Published : 29 Jun 2023, 02:41 AM
শৈশবে একটা প্রশ্ন আমায় প্রায়ই তাড়া করতো। যে দেশটি জিতে নেয় অলিম্পিকের অধিকাংশ সোনা, প্রতিবছর নোবেলের বেশিরভাগ পদক শোভা পায় যার ক্রোড়ে, যার রয়েছে এমন সব অতিকায় কোম্পানি যাদের একেকটির আয় গোটা বাংলাদেশের জিডিপিকে ছাড়িয়ে যায়, সেই দেশটিকে কেন এক গোলার্ধ পেরিয়ে ছুটে আসতে হয় বাংলাদেশে? ভিড় জমাতে হয় জীর্ণ-শীর্ণ বাংলাদেশী গার্মেন্টসগুলোতে? আশ্চর্য হলো, প্রশ্নটা থেকে এই পরিণত বয়সেও মুক্তি মেলেনি আমার, সুযোগ পেলেই তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আমায় শৈশবের মতো!
যখন বাংলাদেশের রানা প্লাজায় সহস্রাধিক লোক জীবন দিয়ে পৃথিবীর সব থেকে বড় ইন্ডাস্ট্রিয়াল দুর্ঘটনাগুলোর একটির জন্ম দেয়, তখন একটি আমেরিকান আর্টিকেল বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছিল, যার শিরোনাম ছিল–“বাংলাদেশ ফ্যাক্টরি কলাপস: হু রিয়েলি পেইস ফর আউয়ার চিপ ক্লোথস?”
এটা সেই সময় যখন বাংলাদেশের টি শার্ট আর জিনসের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছিল আমেরিকান সমাজে। কী ছিল বাংলাদেশে তৈরি পোশাকে? এগুলো কি সেই ঢাকাই মসলিনের মতো ফিনফিনে ছিল যে একটি দিয়াশলাই বাকসে ৫০ মিটার কাপড় এঁটে দেয়া যায়, আর পশ্চিমা তরুণ-তরুণীরা সেই দিয়াশলাই খেলার লোভেই পা বাড়ায় ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ শপিং মলে? মজার ব্যাপার হলো, গায়ে-গতরে মসলিন যুগের মতো পাতলা না হলেও বাংলাদেশের এই জমানার পোশাকগুলো কিন্তু দামের দিক থেকে ভয়ানক পাতলা। প্রায় এক গোলার্ধ দূরের একটি দেশের মানুষের পোকামাকড়ের মত ঘরবসতি, তাদের সস্তা শ্রম, আর সস্তা সব নিয়মকানুন যাকে অল্প মূল্যেই বদলে দেয়া যায়–সেই গল্পগাঁথা, যা আগে ছিল প্রদীপের আড়ালেই, তা-ই উন্মোচন করে দেখিয়েছিল রিপোর্টটি! কিন্তু যে মানুষগুলো ছিল কারিগর, তাদের যে কালের বিবর্তনে শ্রমিক বানিয়ে দেয়া হয়েছিল, সে বিষয়ে রিপোর্টটি ছিল একেবারেই নীরব।
বাংলাদেশ গর্ব করে পৃথিবীর নাম্বার টু গার্মেন্টস রপ্তানিকারক দেশ হওয়ার। ইউরোপে প্রতি তিনজনের একজনের গায়ে দেখা যায় ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ টি শার্ট। আমেরিকায় প্রতি পাঁচজনের একজনকে দেখা যায় ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ জিন্স পরতে। ১৯৭৮ সালে ফ্রান্সের প্যারিসভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানে ১৩ মিলিয়ন ফ্রাংকের একটি ক্ষুদে চালান দিয়ে যার যাত্রা শুরু, সে-ই আজ ২৮.১৪ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি নিয়ে অভ্যন্তরীণ রপ্তানি বাজারের ৮২ শতাংশ ও বৈশ্বিক তৈরি পোশাক বাজারের ৬.