কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, জ্বালানি নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যতের ভূ-বিজ্ঞান

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কম কার্বন নিঃসরণ করে এমন জ্বালানি নিয়ে নতুন করে ভাবছে পুরো দুনিয়া। সেই ভাবনায় ভবিষ্যতে ভূ-বিজ্ঞান কিভাবে যুক্ত হবে তা নিয়ে নিজের মত তুলে ধরেছেন পেট্রোনাস ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির সহকারী অধ্যাপক এবং জ্যেষ্ঠ জিওমডেলার এ কে এম এহসানুল হক।

এ কে এম এহসানুল হকএ কে এম এহসানুল হক
Published : 26 July 2022, 05:13 PM
Updated : 26 July 2022, 05:13 PM

দুই বছর ধরে গণমাধ্যমগুলো কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। সেটি শেষ হতে না হতেই আলোচনায় চলে আসে রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ। কিন্তু এসবকিছু ছাপিয়ে বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে জরুরী বিষয় বা সমস্যাটি হচ্ছে সার্বজনীন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব।

এই ইস্যুটি মূলত জোরের সঙ্গে নব্বইয়ের দশকের শেষ থেকে আলোচিত হয়ে আসছে। একজন ভূ-বিজ্ঞানী হিসেবে এবং জ্বালানি খাতে কর্মরত হিসেবে আমি সবসময়ই আমার বা আমাদের ভূমিকা নিয়ে ভেবেছি; কেবল সম্ভাব্য সমাধানের দৃষ্টিকোণ থেকেই আমি মূলত আমার ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়েছি।

চারটি মূল প্রশ্ন এই মুহূর্তে আমার (বা ভূ-বিজ্ঞানীদের?) মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে যেগুলো বিস্তারিত বিশ্লেষণের দাবি রাখে-

১. পরিবর্তিত পৃথিবীতে তেল-গ্যাস বা জীবাশ্ম জ্বালানি খাতের আদৌ কোন ভবিষ্যৎ আছে কিনা?

২. চলমান জ্বালানি পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় (energy transition) এর কোনও অবস্থানই বা আছে কিনা?

৩. একজন পেট্রোলিয়াম ভূ-বিজ্ঞানী হিসেবে আমাদের আদৌ কোনও ভূমিকা আছে কি?

এবং

৪. ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে কিভাবে একজন ভূবিজ্ঞানী কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেন?

প্রশ্নগুলো যেমন জরুরি, এবং এগুলোর পক্ষপাতহীন উত্তর জানাটাও ততটাই জরুরি। তবে পুরো ব্যাপারটি খোলাসা করবার আগে এটুকু পরিষ্কার করি যে, এই নিবন্ধে আমি জলবায়ু পরিবর্তনের বিজ্ঞান (science of climate change), সরকারী নীতি, রাজনীতি বা এ সম্পর্কিত সামাজিক বিষয় নিয়ে আলোচনা এড়িয়ে যাবো, কেননা এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোকপাত করার জন্য আমার থেকে অনেক যোগ্য, জ্ঞানী-গুণীজন রয়েছেন।

আমি বরং এনার্জি ট্রানজিশনের ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে (energy transition world) ভূতাত্ত্বিকদের কার্যকর অবদান বা কর্মপন্থা এবং এর সার্বজনীন গুরুত্ব নিয়ে একটু আলোচনা করতে বেশি আগ্রহী।

অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি চাহিদা এবং তার উৎসগুলোর জন্য ইন্টারনেটে ঘাটাঘাটি করলেই প্রচুর তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়। গত প্রায় ১০-১৫ বছরের প্রকাশিত গবেষণা ও প্রতিবেদনগুলোয় চোখ বুলিয়ে দেখলেও, অন্তত এ বিষয়ে একটি ধারণা পাওয়া যাবে।

এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি জায়ান্ট শেভরন এর এনার্জি আউটলুক ২০১৮ রিপোর্ট থেকে তিনটি গ্রাফ আগে নিচে তুলে ধরছি।

