স্বয়ংসম্পূর্ণতায় আছি, স্বয়ংসম্পূর্ণতায় নেই

স্বনির্ভর কৃষক দুনিয়া থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছেন—যিনি একসময় তার প্রয়োজনীয় সবকিছু নিজে উৎপাদন করতেন। দেশগুলোও তেমনি। তারা এখন আমদানি-রপ্তানি করে পরস্পরের প্রয়োজন মেটায়।

হাসান মামুনহাসান মামুন
Published : 11 July 2023, 01:27 PM
Updated : 11 July 2023, 01:27 PM

গেল ঈদের সময়টায় আমরা কাঁচা মরিচের রেকর্ড দাম নিয়ে যারপরনাই বিরক্ত ছিলাম। এর দাম এখনও স্বাভাবিক হয়নি, যদিও ভারত থেকে আমদানির ব্যবস্থা হয়েছিল। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, ভারতেও কাঁচা মরিচের দাম বেশি বলে সস্তায় আমদানির যেসব খবর প্রচার হয়েছিল—বাস্তবতা তেমন নয়। কাঁচা মরিচে উল্লেখযোগ্য কর-শুল্ক আরোপিত এবং পরিবহন আর শ্রমিক ব্যয়ও কম নয়। এসব কারণে দাম খুব কমার সুযোগ নেই। তবে আমদানি দ্রুততর করা গেলে সরবরাহের চাপে দাম কমে আসাও সম্ভব। অনেকে অবশ্য তখন থেকে বলছেন, কাঁচা মরিচ না খেয়ে শুকনা মরিচ খেলে কিংবা কিছুদিন কষ্ট করলেই তো হয়ে যায়! শুকনা মরিচের দামও কিন্তু চড়া।

কোরবানি ঈদের আগ দিয়ে প্রায় সব মসলার বড় দাম বৃদ্ধি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছিল। তখন একথাও হয় যে, আমরা কোন মসলা উৎপাদনে কী অবস্থায় আছি। কোনটি কতখানি আমদানি করতে হয়। দেখা গেল, পেঁয়াজ উৎপাদনেও আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। এটা তাই বিপুল পরিমাণে আমদানি করতে হয়। এতে গোলমাল হলেই অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি মোকাবিলা করতে হয় ভোক্তাকে। এবার কাঁচা মরিচের অস্বাভাবিক দাম দেখে যারা এর খবর তেমন রাখতেন না, তারাও জানলেন—এ কৃষিপণ্যটিও আমরা যথেষ্ট উৎপাদন করতে পারি না। তাই এটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আমদানি করতে হয়। বর্ষার কয়েকটা মাস আমরা পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আনা কাঁচা মরিচের ওপর নির্ভরশীল থাকি।

প্রয়োজনীয় সব পণ্য নিজেরা উৎপাদন করব, এটা অবশ্য কোনো কাজের কথা নয়। এটা সম্ভবও নয়। স্বনির্ভর কৃষকও দুনিয়া থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছেন—যিনি একসময় তার প্রয়োজনীয় সবকিছু নিজে উৎপাদন করতেন। দেশগুলোও তেমনি। তারা এখন আমদানি-রপ্তানি করে পরস্পরের প্রয়োজন মেটায়। এটা এমন এক বাস্তবতা যে, যুদ্ধের মধ্যেও বাণিজ্য চলে। ইউক্রেনে যুদ্ধ হচ্ছে; আবার সেখান থেকে পণ্যসামগ্রী রপ্তানি অব্যাহত আছে, বিশেষত কৃষিপণ্য। ইউক্রেনকে তো বলা হতো পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ শস্যভাণ্ডার। বেশকিছু কৃষিপণ্য উৎপাদনে দেশটি অগ্রণী। সেখানে রাশিয়ার আগ্রাসন ঘিরে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তাতে দুনিয়াজুড়েই খাদ্যপণ্যের সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়ে। জ্বালানির সাপ্লাই চেইনও। সঙ্গে যোগ হয় রাশিয়ার ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা। সেটা আবার অত কার্যকর হয়নি। দেখা গেল, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ ভারত রাশিয়া থেকে ডিজেল কিনছে দাম কম পেয়ে। রাশিয়ার জ্বালানিপণ্য কিনছে চীনও। তাতে রাশিয়ার অর্থনীতিকে দুর্বল করার পশ্চিমা পরিকল্পনা অনেকখানি ভেস্তে গেছে। ভারত, চীনও হয়েছে উপকৃত। আবার দেখা গেল, রাশিয়া থেকে কেনা তেল পরিশোধন করে ভারত রপ্তানি করছে ইউরোপে। তা বিবেচিত হচ্ছে 'ভারত থেকে আমদানি' বলে। এ নিয়ে আপত্তি ওঠায় এমন ব্যাখ্যাই দেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গটা তোলা হলো বলতে যে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অনেক সময় রাজনীতি নয়—বরং তার 'নিজস্ব লজিক' মেনে চলে।

মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খারাপ হয়ে পড়েছে প্রধানত রোহিঙ্গা ইস্যুতে। কিন্তু দেশটির সঙ্গে কি বাণিজ্য চলছে না? কাঠ, মসলা, হিমায়িত মাছের মতো কিছু পণ্য আমরা মিয়ানমার থেকে এনে থাকি। 'বার্মিজ রুই' এদেশে জনপ্রিয়। তবে মায়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্য উল্লেখযোগ্য নয় আর এটা দ্রুত বাড়ছেও না। তারচেয়ে বড় কথা, মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্যেও আমরা আছি বড় ঘাটতিতে। ওখানে রপ্তানি সম্ভাবনা কম, তা অবশ্য নয়। যেমন, তৈরি পোশাক ও গৃহনির্মাণ সামগ্রী আমরা রপ্তানি করতে পারি সীমান্তবর্তী রাখাইনসহ অন্যান্য রাজ্যে। ওইসব অঞ্চলে বাংলাদেশ থেকে দরকারি পণ্যসামগ্রী আমদানি বরং লাভজনক—তাদের রাজধানী শহর থেকে আনার তুলনায়। কিন্তু রাখাইনসহ এ অঞ্চল ঘিরেই তো দানা বেঁধে উঠেছে রোহিঙ্গা সমস্যা। দেশটির একাংশে বিদ্রোহী তৎপরতাও জোরদার। এ অবস্থায় মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্কোন্নয়ন কঠিন। এর মধ্যে যেটুকু বাণিজ্য হয় আর তাতে যতখানি উপকৃত হতে পারি, সেটা নিয়েই তুষ্ট থাকতে হবে। একটা সময় পর্যন্ত তো দু'দেশে আনুষ্ঠানিক বাণিজ্য হতো না। চোরাচালানই হতো মূলত। এখনও কিছুটা হয়ে থাকে। যেমন, মিয়ানমার থেকে কিছু গরু সীমান্তপথে আসার খবর মাঝে মাঝে মিডিয়ায় প্রকাশ পায়। গেল ঈদের সময়ও এমন কিছু খবর মিলেছিল।

একটা সময় পর্যন্ত ভারত থেকে প্রচুর গরু আসতো। তারাও পাঠাতো, আমরাও নিতাম। এটাও কোনো আনুষ্ঠানিক বাণিজ্য ছিল না। চোরাপথে আসা গরুকে একটা বিচিত্র প্রক্রিয়ায় বৈধ করে নিতাম। এর দাম নিশ্চয়ই হুন্ডি বা কোনো অগ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ায় পরিশোধ করা হতো। তবে এতে করে গোমাংসের বাজারকে আমরা দীর্ঘদিন সহনীয় রাখতে পেরেছিলাম। পরে বিজেপি সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে নিরুৎসাহিত হতে হতে প্রক্রিয়াটা এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়। আমরাও তখন সিদ্ধান্ত নিই, প্রয়োজনীয় গরু-ছাগল নিজেরাই উৎপাদন করে নেব। এই যে বলা হচ্ছে—কোরবানি ঈদের সময়ও গরু-ছাগলে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ, তার নেপথ্যে আছে সীমান্তপথে গরু আসা বন্ধের ওই ঘটনা। এটা 'শাপে বর' হয়েছে। তবে এখানে কথা আছে। সেগুলো না বললেই নয়।

গরু-ছাগলে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি হয়তো; তবে এ সময়কালে আবার গোমাংসের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। কেজিপ্রতি ৮০০ টাকার নিচে কোনো মানসম্মত গোমাংস শহরাঞ্চলে মিলছে না। উৎসবের সময় এটা আরও বেড়ে যেতে দেখা যায়। গেল কোরবানির হাটে গরু-ছাগলের দামও এর আগেরবারের চেয়ে ১৫-২০ শতাংশ বেশি হাঁকা হচ্ছে বলে খবর বেরোয়। ঈদের আগের দিন অবশ্য দাম নেমে যায়, বিশেষত বড় গরুর। কোরবানির হাটে এসব ঘটেই থাকে। অনেক বিক্রেতাকে লোকসানও গুনতে হয়। কারণ এ বাজার মূলত 'স্পেকুলেটিভ' বা অনুমাননির্ভর। কথা হলো, গরুর দাম খামার পর্যায়েই বেড়েছে। কারণ ইতোমধ্যে বেড়ে উঠেছে এর পরিপালন ব্যয়। গোখাদ্যের দাম বেড়েছে অনেক এবং এর ওপর নির্ভরশীলতাও বেড়েছে—যেহেতু তৃণভূমি কম। এদিক দিয়ে ভারতের তুলনামূলক সুবিধা অনেক বেশি। সম্ভবত আরেক প্রতিবেশী মিয়ানমারেরও বেশি।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে 'তুলনামূলক সুবিধা তত্ত্ব' বলে একটা তত্ত্ব রয়েছে এবং এটি বেশ কার্যকর। বলা হয়, যাদের তুলনামূলক সুবিধা বেশি, তারা সেই পণ্য উৎপাদন করে অন্যের সঙ্গে বিনিময় করবে। সে অনুযায়ী কি তাহলে গরু-ছাগল কম উৎপাদন করে আমরা ভারত থেকে এনে নেব? হিন্দুপ্রধান ভারত থেকে গরু আমদানি চাইলেও করতে পারব না। এক্ষেত্রে তাদের আইনগত বাধা রয়েছে। তবে ভারত গোমাংস (প্রধানত মহিষের মাংস) রপ্তানি করে এবং এক্ষেত্রে তার অবস্থান উপরের দিকেই। গোমাংসের অত্যধিক দাম নিয়ে মাঝে আলোচনা হওয়ার সময় খোঁজ করে দেখা গিয়েছিল, ওখান থেকে আমদানিটা লাভজনক হবে। শর্তসাপেক্ষে কিছু গোমাংস যে আমদানি হয় না, তা তো নয়। তবে সরকার এখনও এর খোলামেলা আমদানির বিপক্ষে। এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়াও কঠিন—যেহেতু গরু পালনকারীদের স্বার্থ এখানে নিবিড়ভাবে জড়িত। এ খাতে কর্মসংস্থান শুধু নয়, আত্মকর্মসংস্থানও কম হয়নি। কিছু বিজনেস হাউসও এ খাতে ঢুকে পড়ে ব্যবসাটা গুছিয়ে করতে চাইছে। বর্ধিত গোমাংস আমদানির সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় তাদেরও মত নিতে হবে। শুধু ভোক্তাস্বার্থ দেখলে তো চলবে না।

