আত্মহত্যা: ‘জ্যোতির্ময় তীর হতে আঁধার সাগরে’

বিচ্ছিন্নতার কারণ হতে পারে সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া সিয়ামের বেলায় কোনো কারণে কমে এসেছিল, কিংবা তার কৈশোরে তিনি ভুগেছেন কোনো হীনমন্যতার কূটে। এটা ভাবার অবকাশ কম যে তিনি গৌতম বুদ্ধের মতো নির্বাণ লাভ করেছেন। ভালো করে অনুসন্ধান করলেই পাওয়া যাবে তার কাছের ও দূরের ইতিহাস।

বিধান রিবেরুবিধান রিবেরু
Published : 9 April 2023, 10:09 AM
Updated : 9 April 2023, 10:09 AM

জাহাঙ্গীরগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরাফাত রহমান সিয়াম আত্মহত্যা করেছেন, এই সেদিন। নিজেকে খুন করার আগে ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন যার শিরোনাম ছিল “অন দ্য ওয়ে টু ইটারনিটি”, অর্থাৎ অনন্তের পথে। দীর্ঘ সেই পোস্টে সিয়াম বারবারই বলার চেষ্টা করেছেন মৃত্যু এক প্রাকৃতিক ব্যাপার মাত্র, একে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, কারণ অনন্ত জীবন অপেক্ষমাণ, যে জীবনে দেহ নয় আত্মাই সর্বশেষ কথা। সেই আত্মাকে মিশিয়ে দিতে হবে অনন্তের সঙ্গে। দেহ থেকে তাকে মুক্তি দিতে হবে। সিয়ামের ভাষ্য অনুযায়ী জীবনকে বুঝতে হলে আগে মৃত্যুর সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হবে। যে একবার মৃত্যুকে জয় করা অনন্ত জীবনের দেখা পায়, সে আর এই বাস্তবের জীবনে থাকতে চাইবে না। এধরনের আধ্যাত্মিক চিন্তার প্রকাশ করে যে ছেলেটি মৃত্যুকে বরণ করে নিল, তার ঘরে আবার পাওয়া গেল সাদগুরু বলে তথাকথিত এক ভারতীয় আধ্যাত্মিক গুরুর বই ‘ডেথ: অ্যান ইনসাইড স্টোরি’।

সাদগুরু মৃত্যু নিয়ে কি ভাবেন সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই, তবে ফরাসি মনোবিশ্লেষক জাক লাকাঁ মনে করেন মানবজীবনের ইতি টানা মৃত্যুর ব্যাপারে মানুষ ওয়াকিবহাল বলেই জীবনে স্থিতি আছে। ইতিকে বিশ্বাস না করলে জীবনকে বয়ে চলা দুঃসহ হয়ে ওঠে। সিয়ামের বেলাতেও তাই ঘটেছে। দৈহিক মৃত্যুকে তিনি নিছক প্রাকৃতিক মৃত্যু হিসেবে ঠাওরেছেন, ওটা তার কাছে ইতি নয়, বরং অনন্ত জীবনের পথে খুলে যাওয়া দরজা। এটাই পরম সত্য হিসেবে ধরা দিয়েছে সিয়ামের কাছে। অন্য দশটা মানুষও আদতে মানতে পারে না, যে জীবন সে পেয়েছে সেটা একদিন কর্পূরের মতো উবে যাবে, পূর্ণ যতি পড়বে জীবনযাত্রায়। সিয়ামের মতো অনেকেরই বিশ্বাস আত্মা এক শক্তি, শক্তির বিনাশ নেই। তবে অন্যরা কেন আত্মঘাতী হলেন না, বা সিয়াম কেন আলাদা হয়ে উঠলেন? কেন তিনি নিজেকে পরমের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়ার পদক্ষেপ নিলেন? এর কারণ সম্ভবত সমাজ ও সংসার থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন মানসিকভাবে। আশ্রয় খুঁজছিলেন দৈহিক মুক্তিতে।

আমরা জানি, শক্তির রূপান্তর ঘটে, জীবদেহ কবরে মিশে গেলে মাটি সার পায়, উদ্ভিদ বড় হয়, উদ্ভিদের ফল আবার জীব ভক্ষণ করে। এটাই রূপান্তর। তবে যে রূপান্তরের কথা সিয়াম ভাবছিলেন, বা আধ্যাত্মিক মানবেরা ভাবেন, আত্মার সেরকম রূপান্তর বিজ্ঞান ও যুক্তি সমর্থন করে না। সিয়াম হয়তো নিজেকে অনন্তের সঙ্গে যুক্ত করতে নিজের আত্মাকে মুক্ত করেছেন দেহ থেকে। কিন্তু যারা যুদ্ধ করতে গিয়ে নিজেকে উৎসর্গ করেন? কিংবা যারা আমৃত্যু অনশন করতে বসেন? বা যারা স্রেফ মজা পাওয়ার জন্য প্রাণঘাতী মাদক নেন? তারাও তো আত্মহত্যার পথকেই বেছে নেন। সকল মরণ যেমন সমান নয়, তেমনি সব আত্মহননও এক নয়। তবে তরুণদের ভেতর, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের ভেতর আত্মহত্যাপ্রবণতা নতুন কিছু নয়। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯১০ সালে জার্মান ভাষায় প্রকাশিত পল ফ্রাইডম্যান সম্পাদিত একটি বই থেকে, যার নাম “অন স্যুসাইড: উইথ পার্টিকুলার রেফারেন্স টু স্যুসাইড অ্যামং ইয়ং স্টুডেন্টস”।

