তিনি অনলাইন পোর্টাল বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জামালপুর জেলা প্রতিনিধি এবং একই সঙ্গে একাত্তর টিভির বকশীগঞ্জ উপজেলা সংবাদ সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করতেন। 

নাদিমের সহকর্মী ও স্বজনরা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সাধুরপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবুকে দায়ী করছেন। মাহমুদুল আলম সাধুরপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগেরও সাধারণ সম্পাদক। আর নাদিমের স্ত্রী মনিরা বেগম সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেছেন, সংবাদ প্রকাশের জেরে মাহমুদুল আলম তার স্বামীর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। আগেও নানাভাবে হেনস্তা করার চেষ্টা করেছেন। তার লোকজনই নাদিমকে হত্যা করেছে। কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু সম্ভবত তারাও সিরাজগঞ্জের সাংবাদিক শিমুল হত্যার আসামিদের মতো কিছুদিন জেল খেটে বেরিয়ে আসবেন এবং সাগর-রুনির মতো এই মামলাটিও বছরের পর বছর ঝুলতে থাকবে। স্বজন ও সহকর্মীরা প্রতি বছর বিচারের দাবিতে রাস্তায় মানববন্ধন করবেন।

২.

শুরুতেই বলেছি যে প্রকৃত সাংবাদিকতা করা এখন যেকোনো সময়ের চেয় কঠিন।স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের আমলেও সাংবাদিকতা এত কঠিন ছিল কি না সন্দেহ। যদিও তখন বাংলাদেশ টেলিভিশন ছাড়া আর কোনো চ্যানেল ছিল না। অনলাইন গণমাধ্যম ছিল না। সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। থাকলে এরশাদের আমলেও সাংবাদিকতার চেহারা কী হতো তা বলা কঠিন।

সরকারি অফিস থেকে তথ্য পাওয়া এখন খুবই কঠিন। অথচ দেশে তথ্য অধিকার আইন আছে। এরকম অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায় যে, তথ্য অধিকার আইন সাংবাদিকের তথ্য পাওয়ার পথ আরও কঠিন করে তুলেছে। কেননা, এখন সাংবাদিকরা ছোটখাটো কোনো তথ্যের জন্য গেলেও সরকারি কর্মকর্তারা নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে বলেন এবং দিনের পর দিন ঘুরাতে থাকেন। এক পর্যায়ে তারা জানিয়ে দেন যে তথ্যটি সন্নিবেশিত নেই অথবা কোনো উত্তরও দেন না। এর বিরুদ্ধে আপিল এবং তথ্য কমিশনে যাওয়ার জন্য যে ধৈর্য ও সময় লাগে, সেটি অনেকের পক্ষেই ব্যয় করা সম্ভব হয় না। অর্থাৎ আইনি কাঠামোই সাংবাদিকতাকে কঠিন থেকে কঠিনতর করে তুলেছে। কোনো ঘটনার ছবি তুলতে গেলে সেখানে পুলিশ বা সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা এসে বাধা দিচ্ছেন, এরকম অভিযোগ নিয়মিতই শোনা যায়।

