নুরুল ইসলাম: অর্থনীতির শিক্ষকদেরও শিক্ষক

বঙ্গবন্ধুর তত্ত্বাবধানে অধ্যাপক ইসলাম যে অর্থনৈতিক মুক্তি সংগ্রামের বীজ বপন করেছিলেন, তার পরের ধাপ শুরু হয়েছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিনির্মাণের স্বপ্নবুননে।

শুভাশীষ পালশুভাশীষ পাল
Published : 11 May 2023, 03:48 AM
Updated : 11 May 2023, 03:48 AM

তিনি ছিলেন অর্থনীতির শিক্ষকদেরও শিক্ষক। জাতীয় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম সম্পর্কে এমনটাই মনে করা হয়।

ড. নুরুল ইসলাম যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা করতেন তখন তার প্রত্যক্ষ ছাত্র এবং পরবর্তীকালে ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন স্বাধীনতা ও একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলিকুজ্জমান আহমদ। বর্তমানে দেশের অগ্রগণ্য অর্থনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ড. খলিকুজ্জমানের মতে, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সম্মানিত কালিনারায়ণ স্কলার অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বাংলাদেশে এযাবৎকালে যত অর্থনীতিবিদ সৃষ্টি হয়েছেন, তাদের সবার মধ্যে একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব।’

আরেক অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ মনে করেন, ‘নুরুল ইসলাম বাংলাদেশের কয়েক প্রজন্মের কাছে অর্থনীতির অবিসংবাদিত শিক্ষাগুরু।’

অধ্যাপক নুরুল ইসলামের কথা কোথা থেকে শুরু করা যায়? যে কয়জন মহান ব্যক্তিত্বকে জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণে রাখবে নিশ্চয়ই তিনি তাদের একজন। সদ্যপ্রয়াত প্রায় শতবর্ষী এই অর্থনীতিবিদ শুধু বাংলাদেশেই নয়, পুরো বিশ্বের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠসমূহে অর্থশাস্ত্র পণ্ডিতদের কাছে পূজনীয়। অর্থনীতিশাস্ত্রের মাপকাঠিতে একজন অর্থনীতিবিদের মূল্যায়ন হয় তার প্রজ্ঞা, গবেষণা, ও গবেষণালব্ধ ফলাফলের সরাসরি প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের ফলে অর্জিত ব্যক্তি বা জাতীয় কল্যাণের মাপকাঠিতে। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম সম্ভবত তার থেকেও বেশি কিছু ছিলেন।

একটি দেশের প্রশাসনিক অবকাঠামো যত শক্তিশালী ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা যত সুদূরপ্রসারী হয়, সে দেশ তত বেশি উন্নত হয়। নুরুল ইসলাম এমন এক ব্যক্তি ছিলেন, যার অর্থনৈতিক চিন্তার রাজনৈতিক অর্থনীতি এক সম্ভাবনাময় উন্নত রাষ্ট্রের জানান দেয় স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে। এমন অসংখ্য ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে যার নিজস্ব চিন্তা বা তত্ত্ব পুরো মানব সভ্যতার বিকাশে অবদান রেখেছে। কিন্তু খুব কম মানুষ আছে যার পরিকল্পনা একটি নির্দিষ্ট জাতির অর্থনৈতিক শোষণ ও নিপীড়নকে পরাহত করে মুক্তি সংগ্রামের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।

বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলন মূলত শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণার মধ্য দিয়ে। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ৬ দফা ঘোষণা করেন তা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের গণমুক্তির পথে প্রথম ধাপ। ঐতিহাসিক এই দফাগুলোর সম্প্রসারণে, তাদের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক (বিশেষত: অর্থনৈতিক বিষয়গুলো) গ্রহণযোগ্যতা ও সর্বোপরি একটি রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রেক্ষাপট রচনার দায়িত্বভার এসে পরে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ও তার দলের ওপর। এর প্রেক্ষাপট ও কর্মকৌশল বর্ণিত হয়েছে তারই লেখা 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: কাছে থেকে দেখা' বইয়ের 'ছয় দফার সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা' অংশে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা এবং অধ্যাপক ইসলাম ও তার দলের কাজ ‘দ্বি-জাতি তত্ত্বে’ গঠিত পাকিস্তানে আরেকটি ‘দ্বি-অর্থনীতির’ পাকিস্তানে রূপ দেয়। এই ছয় দফা দাবির সারমর্ম উপলব্ধি করে ভূট্টো বলেছিলেন, এই ছয় দফা (সিক্স পয়েন্ট) এর সমাধান একমাত্র এক দফা (One Point)-য়েই সম্ভব হবে যা হলো গান পয়েন্ট! অর্থাৎ, পাকিস্তান সরকার বুঝে গিয়েছিল, অর্থনৈতিক মুক্তি সংগ্রামের ডাক বাঙালিরা দিয়ে দিয়েছে, এর থেকে রেহাই পেতে হলে সশস্ত্র বল প্রয়োগের কোনো বিকল্প নেই। পাকিস্তানিদের বলপ্রয়োগের অনিবার্য পরিণতি যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা তা হয়তো ভুট্টো ভাবতে পারেননি।

