ইউক্রেইন কি যুক্তরাষ্ট্রের ফাঁদেই আটকে থাকবে?

হেনরি কিসিঞ্জার তার মৃত্যুর আগে ইউক্রেইন সমস্যা সমাধানের একটা প্রস্তাব করেছেন। তার প্রস্তাবনা ছিল রাশিয়া ইউক্রেইনের যে ভূমি দখল করেছে সেটা মেনে নিয়ে ইউক্রেইনের উচিত রাশিয়ার সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করা।

মঞ্জুরে খোদামঞ্জুরে খোদা
Published : 25 Feb 2024, 06:31 AM
Updated : 25 Feb 2024, 06:31 AM

রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের দুই বছরে কে কী অর্জন করল, এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রকাশিত হচ্ছে। এগুলোর সব নিরপেক্ষ ও বস্তনিষ্ঠ এমনটা বলা যাবে না। এরমধ্যে আছে প্রপাগান্ডা ও সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণ। সেগুলো বিশ্বাস ও মতাদর্শ দ্বারা নানাভাবে প্রভাবিত ও পক্ষপাতমূলক। যে কারণে যুদ্ধের লাভ-ক্ষতি ও অর্জনের প্রকৃত চিত্র সবটা পাওয়া দূরূহ ও কঠিন।

পাশ্চাত্যের মিডিয়া বলছে, রাশিয়া ও পুতিনের অবস্থা খুব ভালো নয়। দেশটি সহসাই বড় বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে। তারা ইউক্রেইনের সাফল্য-বীরত্ব বড় করে তুলে ধরছে। রাশিয়ার পুতিনবিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনির কারাগারে মৃত্যুকে নিয়েও পুতিনের বড় ধরনের বিপর্যয় দেখছেন। বাস্তব পরিস্থিতি কি তাই? ইরাক আক্রমণের সময়ও মার্কিনীরাও অনেক মিথ্যা গল্প ফেঁদেছিল। যে মিথ্যাচারের কথা আজ তারাই স্বীকার করছে।

যুদ্ধ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তেই হচ্ছে তবে রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে আলোচনায় আছে। যদিও ইসরায়েলের গাজা আক্রমণ, হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ একে অনেকটা ম্লান করে দিয়েছে। ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে রাশিয়ার ইউক্রেইন অভিযান তৃতীয় বছরে পা দিয়েছে। সবারই প্রশ্ন গত দুই বছরে রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধে কে কী অর্জন করল? এই যুদ্ধ বন্ধে পাশ্চাত্যের কোনো উদ্যোগ-প্রচেষ্টা নেই কেন?

সম্প্রতি ইউক্রেইনের রাষ্ট্রপতি জেলেনস্কির প্রধান উপদেষ্টা মিখাইলো পোদোলিয়াক এক এক্স (টুইটার) পোস্টে বলেন, মস্কোর সঙ্গে আলোচনা শুরুর জন্য তাদের কিছু শর্ত রয়েছে। সেগুলো হলো ‘অস্ত্রবিরতি, জেড প্রতীকযুক্ত সেনা প্রত্যাহার, অপহৃত নাগরিকদের ফিরিয়ে দেওয়া, যুদ্ধাপরাধীদের বহিষ্কার, ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়া এবং ইউক্রেইনের সার্বভৌমত্বের অধিকারে স্বীকৃতি।’ জেলেনস্কিও একাধিকবার বলছেন, তাদের দখলকৃত ‍ভূমি উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত তিনি পুতিনের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনায় যাবেন না। 

সম্প্রতি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন টাকার কার্লসনকে দেওয়া এক বিরল সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যেতে পারে যদি যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেইনকে অস্ত্র সাহায্য বন্ধ করে। শুধু তাই নয়, এর আগেও রাশিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যুদ্ধ বন্ধ বা আলোচনা হতে পারে যদি ইউক্রেইন রাশিয়ার তিনটি শর্ত মানতে রাজি হয়। সেগুলো হচ্ছে, ১) ইউক্রেইনকে নাৎসি চেতনা ও তার পক্ষের সকল কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে ২) ইউক্রেইনকে ন্যাটোতে যোগদান থেকে বিরত থাকতে হবে ৩) রাশিয়ার দখলকৃত দোনেস্ক, লুহানস্কের, জাপোরিঝিয়া ও খেরসন অঞ্চলের দাবি ছাড়তে হবে। যেসব অঞ্চল ইতোমধ্যে গণভোটের মাধ্যমে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