আত্মহত্যা বিশারদ ও মনোবিশ্লেষক পল ফ্রাইডম্যান সম্পাদিত ওই বইতে তৎকালের বড়বড় মনোবিশেষজ্ঞরা নিজেদের মত দিয়েছেন। সেসময়ে মনোরোগবিদ্যায় আত্মহত্যাকে মানসিক বৈকল্য হিসেবেই ধরা হতো। তবে অস্ট্রিয়ান মনোবিশারদ ডেভিড আর্নেস্ট ওপেনহাইম তরুণদের আত্মহত্যাকে কেবল মনোবৈকল্য বলতে নারাজ। তিনি মনে করতেন এই মৃত্যুর দায় শিক্ষকদেরও নিতে হবে। শিক্ষকদের নজরে রাখতে হবে কোন বিদ্যার্থীটি লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়ছে, পরিবারের কাছ থেকে সহযোগিতা পাচ্ছে কি না এবং তার মানসিক অবস্থা কেমন। অনেক সময় পরিবার থেকে তরুণদের উপর নানা বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করা হয়, এসব চাপ থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। তবে ওই বইতে এই মতকে সমর্থন দেননি মনোবিশ্লেষক জিগমুন্ট ফ্রয়েড। তিনি মনে করতেন শিক্ষক হলেন পরিবারের সহায়ক শক্তি মাত্র, আর জীবনের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধিতে এদের তেমন ভূমিকা নেই। আত্মহত্যার পেছনে জটিল মানবিক আবেগকে বুঝতে হলে লিবিডোর (Libido) ভূমিকাকে আরো ভালো করে বুঝতে হবে বলে মনে করতেন ফ্রয়েড।

আরেক মনোবিজ্ঞানী রুডলফ রাইটলার মনে করতেন আত্মহত্যার পেছনে সাইকোনিউরোসিস ও ফোবিয়ার কারসাজি আছে। ফ্রয়েডের লিবিডো তত্ত্বকে সরাসরি সমর্থন না করলেও, রুডলফ শিক্ষার্থীদের অচেতনে যৌন অবদমন থেকে শঙ্কা ও ভীতির বহিঃপ্রকাশের উপর জোর দিয়েছেন। যে শঙ্কা ও ভয় সামাজিক স্তরে ছড়িয়ে পড়ে। যৌনতার টানাপোড়েনকে যে তরুণ শৈথল্যকরণের পথ দেখাতে পারেন না, তার ভেতরেই আত্মহত্যা করার ঝুঁকি তৈরি হয়। তবে ডক্টর ইজিডর স্যাজারের মতে, প্রেম ও ভালোবাসা বঞ্চিত তরুণ শিক্ষার্থীরা আত্মহননের দিকে পা বাড়াতে পারেন। আবার ডক্টর আলফ্রেড এডলার মনে করতেন, শৈশব থেকে যেসব বাচ্চা হীনমন্যতা নিয়ে বড় হয়, তাদের ভেতর আত্মবিশ্বাসের অভাব, অনিরাপদ বোধ ও ভীতি কাজ করে, যা তাদের নিজেকে শেষ করে দিতে প্ররোচিত করে।

তবে আত্মহত্যা মানুষ কেন করে তার একটি কাঠামোবদ্ধ কারণ উপস্থাপন করেছেন ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুরখেইম। ১৮৯৭ সালে প্রকাশিত “স্যুসাইড: আ স্টাডি ইন সোশিওলজি” বইতে উনবিংশ শতকের তথ্যউপাত্ত শুধু নয়, সেসময়ের শ্রেণিবিভাজিত আর্থসামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ডুরখেইম বলতে চান—মানুষ মূলত নানাবিধ সামাজিক কারণেই আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হয়। তার কাজের সমালোচনা আছে, তা সত্ত্বেও ডুরখেইমের বয়ানকে ফেলে দেয়া যায় না। তিনি মনে করতেন আত্মহত্যা হলো সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া (Social integration) ও নৈতিক নিয়ন্ত্রণ (Moral regulation) এই দুয়ের তারতম্যের ফল। বিষয়টি ব্যাখ্যা করলে হয় তো সিয়ামের আত্মহত্যার ধরনটিকে চিহ্নিত করা যাবে।