উপরের বাম দিকের গ্রাফ অনুযায়ী, ২০৪০ সালে গিয়েও বিশ্বব্যাপি জ্বালানি চাহিদার প্রায় ৫৩ শতাংশ জোগান দিবে প্রাকৃতিক গ্যাস এবং জীবাশ্ম জ্বালানি। শুধু শেভরন নয়, দুনিয়ার আরো অনেক প্রথিতযশা এনার্জি এক্সপ্লোরেশন-প্রোডাকশন কোম্পানি, জ্বালানি নীতিনির্ধারকরাও প্রায় একই কথা বলছেন; এবং সবগুলো ভবিষ্যদ্বাণীর সারমর্ম হচ্ছে– জীবাশ্ম জ্বালানি ও প্রাকৃতিক গ্যাস ২০৪০ সাল এবং তার পরেও বৈশ্বিক জ্বালানি মিশ্রণে গুরুত্বপূর্ণ অনুপাত বজায় রাখবে যা প্রায় ৪০-৬০ শতাংশ; আর বাকি অংশে থাকবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, কয়লা, জলবিদ্যুৎ, সোলার এবং নিউক্লিয়ার জ্বালানি। এটা গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি ইঙ্গিত বহন করে আর তা হলো, অ-নবায়নযোগ্য জ্বালানি আরো বেশ অনেকটা সময় ধরেই আমাদের জ্বালানি মিশ্রণে উপস্থিত থাকবে, বিশেষত প্রাকৃতিক গ্যাস- যেটাকে অনেক বিশেষজ্ঞ ‘ট্রানজিশন ফুয়েল’ হিসেবেও দেখছেন, মূলত তিনটি কারণে:

১. কয়লা বা তেলের তুলনায় এটি প্রচুর পরিমাণে সরবরাহযোগ্য,

২. উৎপাদনের জন্য তুলনামূলকভাবে সস্তা এবং

৩. কম কার্বন নিঃসরণকারী (low-carbon emitter)

একইসাথে এটাও ব্যাপকভাবে স্বীকৃত যে এনার্জি উৎপাদনের জন্য গ্যাসের ব্যবহার, জীবাশ্ম জ্বালানি হ্রাস এবং আরও টেকসই নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস বৃদ্ধির মধ্যে ব্যবধান পূরণের চাবিকাঠি। তাছাড়া এটি বিবেচনা করাও গুরুত্বপূর্ণ যে তেল এবং গ্যাস শিল্প একটি নিম্ন কার্বন নবায়নযোগ্য এনার্জি ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সমাধানের একটি বড় অংশ, একটি সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করে আরেকটির এগিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব; জ্বালানি তেল এবং গ্যাসকে নিয়ামক হিসেবে মূল্যায়ন না করলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ভবিষ্যতের পথে অগ্রযাত্রা অসম্ভব এবং এটি ফ্যাকচুয়ালি প্রমাণিত (Victoria R Nalule, Xiaoyi MU, 2020)।

এবার ঠিক এর পরের বিষয়ে আসি, যেটা হলো- একজন পেট্রোলিয়াম ভূবিজ্ঞানী হিসেবে করণীয়। এ পেশার ভবিষ্যৎ এবং বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের ব্যাপারে আমাদের ইতিবাচক ভূমিকা পালনের ক্ষেত্র। বিষয়টি ব্যাখ্যা করার আগে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, যে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, বরিশাল, শাহজালাল বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূতত্ত্ব খনিবিদ্যা বা পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ারিং রয়েছে এবং প্রতি বছরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্রছাত্রী স্নাতক থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এ বিশেষায়িত অংশকে দেশের ভবিষ্যৎ জ্বালানি অনুসন্ধান, উত্তোলন এবং সর্বোপরি রক্ষণাবেক্ষণে কাজে লাগানোর নিরিখেই দেশের সঠিক জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভবপর হবে। ঠিক এ কথা মাথায় রেখেই এখনই আমাদের এই বিশেষায়িত দক্ষ অংশটিকে ৩৬০ ডিগ্রি প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে।