উভয়পক্ষই যেভাবে শর্ত জুড়ে দিয়েছে তাতে কি তাদের মধ্যে আলোচনা সম্ভব? এ সব শর্তের অর্থই হচ্ছে এই সম্ভাবনাকে নাকচ করা। জেলেনস্কির প্রতিনিধি বলছেন, রাশিয়াকে এই যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তাদের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্তের এটি একটি। বাস্তবে কি এমনটি ঘটেছে? সেই আবদার রাশিয়ার কাছে করার আগে যুক্তরাষ্ট্রকে বলা হোক, তারা যেন ভিয়েতনাম, ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে যুদ্ধের মাধ্যমে যে ক্ষতি করেছে তার ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেয়। ইসরায়েলকে বলা হোক ফিলিস্তিনে ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষতিপূরণ দিতে। তারপরও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জি-৭ রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৩২ হাজার ৩০০ কোটি ডলার রিজার্ভ আটকে ইউক্রেইন পুনর্গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। যদিও রাশিয়া বলছে এটা করার এখতিয়ার তাদের নেই। কিন্তু এই যুদ্ধের মাধ্যমে সারা দুনিয়া যে আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছে তার দায় কে নেবে?

ইউক্রেইন নেতৃত্ব পুতিনের সঙ্গে আলোচনা না করে যুদ্ধের মাধ্যমেই কি তাদের পরাজিত করতে চায়? বিশ্বের বৃহৎ পরাশক্তির সঙ্গে কি তা সম্ভব? তারচেয়ে বড় প্রশ্ন, ইউক্রেইন রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা কি তাদের আছে? প্রশ্ন সেখানেই তৈরি হয়, যে দেশের সেনাপ্রধানকে পর্যন্ত সরাতে যুক্তরাষ্ট্রের সবুজ সংকেত লাগে! গতবছর আলোচিত এক টিভি সাক্ষাৎকারে ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেইনের শান্তি আলোচনা আটকে আছে যুক্তরাষ্ট্রের অনাগ্রহের কারণে। অনেক বিশেষজ্ঞও তাই মনে করেন। কার্নেগি এনডাউটমেন্ট ফর ইন্টান্যাশনাল পিসের সিনিয়র ফেলো ডারা ম্যাসকিট বলেন, ‘পশ্চিমা সমর্থন ছাড়া ইউক্রেইন রাশিয়ার সঙ্গে কোনো আলোচনা ও সমাঝোতার অবস্থানে আসতে পারবে না।’ এখানেই ইউক্রেইন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ আটকে আছে। 

মার্চের নির্বাচনে পুতিন আবারও রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে ২০৩০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন। তবে এই সময়ে ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রে যে পুতিনবিরোধী নেতৃত্ব আছে সেখানে পরিবর্তন ঘটলে অবস্থা অন্যরকম হতে পারে। ইতোমধ্যে এ বছর নভেম্বরে মার্কিন নির্বাচনে ট্রাম্পের ফিরে আসার সম্ভাবনায় জেলেনস্কি তাদের সাহায্য-সমর্থন নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। এক ভাষণে তিনি বলেছেন, আসন্ন নির্বাচনে ডনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের নেতা নির্বাচিত হলে তারা সংকটে পড়বেন। ইউরোপের দেশে দেশে যুদ্ধ ও সাহায্য বন্ধের চাপ তৈরি হচ্ছে এবং সেখানে নেতৃত্ব পরিবর্তন আসন্ন।

প্রশ্ন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তি-সাহায্যের ওপর নির্ভর করে, তাদের ইন্ধনে জেলেনস্কি কেন তার দেশকে বিপদের মুখে ঠেলে দিলেন? শুধু কি ন্যাটোতে যুক্ত হওয়ার জন্য? একজন রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে ভূরাজনীতির এই পাঠ কি খুব জটিল কিছু? তাহলে বিপদ জানা সত্ত্বেও ইউক্রেইনকে ন্যাটোতে টেনে নিতে পাশ্চাত্যের এই ছক আসলে কীসের? অভিসন্ধি হলো যুদ্ধের ফাঁদে ফেলে রাশিয়াকে ধ্বংস করা, যার প্রক্সি হয়েছে ইউক্রেইন! 

