যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচন, ইউক্রেইন যুদ্ধ ও বাংলাদেশ

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনে যে দলই জয়লাভ করুক না কেন, ইউক্রেইনের যুদ্ধ ও বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির কোনও পরিবর্তন ঘটবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা দুষ্কর।

মোস্তফা সারওয়ারমোস্তফা সারওয়ার
Published : 16 Nov 2022, 01:27 PM
Updated : 16 Nov 2022, 01:27 PM

এবারে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনে অতীতের প্রবণতার পরিবর্তন ঘটেছে। গত চার দশকে লক্ষ্য করা যায় প্রথম মেয়াদকালীন মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রেসিডেন্টের দল সেনেট এবং হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ (অথবা প্রতিনিধি পরিষদ) এ সাধারণত অনেক পদ হারায়। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সেনেটের সদস্যকে বলা হয় সেনেটর এবং প্রতিনিধি পরিষদ এর সদস্যকে বলা হয় কংগ্রেসম্যান। গেল চার দশকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতিনিধি পরিষদে হারাবার কথা ছিল মোটামুটি ৩০টি কংগ্রেসম্যান পদ। কিন্তু তা হচ্ছে না। যদিও প্রতিনিধি পরিষদের নেতৃত্ব তার দল হারাবে বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু সংখ্যার ব্যবধান হবে নিতান্তই কম। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, সেনেটে ডেমোক্রেটিক পার্টির সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবারের মধ্যবর্তী নির্বাচনে রক্ষা পাচ্ছে।          

প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকান পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা ক্ষীণ হলেও, তারাই দখল করবে প্রতিনিধি পরিষদের নেতৃত্ব যেমন স্পিকার ও বিভিন্ন কংগ্রেশনাল কমিটির চেয়ারম্যানের পদগুলো। রিপাবলিকান পার্টির কোনো কোনো কংগ্রেসম্যান মধ্যবর্তী নির্বাচন শেষ হতে না হতেই ইউক্রেইন যুদ্ধে তাদের নিরঙ্কুশ সমর্থনের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। এর ফলে ইউক্রেইনের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

 যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার আওতাভুক্ত। তথাপি এই নীতি পরিচালনা ও বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন হয় ডলার। আবার ডলারের জোগান ও খরচের দায়িত্ব যৌথভাবে অর্পিত রয়েছে প্রেসিডেন্ট, সেনেট ও প্রতিনিধি পরিষদ এর উপর । সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদকে যৌথভাবে বলা হয় কংগ্রেস। প্রেসিডেন্ট ও তার ক্যাবিনেটের সাথে আলোচনা করে কংগ্রেস বাজেট প্রণয়ন করে নিজের মতো করে। প্রেসিডেন্ট সেই বাজেট অনুমোদন করতে পারে অথবা ভেটো দিয়ে তা নাকচ করতে পারে। প্রেসিডেন্টের অনুমোদন পেলেই বাজেট কার্যকর করা হয়।           

এই বাজেট পদ্ধতির আলোকে আমরা দেখবো, বর্তমানের মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফলাফলের সম্ভাব্য প্রভাব। বিশেষ করে, আমাদের প্রশ্ন হলো নব নির্বাচিত কংগ্রেস এর আগামী বছরের বাজেটে ইউক্রেইন যুদ্ধের খরচ ও অনুদান অপরিবর্তিত থাকবে কী?

ধরা যাক, মধ্যবর্তী নির্বাচনে, প্রেসিডেন্টের দল ডেমোক্রেটিক পার্টির বিজয় ঘটেছে সেনেটে এবং রিপাবলিকান পার্টির দখলে চলে যাচ্ছে প্রতিনিধি পরিষদ। অনুমান করা হচ্ছে কেভিন ম্যাকার্থী হয়তো স্পিকার হিসেবে প্রতিনিধি পরিষদের প্রধান হবেন। তিনি মধ্যবর্তী নির্বাচনের একদিন পর বলেছেন যে ইউক্রেইনের খরচ বাবদ প্রেসিডেন্টের অনুরোধ প্রতিনিধি পরিষদের রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যানরা যথাযথ বিচার বিবেচনা না করে অনুমোদন দান করবে না। ম্যাকার্থী বলেছেন, তিনি ইউক্রেইনকে সমর্থন করেন। তা সত্ত্বেও ‘ব্ল্যাংক চেক’ দেওয়া হবে না।

সেনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে প্রকাশ্য বিতর্কের এর মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার তিনি পক্ষপাতী। নবনির্বাচিত  ট্রাম্প সমর্থক দক্ষিনপন্থি রিপাবলিকানরা ইউক্রেইনে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা সমূলে বিনাশ করতে আগ্রহী। কিন্তু তাদের সংখ্যা এত বেশি নয় যে সাহায্যের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারবে। সেটার প্রমাণ রয়েছে কয়েক মাস আগে ইউক্রেইনের জন্য চল্লিশ মিলিয়ন ডলার মূল্যের একটি সহায়তা বিল। সেই বিলের পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে উগ্র দক্ষিনপন্থি রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্যদের বিরোধিতা যুক্তরাষ্ট্রের ইউক্রেইনকে সহায়তার ব্যাপারে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে সফল হবে কি না। এই বিলটির বিরোধিতা করেছিল প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫ জন কংগ্রেসম্যান এর মধ্যে মাত্র ৫৭ জন এবং সেনেটের ১০০ জনের মধ্যে ১১ জন। বিলটি সহজেই পাশ হয়েছিল দ্বিদলীয় সহযোগিতায়। অতএব, বলা যেতে পারে ইউক্রেইনের ব্যাপারে বিতর্ক হতে পারে যা গণতন্ত্রের অমিয় মূল্যবোধে উদ্ভাসিত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অক্ষুণ্ণ থাকবে। সেই কারণে যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেইনের বিজয় যে পর্যন্ত না রাশিয়াকে বাধ্য করবে যুদ্ধবিরতি এবং আলোচনার টেবিলে আনতে, সে পর্যন্ত ইউক্রেইন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হবে। কখন যুদ্ধবিরতি ঘটবে তার সঠিক সময় নির্ধারণ অনিশ্চিত।

এরই ফলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের উচ্চমূল্য হয়তো আগামী বছর পর্যন্ত গড়িয়ে যেতে পারে। যানবাহনের খরচও কমার সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশের জন্য আরও খারাপ খবর হলো প্রয়োজনীয় শস্য গমের চাহিদা পূরণের ২৫ শতাংশ সাধারণত আমদানি করা হয় ইউক্রেইন থেকে। কৃষ্ণ সাগরে যুদ্ধাবস্থায় সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হতে পারে যে কোনো সময়ে। তাই  বাংলাদেশের খাদ্যদ্রব্য, জ্বালানি, ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যস্ফীতি দীর্ঘায়িত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনে যে দলই জয়লাভ করুক না কেন, ইউক্রেইনের যুদ্ধ ও বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির কোনও পরিবর্তন ঘটবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা দুষ্কর।

বাংলাদেশ আমদানি পণ্য এবং তার উপর উৎপাদন নির্ভরশীল অন্যান্য দ্রব্য মূল্যে মুদ্রাস্ফীতির আরেকটি কারণ হলো ডলারের  উচ্চমূল্য। মধ্যবর্তী নির্বাচনের  ফলাফল এটাকে প্রভাবিত করবে বলে মনে হচ্ছে না। কেননা মুদ্রানীতির উপর নির্ভরশীল হলো ডলারের বাজার মূল্য। আর এই মুদ্রানীতি প্রেসিডেন্ট অথবা কংগ্রেস এর ক্ষমতার আওতার বাইরে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক  মুদ্রানীতি নিয়ন্ত্রণ করে। এই ব্যাংকের চেয়ার এবং ভাইস চেয়ার কে মনোনীত করেন প্রেসিডেন্ট। তারপর সিনেটের অনুমোদন সাপেক্ষে প্রেসিডেন্ট তাদের নিয়োগ দান করেন চার বছরের মেয়াদে। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক মুদ্রানীতির ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। প্রেসিডেন্ট অথবা কংগ্রেস ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের নীতি নির্ধারণে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতির হার সাত দশমিক সাত পাঁচ শতাংশ। দীর্ঘকালীন হার তিন দশমিক দুই সাত শতাংশ। বর্তমান মুদ্রাস্ফীতির হার দীর্ঘকালীন হারের দ্বিগুণেরও বেশি। মুদ্রাস্ফীতিকে বাগে আনার জন্য, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক সুদের হার বাড়াতে থাকবে। ফল স্বরূপ, ডলারের মূল্য আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

উপসংহারে বলা যেতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফলাফল, ইউক্রেইনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন এবং বাংলাদেশের আর্থিক ভাগ্য পরিবর্তনে তেমন কোনো ভূমিকা রাখবে বলে মনে হচ্ছে না।