Published : 29 Oct 2023, 09:00 AM
সংস্কৃতি’ শব্দটি বিশেষার্থক এবং ব্যাপকার্থক। নানা অভিধান শব্দটিকে উপস্থাপন করেছে নানাভাবে। ‘সংসদ বাংলা অভিধান’-এ বলা হয়েছে ‘সংস্কার, উন্নয়ন; অনুশীলনের দ্বারা লব্ধ বিদ্যাবুদ্ধি রীতিনীতি ইত্যাদির উৎকর্ষ; সভ্যতাজনিত উৎকর্ষ; সমাজনীতি, বুদ্ধি, আচার ব্যবহার ও শিল্প সাহিত্যের মধ্যে কোনো জাতির যে পরিচয় থাকে, কৃষ্টি, কালচার’। আর ‘বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান’ বলেছে ‘শিল্প-সাহিত্য আচার-আচরণ বেশভূষা প্রভৃতির দ্বারা কোনো জাতি বা গোষ্ঠীর যে পরিচয় ফুটে ওঠে, কৃষ্টি, কালচার; অনুশীলন বা চর্চা দ্বারা লব্ধ শিক্ষা শিল্প রুচি প্রভৃতিবিষয়ক উৎকর্ষ; সংস্কার’। অভিধানে নির্ণিত শব্দসমূহের অর্থের দিকে চোখ ফেরালে ‘সংস্কৃতি’ কথাটির ব্যাপকতা বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যায়।
উভয় ক্ষেত্রেই চর্চা, সংস্কার, উৎকর্ষ, উন্নয়ন বিষয়সমূহকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায়, এমন সব ইহজাগতিক কৃতকর্মের ফল বা ফল-লাভই সংস্কৃতি। অর্থাৎ নানাবিধ চর্চার ফল লাভই মানুষের সংস্কৃতি এবং এই চর্চিত বিষয়াদির বাইরে মানুষের কোনো সংস্কৃতি নেই বা থাকতে পারে না। তাহলে প্রশ্ন, এমন চর্চা-বঞ্চিত বা চর্চার বাইরের মানুষ কি সংস্কৃতির বাইরে অবস্থান করেন? কিংবা সংস্কৃতি বলতে তাঁদের কি কিছু নেই?
এই প্রশ্নের উত্তরে ‘সংস্কৃতি’ শব্দের যথার্থ অর্থ সন্ধান করা জরুরি। ‘সংস্কৃতির অর্থ কী?’ প্রশ্ন উত্থাপন করে গোপাল হালদার-এর মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। তাঁর ভাষায় “সংস্কৃতির অর্থ কী? এই প্রশ্ন করিবার সঙ্গেই একটা কথা আমাদের মনে জাগা উচিত মানুষেরই সংস্কৃতি আছে, অন্য জীবের সংস্কৃতি বলিয়া কিছু নাই। তাহার অর্থ মানুষ হিসাবে মানুষের আসল পরিচয়ই তাহার সংস্কৃতি, এই ‘কৃতির’ বা ‘কাজে’র বলেই মানুষ মানুষ হইয়াছে, প্রকৃতির নিয়ম বুঝিয়া উঠিতেছে, বাধা ছাড়াইয়া যাইতেছে।
প্রাণী মাত্রেরই জীবনের মূল প্রেরণা বাঁচিয়া থাকা। মানুষ এই তাড়নায় চাহে আপনার পরিবেশের সঙ্গে বুঝা-পড়া করিয়া টিকিয়া থাকিতে। অর্থাৎ মানুষ চায়, বাঁচিবার উপায় যতটা পারে প্রকৃতির নিকট হইতে আদায় করিয়া লইতে। ইহারই নাম জীবিকা-চেষ্টা। মানুষের সভ্যতা বা সংস্কৃতির মূল প্রেরণা তাই প্রকৃতির অন্ধ দাসত্ব হইতে মুক্ত হওয়া, অর্থাৎ জীবিকা আয়ত্ব করা, তাহা সহজসাধ্য করা। দৈহিক মানসিক প্রয়াস-প্রযত্নে এই জীবিকা সে ক্রমেই আয়ত্ত করিয়াছে- এই প্রয়াস-প্রযত্নের নাম পরিশ্রম। এবং এই পরিশ্রমের ফলে তাই মানুষ অন্য জীব অপেক্ষা উন্নত হইয়াছে, স্বাতন্ত্র্য লাভ করিয়াছে, শেষে সভ্যতার এক-একটি উপাদান সৃষ্টি করিয়াছে। সংস্কৃতির মূলের কথা তাই জীবিকা-প্রয়াস, শ্রমশক্তি; আর সংস্কৃতির মোট অর্থ বিশ্বপ্রকৃতির সহযোগে মানব-প্রকৃতির এই স্বরাজ-সাধনা।” [গোপাল হালদার; সংস্কৃতির বিশ্বরূপ ১৯৮৬, পৃষ্ঠা- ২৯]