সোভিয়েত ইউনিয়ন বিপর্যয়ের দুই দশকের মধ্যে রাশিয়া অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে ঘুরে দাঁড়ানো মার্কিনীদের জন্য হয়ে উঠেছে বড় চ্যালেঞ্জ। অভিন্ন মতাদর্শের কারণে রাশিয়ার সঙ্গে তো পাশ্চাত্যের বিরোধ হবার কথা নয়। তাহলে কেন এই দ্বন্দ্ব? সমাজতন্ত্রের পথ ছেড়ে অনেক আগেই মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারায় যুক্ত হয়েছে রাশিয়া। সমস্যা আসলে নীতি-ব্যবস্থায় নয়। তাদের সংকট বিশ্ব মোড়লিপনা ও আধিপত্যের। গোটা ইউরোপকে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অনুগত রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। রাশিয়াকেও চেয়েছিল তার বর্ধিত সংস্করণ হিসেবে। সেটা না হওয়াই হয়েছে তাদের চালের ভুল। 

রাশিয়াকে ভাঙ্গন ও শক্তিহীন করার উল্টো ছকে এখন ইউক্রেইনই পড়েছে। জাতিসংঘের হিসেবে গত দুই বছরে ৪ কোটি জনসংখ্যার ১ কোটি ৪০ লাখ আভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং ৬৫ লাখ নাগরিক বিদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তরুণ-যুবকদের রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাধ্য করা না হলে এই সংখ্য হতো অনেক বেশি। রাশিয়া তাদের ভূখণ্ডের প্রায় এক চতুর্থাংশ দখল করে নিয়েছে। শক্তি, অবকাঠামো, মানবিক, অন্যান্য ক্ষতির সঙ্গে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ঋণের বোঝা তো আছেই। ক্ষতি রাশিয়ারও হয়েছে, তারাও দেশ-বিদেশে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। 

যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে ইউক্রেইনের প্রস্তাবিত ৬০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল আটকে দিয়েছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও সেই আলোচনা জোরদার হয়ে উঠছে। তাদের অবস্থানও আগের মতো নেই। ইউক্রেইন প্রশ্নে বিভাজন ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। হাঙ্গেরি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে। তুরস্ক ইসরায়েলের বিপক্ষে পাশ্চাত্যকে হুমকি-ধমকি দিয়ে যাচ্ছে। গতবছর ডিসেম্বরে ইউক্রেইনকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য করার আলোচনা শুরু করা নিয়ে যখন ভোটাভুটি হয়, তখন সম্মেলনকক্ষে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান ছিলেন না। কিন্তু ভিক্টর ওরবান বলেছেন যে, তারা ইউক্রেইনকে সদস্য করার ইইউর উদ্যোগ আটকে দেবেন।

যুদ্ধের দ্বিতীয় বছর পূর্তিতে রুশ নেতাদের বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে, তাদের বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে তারা আরও আত্মবিশ্বাসী। সাবেক রুশ রাষ্ট্রপতি দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেছেন, তারা কিয়েভ ও ইউক্রেইন দখলে নেয়ার লক্ষ নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। ব্রিটিশ-মার্কিন অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞই বলেছেন, রাশিয়া তার সামরিক শক্তির সামান্যই ব্যয় করছে ইউক্রেইন যুদ্ধে। এই যুদ্ধে রাশিয়া জয় পেলে বিশ্ব রাজনীতি ও সামরিক শক্তিতে তাদের প্রাধান্য ও গুরুত্ব বাড়বে। মার্কিন ও পশ্চিমা শক্তি ইউক্রেইনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে আকাঙ্ক্ষায় ইন্ধন দিচ্ছে তা অধরা থাকবে।

হেনরি কিসিঞ্জার তার মৃত্যুর আগে ইউক্রেইন সমস্যা সমাধানের একটা প্রস্তাব করেছেন। তার প্রস্তাবনা ছিল রাশিয়া ইউক্রেইনের যে ভূমি দখল করেছে সেটা মেনে নিয়ে ইউক্রেইনের উচিত রাশিয়ার সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করা। সেটা না করা হবে তাদের জন্য বড় ভুল ও ক্ষতির কারণ। যে হেনরি কিসিঞ্জার এ কথা বলেছেন, তাকেও বিশ্বের অনেকগুলো যুদ্ধের ও মানবাধিকার লঙঘনের জন্য দায়ী করা হয়। যদিও এ জন্য তাকে কোনো মামলার মুখোমুখি হতে হয়নি। কিন্তু বিভিন্ন তথ্যে জানা যায় যে, তার বিরুদ্ধেও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আছে। শোনা যায় মানুষ নাকি মৃত্যুর আগে নির্ভুল বলে যান। হয়তো হেনরি কিসিঞ্জার মৃত্যুর পূর্বে সে কারণেই এমন মন্তব্য করেছিলেন। তা না হলে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা মার্কিন স্বার্থের একজন একনিষ্ঠ ব্যক্তি মার্কিন সরকারের নীতির বিরুদ্ধে এমন কথা বলেন কী করে? যেখানে এই যুদ্ধের প্রধান অনুঘটক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই। ইউক্রেইনের সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বলা যায় এই মার্কিন কূটনীতি ও বিশেষজ্ঞের নির্দেশনাই হতে পারে ইউক্রেইন যুদ্ধের পরিসমাপ্তির কারণ।