অবশ্য সাংবাদিকতার প্রধান শত্রু এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এ আইনের এমনই সব ধারা রয়েছে যেগুলো দিয়ে যে কোনো একটি টেলিভিশন বা পত্রিকা কোনো একটি সংবাদ প্রকাশ বা প্রচার করলেই মামলা করার সুযোগ রয়েছে। অবশ্য একটু ঘুরিয়ে সুযোগটা রাখা হয়েছে। ছাপা পত্রিকা বা টেলিভিশনের খবরের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে দেওয়া যায় না, কিন্তু ওই খবরটিই যদি কেউ ফেসবুকে শেয়ার করেন বা ওই টেলিভিশন বা পত্রিকার অনলাইন মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তাহলে ডিজিটাল আইনে মামলা করা যায়। অথচ সংবাদটি ভুল হলে তার বিরুদ্ধে পত্রিকায় প্রতিবাদ পাঠানো, প্রেস কাউন্সিলে অভিযাগ দায়ের এমনকি মানহানির মামলা করারও সুযোগ আছে। কিন্তু ক্ষমতাবানরা এখন আর ওইসব ভদ্রোচিত পথে যেতে নারাজ। তারা চান তাৎক্ষণিক শাস্তি এবং এমন একটি ভয়ের পরিবেশ জারি রাখতে যাতে কেউ ক্ষমতাবানদের নিয়ে কোনো ধরনের সমালোচনামূলক লেখা, অপরাধের অনুসন্ধান এমনকি কার্টুনও ছাপতে সাহস না করে। কারণ ডিজিটাল আইনে মামলা দিলে তাতে সাংবাদিকদের হয়রানি ও নাজেহাল করা অনেক সহজ। এর শাস্তিও কঠিন। সাধারণত এই মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার করা হলে সহজে জামিনও মেলে না। এই আইনটি পাস হওয়ার পরে এ পর্যন্ত সাংবাদিকতার প্রধান শত্রু এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এ আইনের এমনই ধারা যে কোনো একটি টেলিভিশন বা পত্রিকা কোনো একটি সংবাদ প্রকাশ বা প্রচার করলো, সেই যুক্তিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা যায় না। কিন্তু ওই খবরটিই যদি কেউ ফেসবুকে শেয়ার করেন বা ওই টেলিভিশন বা পত্রিকার অনলাইন মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তাহলে ডিজিটাল আইনে মামলা করা যায়। অথচ সংবাদটি ভুল হলে তার বিরুদ্ধে পত্রিকায় প্রতিবাদ পাঠোনো, প্রেস কাউন্সিলে অভিযাগ দায়ের এমনকি মানহানির মামলা করারও সুযোগ আছে। কিন্তু ক্ষমতাবানরা এখন আর ওইসব ভদ্রোচিত পথে যেতে নারাজ। তারা চান তাৎক্ষণিক শাস্তি এবং এমন একটি ভয়ের পরিবেশ জারি রাখতে যাতে কেউ ক্ষমতাবানদের নিয়ে কোনো ধরনের সমালোচনামূলক লেখা, অপরাধের অনুসন্ধান এমনকি কার্টুনও ছাপতে সাহস না করে। কারণ ডিজিটাল আইনে মামলা দিলে তাতে সাংবাদিকদের হয়রানি ও নাজেহাল করা অনেক সহজ। এর শাস্তিও কঠিন। সাধারণত এই মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার করা হলে সহজে জামিনও মেলে না। ২০১৮ সালে এই আইনটি পাস হওয়ার পর ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে ৭ হাজার ১টি মামলা হয়েছে বলে জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলায় গ্রেপ্তারের সংখ্যা কত, সেটি জানাতে আইনমন্ত্রী পারেননি বলে ৫ জুন ২০২৩ তারিখের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়।

অস্বীকার করা যাবে না, এসব মামলার বিরাট অংশেরই ভিকটিম সাংবাদিকরা। বিশেষ করে করোনার অতিমারির সময়ে নানা ঘটনায় মনে হয়েছে এটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নয়, বরং গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ আইন। গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের জন্য আরও একাধিক আইন থাকলেও সেসব আইনের ক্ষমতা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের চেয়ে বেশি নয়। ফলে ক্ষমতাবানরা গণমাধ্যমকে ‘সাইজ’ করার জন্য এই অস্ত্রটি ব্যবহারেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। যদিও সরকারের তরফে বারবার বলা হয়েছে যে, ডিজিটাল আইন সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত করবে না বা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এটি ব্যবহার করা হবে না। আইনের অপপ্রয়োগ হবে না বলেও আশ্বস্ত করা হয়েছে। অথচ এখন পর্যন্ত এই আইনের প্রয়োগ দেখে মনে হয়েছে, এর প্রয়োগ মানেই অপপ্রয়োগ। ফলে নানামুখী সমালোচনার মুখে সরকার একাধিকবার জানিয়েছে যে আইনটি সংশোধন করা হচ্ছে। কিন্তু কী সংশোধন করা হবে এবং তার মধ্য দিয়ে গণমাধ্যম কতটা সুরক্ষিত থাকবে; সংবাদ প্রকাশ ও প্রচারিত হলেই তার বিরুদ্ধে এই আইনে মামলার প্রবণতা বন্ধ হবে কি না, সেটিও বিরাট প্রশ্ন।

৩.

সব আমলে সব সরকারই চায় গণমাধ্যম বা সাংবাদিকরা তার পক্ষে থাকবে। প্রশ্ন বাদ দিয়ে শুধু প্রশংসা করবে। কিন্তু প্রশ্ন ও সন্দেহমুক্ত প্রশংসা যে সংবাদ নয়, বরং প্রেসবিজ্ঞপ্তি—সেটি এখন সাংবাদিকদেরও বিরাট অংশ ভুলে যাচ্ছেন বা গেছেন। সাংবাদিকের কাজ যে ফ্যাক্ট অনুসন্ধান, সেই জায়গা থেকে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় গণমাধ্যম অনেক দূরে সরে গেছে।