এ বাস্তবতার নিরিখে মনে রাখতে হবে, বিশ্বব্যাপী জ্বালানি চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় হাইড্রোকার্বন অন্বেষণ এবং উৎপাদনে (exploration and production) ভূবিজ্ঞানীর দক্ষতা-অভিজ্ঞতা বিশ্বের জন্য এখনও সময়োপযোগী এবং প্রয়োজনীয়। একইসাথে আমাদের এও বুঝতে হবে যে ভবিষ্যতে এই খাতের কর্মসংস্থানগুলো বড় কোম্পানি থেকে প্রধানত জাতীয় তেল-গ্যাস কোম্পানি, অরগাইজেশন ফর ইকোনোমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) এর সদ্য ৩৮টি দেশের বাইরে থাকা দেশগুলোর দিকে ঝুঁকে যাবে এবং ছোট বা মাঝারি তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলো সম্ভবত নিজেদেরকে এনার্জি কোম্পানিতে রূপান্তর করে ফেলবে।

যে কোম্পানিগুলো এখনও তেল এবং গ্যাস অনুসন্ধান-উত্তোলন করছে তারা। আমার মতে, পরিবেশগত, সামাজিক এবং শাসন নীতির (environmental, social and governance policies) সাথে সামঞ্জস্য রেখে আরও নিয়ন্ত্রিতভাবে প্রকল্প নির্বাচনে মনোযোগ দেবে এবং প্রকল্প নির্বাচনে অর্থায়নের বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। তারা তেল ও গ্যাস উন্নয়ন প্রকল্পের সংখ্যা কমিয়ে কেবল পরিবেশগত এবং জলবায়ুগত প্রভাব কমানোর সম্ভাবনা রয়েছে এমন প্রকল্পগুলোতেই জোর দেবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত হবে অতিসত্বর তাদের অনুসন্ধান এবং উত্তোলন বিভাগকে আরো মজবুত ও যুগোপযোগী করা, প্রতিষ্ঠানগুলোতে নতুন কিছু বিভাগ চালু করা, যেমন– নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিভাগ, জ্বালানি গবেষণা বিভাগ, ডেটা মাইনিং এবং আরটিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) বিভাগ ইত্যাদি।

সারা পৃথিবী জুড়েই 'ডিজিটালাইজেশন' এমন আরেকটি বিষয় যা ২০১৪-১৫ সালে তেলের দাম পড়ে যাওয়ার পর থেকে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল, যার মূলে ছিল তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী কোম্পানিগুলোর দক্ষতা বৃদ্ধি এবং একই সাথে খরচে সাশ্রয় আনা। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বড় জ্বালানি কোম্পানি দ্বারা পরিচালিত অনেক গবেষণা প্রকল্প, জ্বালানি উত্তোলনের দৈনন্দিন কাজ বাস্তবায়নের অনেক অপারেশনাল প্রযুক্তিকে বর্তমানে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, পরবর্তী দশকে তথ্য প্রক্রিয়াকরণ, বিশ্লেষণ, অপারেশন এবং উৎপাদন সিস্টেমের নিরীক্ষণে ব্যাপক প্রযুক্তিগত পরিবর্তন দৃশ্যমান হবে। কম্পিউটিং শক্তি এবং সক্ষমতার ব্যাপক বৃদ্ধিসহ ক্লাউড কম্পিউটিং এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের অগ্রগতি জ্বালানি ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনে দেবে।

ঠিক এ জায়গাটিতেই ভূবিজ্ঞানীদের ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে মাটির গভীরে থাকা প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক উত্তোলন এবং পরিবহনে ডেটা ও আটিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কার্যকর প্রভাব বিস্তার করতে পারে, যা ভূ-বিজ্ঞানীদের তাদের আরও দ্রুত পরিমাণে ডেটা বিশ্লেষণ করার সক্ষমতা দেবে। এটি তাদেরকে গভীর চিন্তাভাবনা এবং টেকনিক্যাল দক্ষতা প্রয়োগ করে সাবসার্ফেসের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আরো সম্পৃক্ত করতে পারে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। এটির একটি উদাহরণ হতে পারে অটোমেটেড সিসমিক স্ক্রিনিং ইন্টারপ্রেটেশন।