সংস্কৃতি অনুধ্যানের মাধ্যমে সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের উপাদান হিসেবে শ্রী গোপাল হালদার প্রকৃতির নিয়ম অতিক্রমের কথা বলেছেন। এই অতিক্রম অর্থ কোনো কিছুকে পেছনে ফেলা নয়, তাকে জয় করা। যাকে বলা যায়, মানুষের জীবন সাধনের অভিযাত্রা। প্রকৃতির মধ্যেই এই জীবনসাধনের উপাদান নিহিত থাকে। জীবন-যাপন, জীবন বা আত্মরক্ষা, খাদ্য সংগ্রহ বা সংরক্ষণ- এসবের বিদ্যা তো মানুষ ক্ষুদ্রপ্রাণী পিপীলিকার কাছ থেকেই পেয়েছে। যা ‘প্রাণী মাত্রেরই জীবনের মূল প্রেরণা– বাঁচিয়া থাকা’র মর্মবাণী। আর শিল্পকর্মের সন্ধান তো পাওয়া যায় ‘ছোট্ট-পাখি’ বাবুই-এর শৈল্পিক আবাস নির্মাণের কুশলতায়। তবে মানুষের সংস্কৃতি আলাদা। এর ভিত্তি, চর্চা বা নির্মাণ অগ্রসরমান। এর আছে গতি বা অগ্রগতি, আছে পরিবর্তন বা অগ্রগামিতার প্রবাহমানতা।
‘সংস্কৃতির গোড়ার কথা’ প্রসঙ্গে গোপাল হালদার উল্লেখ করেছেন “সংস্কৃতির যে রূপান্তর হয়, সে রূপান্তর যে বারবার হইয়াছে- এই সহজ সত্যটি অনেকে একেবারেই হয়ত মানেন না; আবার অনেকে মানিয়াও তাহা সম্পূর্ণরূপে বুঝিতে চাহেন না। ইহার অনেক কারণ আছে। প্রথম কথা, সংস্কৃতি বলিতে কি বুঝায় তাহাই আমরা স্পষ্ট করিয়া জানি না। কেহ মনে করি, সংস্কৃতি বলিতে বুঝায়– কাব্য, গান, শিল্প, দর্শন, ধ্যান-ধারণা। কেহ বা মনে করি– আচার-অনুষ্ঠান, ভদ্রতা-শিষ্টাচার; সে সম্পর্কিত ভাব-ধারণা, নীতি-নিয়ম, এই সবও উহার অন্তর্গত। কেহবা উহাদের কোনো একটি জিনিষকেই সব বলিয়া ধরিয়া লইবেন। যেমন, কেহ বলিবেন ধর্মই হইল সংস্কৃতি; ধর্ম সর্বব্যাপক। কেহবা অপর কোনো জিনিসকে মনে করেন মুখ্য কথা। যেমন, ভদ্রতা, শিষ্টাচার ইহাকেই বলেন ‘কালচার’। তাই সংস্কৃতির অর্থ কি তাহার বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা কি, প্রধানত এই কথাটিই অমাদের পরিস্কার করিয়া জানা প্রয়োজন।
মূল একটি কথা স্পষ্ট- সংস্কৃতি শুধু মনের একটা বিলাস নয়, শুধু মাত্র মনের সৃষ্টি-সম্পদও নয়। উহা বাস্তব প্রয়োজনে জন্মে এবং মানুষের জীবন-সংগ্রামে শক্তি জোগায়, জীবনযাত্রার বাস্তব উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে। সেই জীবনযাত্রারই ঘাতপ্রতিঘাতে সংস্কৃতির রূপ ও রঙও পরিবর্তিত হয়। আবার, সংস্কৃতির সহায়েও জীবনযাত্রা যেমন অগ্রসর হয় সংস্কৃতিও তেমনি জীবনযাত্রার সঙ্গে তাল রাখিয়া তাহার সঙ্গে সঙ্গে নূতন হইয়া উঠে।” [প্রাগুক্ত]
এই ‘গোড়ার কথা’ই সংস্কৃতির আসল কথা। জীবন ধারণ আর জীবন-যাপনের প্রয়োজনেই সংস্কৃতির চর্চা, সংস্কৃতির বিকাশ, সংস্কৃতির ব্যাপ্তি। যা শক্তি যোগাবে সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনের, জীবন-ধারণের, জীবন-প্রবাহের গতি তথা শক্তি যোগাতে।
মানুষ সামাজিক জীব। তার সামাজিক জীবনের উৎপাদন পদ্ধতি, উৎপাদন সম্পর্ক তথা অর্থনৈতিক কাঠামোই মূল– যা নির্মাণ করে সামাজিক পরিবেশ, আর তার ওপর ভিত্তি করেই সৃষ্টি হয় শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাষ্ট্র-আইন ইত্যাদি। সাহিত্য-সংস্কৃতি তাই মূল নয়, অবকাঠামো, অর্থনীতি যার ভিত্তি। কার্ল মার্কসই এ ধারার প্রবক্তা। তিনি স্পষ্টই বলেছেন, “জীবনধারণের বস্তুগত উপকরণের উৎপাদনের পদ্ধতিই সাধারণভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন-প্রক্রিয়াকে নির্ধারণ করে, মানুষের চেতনার দ্বারা তার সত্তা নির্ধারিত হয় না বরং বিপরীতভাবে তার সামাজিক সত্তাই তার চেতনাকে নির্ধারণ করে।” [অর্থশাস্ত্রের সমালোচনা প্রসঙ্গে; কার্ল মার্কস, ভূমিকা]