এর পেছনে কিছু কারণও আছে। প্রথমত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো আইনি ভয়, প্রাতিষ্ঠানিক নানাবিধ চাপ, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে পেশাদারিত্ব গড়ে না ওঠা, সরকারের সঙ্গে গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের ব্যবসাসহ নানাভাবে সংশ্লিষ্টতাহেতু অনেক বিষয়ে প্রশ্ন করার নৈতিক অধিকার না থাকা, মন্ত্রীদের সঙ্গে বিদেশ ট্যুরসহ ব্যক্তিগত নানারকম সুবিধা গ্রহণ, ক্ষমতাবানদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক আছে—সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি ও স্ট্যাটাস দিয়ে সেটি বোঝানোরা মধ্য দিয়ে সামাজিকভাবে নির্ভয়ে থাকার নিশ্চয়তা; বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে নির্ঝঞ্ঝাটে সেবা পাওয়ার নিশ্চয়তাও সাহসী ও নির্মোহ সাংবাদিকতার পথ সংকুচিত করেছে। 

দ্বিতীয়ত, গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারক তথা সিনিয়র পজিশনের কর্তাদের কোনো কিছুর গভীরে যাওয়ার মানসিকতা না থাকা বা গভীরে গিয়ে কোনো কিছু অনুসন্ধান করে বের করে আনার পরে সেগুলো প্রকাশ ও প্রচার করলে বিপদের সম্মুখীন হওয়ার শঙ্কাজনিত নিরুৎসাহও সাহসী সাংবাদিকতার পথ সংকুচিত করেছে। এর বাইরে বিভিন্ন বাহিনীর তরফে সরাসরি বা পরোক্ষ চাপও থাকে। 

পক্ষান্তরে সাংবাদিকদের বিরাট অংশ নিজেরাই নানাবিধ অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের মধ্য দিয়ে প্রশ্ন করার নৈতিক অধিকার হারিয়ে ফেলেন। রিপোর্টারদের কিছু কিছু কাজের ক্ষেত্র বা বিট সম্পর্কে এমন সব কথা জনপরিসরে প্রচলিত আছে, যা শুধু ওই একটি বিটের সাংবাদিক নয়, বরং পুরো গণমাধ্যমের জন্যই অসম্মানজনক। 

একটি বিটের সব সাংবাদিক অনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন না। কিন্তু কিছু অংশও যদি খারাপ কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন এবং সেগুলো প্রতিরোধে যদি কোনো সাংগঠিনক বা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে এর দায় গিয়ে পুরো গণমাধ্যমেরও ওপরেই পড়ে। 

এখন সাংবাদিকতার প্রধান শত্রু স্বনিয়ন্ত্রণ বা সেলফ সেন্সরশিপ। কী করলে কী হবে বা হতে পারে—সাংবাদিকরা আগেভাগেই এরকম একটি ধারণা নিয়ে একটা সুরক্ষা বলয় তৈরি করে রাখেন। যেমন টেলিভিশনের বুলেটিনে কোন সংবাদটি প্রধান শিরোনাম হবে; কার সংবাদটি কোনোভাবেই সেকেন্ড পার্টে দেয়া যাবে না; কোন কোন বিষয়ে কোনো ধরনের প্রশ্ন করা যাবে না বা অনুসন্ধান করা যাবে না; কোন সংবাদ সম্মেলনে কী ধরনের প্রশ্ন করতে হবে এবং সেখানে কারা উপস্থিত থাকবেন—এ সবই মোটামুটি নির্ধারিত। 

কোনো অপরাধের সঙ্গে খুব প্রভাবশালী কারো যুক্ততার কথা শোনা গেলে বা অভিযোগ উঠলেও গণমাধ্যম সহজে তাদের নাম প্রকাশ করতে চায় না। গণমাধ্যমের ওপর করপোরেটর দুনিয়ার প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ কী ভয়াবহ মাত্রায় বেড়েছে, তার উদাহরণ অগুণতি। সুতরাং এই গণমাধ্যম  কী করে দেশের নদী, খাল ও প্রাকৃতিক জলাভূমি দখল করে আবাসন ও কল-কারখানা গড়ে তোলার সংবাদ প্রকাশ করবে—যারা গণমাধ্যমে বড় অংকের বিজ্ঞাপন দেয়? বিজ্ঞাপনের বাইরেও নানাবিধ প্রলোভন ভয়ও এক্ষেত্রে কাজ করে। 

সব মিলিয়ে সাংবাদিকতাকে সাংবাদিকরাই কঠিন করে তুলেছেন বললেও অত্যুক্তি হবে না। অর্থাৎ যারা এখন মূলধারার সাংবাদিকতায় নিয়োজিত, তাদের কত শতাংশ সত্যিই নৈতিক মানদণ্ডে উত্তীর্ণ; সৎ ও সাহসী; পার্থিব কোনো সুবিধার কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেন না; সাহসী প্রতিবেদন করতে না পারলেও অন্তত প্রশ্ন করার হিম্মত রাখেন; রিপোর্ট বা অনুসন্ধান করতে না পারলেও অন্তত নিজের সঙ্গে এবং নিজের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লড়াই করেন—এরকম সাংবাদিকের সংখ্যা যে ক্রমশই কমে আসছে, সেটি বোঝার জন্য গবেষণার প্রয়োজন নেই।