ভূবিজ্ঞানীর কাছে থেকে পাওয়া মূল ইনপুট এবং কোয়ালিটি কন্ট্রোলের ইনপুট ছাড়া বাকি প্রসেসগুলো ভবিষ্যতে হয়ে পড়বে স্বয়ংক্রিয় যেমন- আটিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, বিগ ডেটা নির্ভর। পুরো ব্যাপারটিতে উল্লেখযোগ্য স্বয়ংক্রিয়তা সত্ত্বেও ভূ-বিজ্ঞানীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই বিবেচ্য হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তখনও ভূ-বিজ্ঞানীদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানের প্রয়োজন হবে। যেহেতু ভবিষ্যতে বড় জ্বালানি কোম্পানিগুলো আধুনিক প্রযুক্তি এবং বিশ্লেষণ পদ্ধতির জন্য আরো বিনিয়োগ করবে, ভূবিজ্ঞানীদের জন্য শিল্প এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ডিজিটালাইজেশনের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য দক্ষতা তৈরি করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

ভবিষ্যতে জ্বালানি চাহিদা পূরণে ক্রমাগত তেল-গ্যাস অনুসন্ধান এবং উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি, পরবর্তী দশকে এবং তার অব্যবহিত পরেও ভূ-বিজ্ঞানীদের চাহিদা আরও কয়েকটি ক্ষেত্রে বাড়তে পারে যেসব খাতে সেগুলো নিয়ে এখনই বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা করে ফেলা দরকার। এসবের মধ্যে রয়েছে-

১. কার্বন ক্যাপচার এবং স্টোরেজ (সিসিএস)

সিসিএস-কে তেল-গ্যাস শিল্পে প্রায় সকল দেশেই কার্বন নির্গমন হ্রাসের সম্ভাব্য একটি সমাধান হিসেবে দেখা হচ্ছে । ডিপ্লিটেড হাইড্রোকার্বন আধারে (depleted hydrocarbon reservoir) কার্বনডাই অক্সাইড (CO₂) ইনজেকশনের ধারণাটি প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আলোচিত হলেও, আগে কখনোই বড় পদক্ষেপ হিসেবে এগিয়ে আসেনি, যতটা এখন বেশ জোরের সাথে শোনা যাচ্ছে।

বেশ কিছু সরকার এবং বড় তেল কোম্পানি বর্তমানে এটি নিয়ে গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা করছে এবং গত ২-৩ বছরে ধীরে হলেও উল্লেখযোগ্য কিছু অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়েছে, যদিও বাস্তবে আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে। অনেকেই এই মত দিয়েছেন যে, আমরা যদি পরবর্তী দুই থেকে তিন দশকের মধ্যে অনুমিত মাত্রায় জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করতে থাকি এবং তখনও প্যারিস জলবায়ু পরিবর্তন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চাই, তবে সিসিএস অপরিহার্য হবে এবং বৈশ্বিক উৎপাদিত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ৫৫ শতাংশেরও বেশি ক্যাপচার করতে হবে।

এই সিসিএস শিল্পে ভূবিজ্ঞানীদের ভূমিকা একারণেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে। এছাড়া একবার কার্বন ডাই অক্সাইড ইনজেকশন এবং স্টোরেজ শুরু হলে মাটির গভীরের স্তরগুলোর বিস্তারিত মডেলিং এবং পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণের কাজটা মূলত ভূবিজ্ঞানীদেরই সমাধান করতে হবে।