মূলত পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির ওপর নির্ভর করেই পশ্চিম পাকিস্তান তার অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিশ্চিত করেছিল। নুরুল ইসলাম তার গবেষণায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পঞ্চাশের থেকে ষাটের দশকে কি পরিমাণ অর্থনৈতিক বৈষম্য বিরাজ করছিল তার একটি সহজ চিত্রায়ণ করেছেন। তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন, মানুষের মাথাপিছু গড় উন্নয়নের জন্য ১৯৫১-৫২ সাল এবং ১৯৫৯-৬০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের বরাদ্দ প্রায় পাঁচ গুণ বেশি ছিল। চল্লিশের দশকের শেষের দিকে (১৯৪৯-৫০) পশ্চিম পাকিস্তানের মাথা পিছু গড় আয় পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রায় ১৭ গুণ বেশি ছিল যা পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে এসে ৩২ শতাংশে উপনীত হয়। অর্থাৎ এক দশকে প্রায় দ্বিগুণ আয় বৈষম্য দেখা দেয়। এছাড়াও, ষাটের দশকের শুরুর দিকে পূর্ব পাকিস্তানে শতকরা মাত্র ১৩ ভাগ ব্যক্তি-বিনিয়োগ করা হয়, যা একটি রাষ্ট্রের দুর্বল অর্থনৈতিক অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক বৈষম্যকে ত্বরান্বিত করে।

বঙ্গবন্ধুর তত্ত্বাবধানে অধ্যাপক ইসলাম যে অর্থনৈতিক মুক্তি সংগ্রামের বীজ বপন করেছিলেন তার পরবর্তী ধাপ শুরু হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিনির্মাণের স্বপ্নবুননে, ১৯৭২ সালের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে। দেশ স্বাধীনের পূর্বে বঙ্গবন্ধু যে আস্থা অধ্যাপক ইসলামের ওপর রেখেছিলেন, তার পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন ঘটে যখন তিনি একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত, লুণ্ঠিত ও প্রায় মানব সম্পদহীন এক রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবকাঠামো তৈরির দায়িত্বভার তুলে দেন নুরুল ইসলামের কাঁধে। তার কমিশনই বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রদান করে, যা বাংলাদেশের উন্নয়নে অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখে।

যে বৈষম্যহীন অর্থনীতির পরিকল্পনা ছিল নুরুল ইসলাম কমিশনের তার প্রেক্ষাপট অনেকটা সমাজতান্ত্রিক ধারাকে অনুসরণ করেছিল, তাই সরকারি খাতকে প্রাধান্যে রেখে কাজ করেছিলেন। অধ্যাপক ইসলামের সময়কালে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৩-৭৮) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ শতাংশ, যেখানে অর্জিত হয় ৪ শতাংশ, যা একটি যুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনীতিতে, সম্পদের ঘাটতি, দুর্বল ব্যাংকিং ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ঘাটতি ইত্যাদি সীমাবদ্ধতার মধ্যেও প্রশংসনীয়। কিন্তু লক্ষ্যণীয় এই যে, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার মাধ্যমে নুরুল ইসলাম কমিশনেরও এক ধরনের অকার্যকারিতা পরিলক্ষিত হয়। অধ্যাপক ইসলাম বাংলাদেশ ছেড়ে পাড়ি জমান বিদেশে, সম্ভবত বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশ ও একটি অনিশ্চিত রাজনৈতিক ধারা পরবর্তীতে তাকে খুবই আহত করে। দেশে সক্রিয়ভাবে উপস্থিত না থাকলেও বিদেশে থেকেই চালিয়ে গেছেন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে তার গবেষণা, দিয়ে গেছেন বিভিন্ন পরামর্শ ও দিক নির্দেশনা, যা তার নানা সময়ে প্রকাশিত গ্রন্থসমূহে পরিলক্ষিত হয়।