ডুরখেইম বলছেন, যখন কোনো মানুষের সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া কমে যায় বা থাকে না, তখন তার ভেতর বিচ্ছিন্নতাবোধ, বিষণ্নভাব ও বিষাদ ভর করে। সে ধীরে ধীরে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হয়। এই আত্মহত্যাকে বলে আত্মবাদী আত্মহত্যা (Egoistic suicide)। আবার যখন সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া অতিরিক্ত মাত্রায় থাকে, বিশেষ কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের প্রতি, তখন সমষ্টির প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ হয় মানুষ। সার্বিক মঙ্গল ও বড় আদর্শের জন্য তখন নিজের প্রাণকে উৎসর্গ করে সে। এটাও আত্মহত্যা। ডুরখেইম তাকে ডাকেন পরার্থবাদী আত্মহত্যা (Altruistic suicide)।

নৈতিক নিয়ন্ত্রণ যখন কমে যায়, বিশেষ করে অঢেল ধনসম্পদের মালিক হয়ে গেলে, অথবা হুট করেই রাজা থেকে ভিখারি বনে গেলে, এই দুই ক্ষেত্রেই মানুষ নিজের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারে না, সে তখন নিজেকে খাপছাড়া মনে করতে থাকে এবং সেসময় তার ভেতর সামাজিক নীতিনৈতিকতার নিয়ন্ত্রণ কমে যায়। হয় সে নিজের বাসনার পেছনে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত ও হতাশ হয়ে পড়ে, নয় তো প্রাপ্তি ও পতনের মাঝে বিশাল ফাঁক দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। তখন মানুষ আত্মহত্যা করে। ডুরখেইম একে বলেন দিশাহীন আত্মহত্যা (Anomic suicide)।

অপরদিকে, নৈতিক নিয়ন্ত্রণ যখন ঘাড়ের উপর চেপে বসে, বাড়াবাড়ি রকমের নীতিবোধের বেড়াজালে মানুষ জড়িয়ে পড়ে, যখন সে দেখে তার বাসনা পূরণের সব পথ বন্ধ, কামনাগুলো অবদমিতই থাকবে গোটা জীবন, তখন সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। অনেকটা যাবজ্জীবন পাওয়া কয়েদীর আত্মহত্যার মতো। এই ধরনের হননকে ডুরখেইম নাম দিয়েছেন নিয়তিবাদী আত্মহত্যা (Fatalistic suicide)। যদিও ডুরখেইম মনে করতেন এই ধরনের আত্মহত্যা তাত্ত্বিকভাবেই সম্ভব, বাস্তবে নয়।

যাহোক, মৃত্যুকে বরণ করে নেয়া সিয়াম উল্লিখিত পোস্টটির একদম শেষে লিখেছিলেন: “It may look like a self-centered action by the typical perspective. But when you will see it by the perspective of the eternal universe, you will find something different.” অর্থাৎ এই স্যুসাইড নোটকে যদি ডুরখেইমের ভাষায় ব্যাখ্যা করি তাহলে বলতে হয় সিয়াম বলতে চাইছেন, আপনারা আমার মৃত্যুকে আত্মবাদী আত্মহত্যা বলে ভুল করতে পারেন। কিন্তু আপনি যখন অনন্ত বিশ্বের সঙ্গে আত্মার মিলে যাওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখবেন তখন বিষয়টি ভিন্নভাবে ধরা দেবে আপনার চোখে।

সিয়ামের মানসিক, আর্থসামাজিক ও পারিবারিক অবস্থা আমাদের জানা নেই। তবে তার বিদায় নেয়া দেখে বোঝা যায়, কোনো কারণে তিনি বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত ছিলেন এবং এর ফলে আশ্রয় খুঁজছিলেন আধ্যাত্মিক দুনিয়ায়, যেখানে আত্মার মুক্তি ও পরমের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রতিশ্রুতি আছে। এই বিচ্ছিন্নতার কারণ হতে পারে সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া সিয়ামের বেলায় কোনো কারণে কমে এসেছিল, কিংবা তার কৈশোরে তিনি ভুগেছেন কোনো হীনমন্যতার কূটে। এটা ভাবার অবকাশ কম যে তিনি গৌতম বুদ্ধের মতো নির্বাণ লাভ করেছেন। ভালো করে অনুসন্ধান করলেই পাওয়া যাবে তার কাছের ও দূরের ইতিহাস। আর সেই ইতিহাসেই আমরা পেতে পারি তার ‘জ্যোতির্ময় তীর হতে আঁধার সাগরে’ ঝাঁপ দেয়ার আলামত।