২. জিওথার্মাল এনার্জি

একটি ক্লিন এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি শক্তির উৎস হিসেবে, জিওথার্মাল এনার্জির ভবিষ্যতে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে, বিশেষ করে সেই অঞ্চলগুলোতে যেখানে মাটির গভীরের ভূতত্ত্ব সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমন- বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম জিওথার্মালি অ্যাক্টিভ অঞ্চল। এছাড়া আইসল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি অঞ্চলে জিওথার্মাল জ্বালানি শক্তির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। একটি ভূতাপীয় ভূতত্ত্ববিদের (geothermal geologist) যদিও পেট্রোলিয়াম ভূতত্ত্বের চেয়ে খনিজ অনুসন্ধানের সাথে কাজের দিক থেকে বেশি মিল পাওয়া যায়, তবুও ভূতত্ত্ব এবং ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ম্যাপিং, নমুনা বিশ্লেষণ, কোর এবং রক কাটিং পরীক্ষা করা, ভূ-পৃষ্ঠের মডেল তৈরি এবং সাইটিং-সহ একটি পেট্রোলিয়াম ভূবিজ্ঞানীর কাজের সাথে অনেক সাদৃশ্যও রয়েছে।

৩. খনিজ অনুসন্ধান (mineral exploration)

খনিজ অনুসন্ধান বরাবরই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে অনেক ভূতাত্ত্বিকদের জন্য একটি জনপ্রিয় ক্যারিয়ার এবং যারা এর সাথে জড়িত তাদের জন্য একটি সম্মানজনক পেশা। আমরা জীবাশ্ম জ্বালানি এবং পেট্রোলিয়াম ভূতত্ত্বের ভূমিকা থেকে ভবিষ্যতে যখন দূরে সরে যাবো, সেসময় খনিজ অনুসন্ধানে ভূবিজ্ঞানীদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হবে, যেমন নবায়নযোগ্য জ্বালানি-বান্ধব গাড়ি বা শিল্প-কারখানায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত ব্যাটারির কাঁচামালের অধিকাংশই আসে দুষ্প্রাপ্য খনিজ থেকে- যেমন লিথিয়াম, বেরিলিয়াম ইত্যাদি। এসকল মূল খনিজগুলোর প্রয়োজনীয়তা যেহেতু ব্যাপকভাবে বেড়ে উঠবে, এই খনিজগুলোর জন্য অনুসন্ধান এবং খনন, ভূবিজ্ঞানীদের জন্য একটি প্রধান কর্মক্ষেত্র হিসেবে দাঁড়াবে।

এ কথা বেশ জোরের সাথেই বলা যায়, অন্যান্য শিল্পের পেশাদারদের (industry professionals) সাথে আমার গবেষণা এবং নানান ক্ষেত্রবিশেষে আলোচনা সহজেই আমাকে বর্তমান উপসংহারে নিয়ে এসেছে যে ভবিষ্যতের জ্বালানি পরিবর্তনের (energy transition) ক্ষেত্রে একজন ভূবিজ্ঞানীর ভূমিকা হবে অপরিসীম, তা বৈশ্বিক জ্বালানী শক্তি পূরণের জন্য তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে পেট্রোলিয়াম শিল্পকে অব্যাহতভাবে সমর্থন করাই হোক বা 'ট্রানজিশন ফুয়েল’ হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাসে ফোকাস করা বা সিসিএস অনুসন্ধানের মতো নতুন শিল্পকে সমর্থন করা হোক; অথবা হোক নবায়নযোগ্য জ্বালানি শিল্পে অবদান রাখা জিওথার্মাল, বায়ু বা সোলার এনার্জির ব্যাপারে। আমরা যদি এই ব্যাপারগুলো ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করতে সক্ষম হই এবং আমাদের সরকার ও সাধারণ জনগণের সাথে কার্যকর যোগাযোগের দিকে মনোনিবেশ করতে পারি, তাহলে আশা করা যায় যে বর্তমান অ-নবায়নযোগ্য (non renewable energy industry) শিল্পকে জ্বালানি শক্তি পরিবর্তনের সমাধানের অংশ হিসেবেই দেখা যাবে, সমস্যা হিসেবে নয়।