রাজনীতিকে কখনোই অর্থনীতি থেকে আলাদা করা সম্ভব নয়। সকল সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার প্রয়োজন হয়। যে কল্যাণ রাষ্ট্রের কথা তিনি ও তার সমসাময়িক অর্থনীতিবিদরা ভাবতেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যা ও পরবর্তী বাংলাদেশের শাসকদের হাতে তার সম্ভাবনা প্রায় অসম্ভব বলেই মনে হয়। পরবর্তী সরকার দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা না নিয়ে স্বল্প মেয়াদী দ্বি-বার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৭৮-৮০) নেয়। যা নুরুল ইসলাম কমিশনের সময়কালীন জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেশি (৫.৫%) নির্ধারণ করলেও অর্জন করে মাত্র ৩.৫ শতাংশ। এই উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা ও নিম্ন অর্জনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। অর্থনৈতিক অবকাঠামো অনেকটাই নড়বড়ে হয়ে যায়, ব্যক্তি বিনিয়োগ ও বৈদেশিক সাহায্য নির্ভর এক অপরিপক্ক অর্থনীতির সূচনা হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা পরিলক্ষিত হয়, যার ফল ভোগ করতে হয় সাধারণ মানুষকে।

যাহোক, মূলত একজন নুরুল ইসলামকে জানার জন্য তার স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মহাপরিকল্পনাকে গুরুত্ব দিলে হবে না, দেখতে হবে তার মধ্যে অন্তর্নিহিত এক দেশপ্রেমকে। যে পরিকল্পনায় ছিল বাংলাদেশের খেটে খাওয়া শ্রমজীবী ও দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদার গুরুত্ব। ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত বৈষম্যহীন এক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট চিত্রিত হয় অধ্যাপক ইসলামের চিন্তাভাবনায়। তার ভাবনায় উঠে আসে বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা যা সকল প্রকার রাজনৈতিক স্বার্থের উর্ধ্বে থেকে শুধুমাত্র বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থ সংস্লিষ্ট বিবেচনাকে প্রশমিত করে। এর প্রমাণ মিলে কমিশনে দায়িত্বরত অবস্থায় মুজিব সরকারে বিভিন্ন মন্ত্রী ও আমলাদের সঙ্গে তার মতপার্থক্যে। বর্তমান সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যহীন একটি কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনে একটি স্বাধীন নুরুল ইসলাম কমিশনের তাৎপর্য রয়েই যায়। আমলা ও ব্যবসায়ী নির্ভর অর্থনীতি থেকে বের হয়ে একাডেমিক স্কলারদের মতামতকে প্রাধান্য দিতে হবে। মনে রাখতে হবে অধ্যাপক ইসলাম সর্বদাই জনমানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করতে চেয়েছিলেন, সকল প্রকারের ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থকে উপেক্ষা করে।

বর্তমান বাংলাদেশের তরুণ ও উঠতি অর্থনীতি চিন্তকদের কাছে দেশপ্রেমিক অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম এক অনুকরণীয়, অনুসরণীয় নাম। মানবকেন্দ্রিক উন্নয়ন ও কার্যকরী কল্যাণ রাষ্ট্র বিনির্মাণে নুরুল ইসলামের অর্থনীতি ভাবনাকে জানতে হবে, পাঠ করতে হবে। যিনি কখনো ব্যক্তিগত অর্জন বা সম্মান আদায়ের জন্য কাজ করেননি। তাইতো দেখা যায়, এই হার্ভার্ড পণ্ডিত, অর্থনীতিবিদ, মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক এখনও পর্যন্ত একুশে পদক কিংবা সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান, স্বাধীনতা পদকের মতো রাষ্ট্রীয় মূল্যায়ন পাননি। তারপরও, আমাদের মনে রাখতে হবে, অধ্যাপক ইসলাম শুধু বাংলাদেশের অর্থনীতির শিক্ষকদের শিক্ষক নন, রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের থেকেও বড় চিন্তাবিদ, উন্নয়ন অর্থনীতি চিন্তার পথিকৃৎ। এই স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের একজন অমর্ত্য সেন নেই, কিন্তু একজন নুরুল ইসলাম ছিলেন। তিনিও চলে গেলেন মাত্র একদিন আগে, ১০ মে ২০২৩ সালে।