সাহিত্য-সংস্কৃতি মানুষের চেতনার বুদ্ধিবৃত্তিমূলক বহিঃপ্রকাশ। অর্থনীতি যেখানে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি আর চেতনাকে নির্ধারণ করে, সেখানে অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলের বাইরে কোনো সংস্কৃতি-সৃষ্টি সম্ভব না। অর্থনৈতিক জীবনধারা যদি হয় কাঠামো তাহলে তার প্রতিফলিত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল হবে উপরিকাঠামো। উপরিকাঠামো যেমন মূল কাঠামোকে অতিক্রম করে আপন ইচ্ছায় বিকশিত হতে পারে না, তেমনই মূল কাঠামোও উপরিকাঠামোকে উপেক্ষা করে নির্লিপ্ত থাকতে পারে না। আসলে মূল কাঠামো ও অবকাঠামো একে অপরের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। কোনো সমাজের মানুষের জীবনধারণের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেই সমাজের সংস্কৃতির ধারার পরিবর্তনও অনিবার্য। এই সামাজিক রূপান্তর সমাজে সংস্কৃতির রূপান্তর আনবেই।
সংস্কৃতির এই ব্যাপ্তি-বিকাশ তথা রূপান্তরের জন্য চাই যুথবদ্ধ প্রয়াস, চাই দৃঢ়ভিত্তিভূমে প্রতিষ্ঠিত প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়াস এবং এর অবিরাম পথচলা। এই পথ চলা সহজ নয়– কঠিন, তবুও পথ চলতে হয়। চলতে হয় মানবমুক্তি তথা মানবতার কল্যাণ ব্রতে। উচ্চারণ করতে হয় ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহা উপরে নাই’।
স্বাধীন বাংলাদেশে এমন সংগঠন ‘বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী’। উদীচী অতিক্রম করছে পথচলার ৫৫ বছর। উদীচীর ভিত্তিভূমি এর ঘোষণাপত্র এবং এর শক্তি অযুত শিল্পীকর্মী। পাথেয়, উদীচীর ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত অমোঘ উচ্চারণ মানবিক বোধসমূহ জাগ্রত ও বিকশিত করে তোলা শিল্পী, শিল্পীগোষ্ঠী বা শিল্পী-সম্প্রদায়ের মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে আমাদের ওপর বর্তায়। এই দায়িত্ব পালনে অবিচল ও সদা তৎপর থাকতে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ। মুক্তির পথ রচনার এই নিরন্তর ও একনিষ্ঠ কর্মতৎপরতার মাধ্যমে উদীচী সেই সমাজ গঠনের নিশ্চিত পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে; যে সমাজে সুষ্ঠু মানবতাবাদী সুকুমার বৃত্তিগুলোর হবে পরিপূর্ণ বিকাশ; আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধররা সেখানে বেড়ে উঠবে এক পরিপূর্ণ মানবিক গুণাবলি ও অধিকারসম্পন্ন মানুষ হিসেবে। সেখানে আমরা দেখব আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির সৃষ্টিশীল নবজাগরণ।
এই নবজাগরণ সৃষ্টির যুথবদ্ধ দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষিত হোক উদীচীর সকল শিল্পীকর্মী ও সহযোদ্ধার কণ্ঠে। এই হোক উদীচীর পঞ্চপঞ্চাশত্তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অঙ্গীকার। জয় উদীচী।