আমাদের আমদানি সক্ষমতাও অনেক কম এখন। এটা প্রধানত ঘটেছে ডলার সংকটে। এজন্য গত অর্থবছরে ডলারের দাম বেড়েছে ২৬ শতাংশেরও বেশি। তাতে আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে উঠেছে। দ্রুত বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। সবচেয়ে বড় কথা, ডলার সংকটে জরুরি পণ্য, যেমন জ্বালানি তেল, গ্যাস আমদানিও ব্যাহত—যার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে বিদ্যুৎসহ উৎপাদন খাতের। মেশিনারিজ আর শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও নিরুৎসাহিত হয়েছে। এলসি খোলা ও নিষ্পত্তিতে সংকটে আছে ব্যাংক খাত। এ অবস্থায় গোমাংস আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া আরও কঠিন। কাঁচা মরিচও আমদানি হচ্ছে ডলারে। তবে অতিসম্প্রতি রুপিতে ভারত থেকে পণ্যসামগ্রী আমদানির বিকল্প কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ভারতে রপ্তানি কম বলে আমাদের হাতে রুপি আসবে অবশ্য কম। এটুকু দিয়ে যতখানি আমদানি করা যায়, এটাই হলো এমন উদ্যোগের সারকথা। এ অবস্থায় চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে, রুপিতে গোমাংস আমদানি বাড়িয়ে এর বাজারকে কিছুটা শান্ত করা যায় কিনা।

গোমাংস না খেলে বা কম খেলে অবশ্য কেউ মারা যাবে না। প্রাণিজ প্রোটিনের আরও উৎস তো রয়েছে। আমরা ব্রয়লার মুরগি উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছি, এমনটাও বলা হয়ে থাকে। সোনালী বা এ ধরনের মুরগির উৎপাদনও উল্লেখযোগ্য। এ অবস্থায় মাঝে ব্রয়লারের বাজারেও অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল। এর ওপর নির্ভরশীল নিম্নআয়ের মানুষ তখন বেজায় দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল যে, তাহলে খাব কী? কিছুদিন পর এর বাজার অবশ্য শান্ত হয়ে আসে। তখন এমন কথাও ছড়ায়—মুরগির বাচ্চা ও ফিড উৎপাদনকারী কিছু বড় প্রতিষ্ঠান মিলে বাজার অস্থিতিশীল করে ফায়দা লুটেছে। এটাতে বলে 'উইন্ডফল গেইন' বা অভাবিত প্রাপ্তি। এটা কম ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক পথে এসে থাকে। যাহোক, সরকারের উচিত ছিল এ বিষয়ে ওঠা অভিযোগ ধরে একটা নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করা। কার্যত ওই ঘটনা অনেকেই ভুলে বসে আছি।

এসব প্রসঙ্গ অবতারণার উদ্দেশ্য হলো এটা বলা যে, স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনই একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে না। আর সব ক্ষেত্রে সেটা সম্ভবও নয়। লক্ষ্য বরং হওয়া উচিত বাজারে স্বাভাবিকতা প্রতিষ্ঠা। আমদানি করে আনি বা দেশে উৎপাদন করি—সে পণ্যের দাম যেন স্বাভাবিক থাকে। অনেক সময় দেখা যায়, দাম বৃদ্ধির সুফল উৎপাদক তো নয়ই; আমদানিকারকও পাচ্ছে না। উৎপাদন ও বিনিয়োগের সঙ্গে সম্পর্কহীন একটা গোষ্ঠী অনেক সময় মূল ফায়দা লোটে। এর চাপ গিয়ে পড়ে ভোক্তার ওপর। আর ভোক্তাদের সিংহভাগ তো নিম্নআয়ের মানুষ। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে তারা আছে কঠিন সংকটে। এদিকে সরকার নতুন অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনার প্রত্যয় ঘোষণা করে বসে আছে।