৪ শতাংশ দখল করে বসে আছে। সর্বসাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী যুগে ইউরোপীয় ইউনিয়নে তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি-প্রবৃদ্ধিতে শীর্ষ দেশটির নাম হল বাংলাদেশ। মৌলিক ও নিম্ন-মধ্য ক্যাটাগরির পোশাক উৎপাদন যার দৈনন্দিন ব্যবহার এমনকি যুদ্ধও ঠেকাতে পারেনি–তা গড়ে দিয়েছে এমন বুনিয়াদ বাংলাদেশের জন্য। অর্থনীতির দিকপাল ও নীতিনির্ধারকরা এই শিল্পেই দেখছেন বাংলার প্রাণভোমরা, আর তাই সেট করে নিয়েছেন ৫০বিলিয়ন ডলারের একটি অতিকায় রপ্তানি টার্গেট অদূর ভবিষ্যতের জন্য।
এককালে নীল ব্যবসাকে নিয়ে এমন গর্ব করা হতো বিদ্বসমাজে। রাজা রামমোহন রায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ও প্রসন্ন ঠাকুরের মতো লোকেরাও নীলচাষের পক্ষে কলম ধরেছিলেন। ১৭৭২ সালে যে নীল ব্যবসার সূচনা হয় ফরাসীদের হাতে চন্দননগরের নিকটবর্তী গোন্দলপাড়া গ্রামে, কালে কালে তার লাগাম পুরোই চলে আসে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। ১৭৯৬ থেকে ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নামমাত্র সুদে কোম্পানি প্রায় এক কোটি সিক্কা টাকা ঋণদান করে। উৎপন্ন নীল পাউন্ড প্রতি এক টাকা চার আনায় কিনে নিত কোম্পানি আর লন্ডনের বাজারে পাউন্ড প্রতি পাঁচ থেকে সাত টাকায় বিক্রি করত। ইংরেজদের জন্য এই চরম লাভজনক ব্যবসার মাঝে দেশেরও লাভ দেখতে পেয়েছিলেন অনেকেরই মতে বাংলার প্রথম শিল্পপতি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। তিনি ১৮২৮ খ্রিস্টব্দের ২৬ ফেব্রুয়ারির ‘সম্বাদ কৌমুদী’ পত্রিকায় ‘একজন জমিদার’ নামে লিখেছেন, “এ দেশে যার ভূ-সম্পত্তি আছে এবং যিনি নিজে তার জমিদারী দেখাশোনা করেন, তারই কাছে এ কথা সুবিদিত যে নীলচাষের জন্য কি বিরাট পরিমাণ পতিত জমিতে আবাদ হয়েছে এবং নীলচাষের মালিকরা যে দেশজুড়ে টাকা ছড়াচ্ছেন, তাতে দেশের নিম্নশ্রেণীরা কেমন স্বচ্ছন্দে দিনপাত করছে। আগেকার দিনে যে সব চাষী জমিদারের জবরদস্তিতে বিনামূল্যে বা অল্প পরিমাণ ধানের বিনিময়ে কাজ করতে বাধ্য হত তারা এখন নীলকরদের আওতায় খানিকটা স্বাধীনতা ও স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করছে; তারা প্রত্যেকেই নীলকরদের কাছ থেকে মাসিক চার টাকা বেতন পাচ্ছে এবং অনেক মধ্যবিত্ত যারা নিজেকে ও পরিবারকে প্রতিপালন করতে পারত না তারা নীলকরদের দ্বারা উঁচু বেতনে সরকার প্রভৃতি পদে নিযুক্ত হচ্ছে। এখন তারা জমিদার বা বেনিয়ার খামখেয়ালি ও মর্জি দ্বারা নির্যাতিত হয় না।“
১৮২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর টাউন হলে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে দ্বারকানাথ নীল চাষের সাফাই গান। আলোচ্য সভাতেই রাজা রামমোহনকে বলতে শোনা যায়, “নীলকরদের সম্বন্ধে আমি বলতে পারি যে, বাংলা ও বিহারের কয়েকটি জেলায় নীলকুঠিগুলির কাছাকাছি অঞ্চলে আমি ঘুরেছি। আমি দেখেছি যে, নীলকুঠির আশেপাশের বাসিন্দারা নীলকুঠি থেকে দূরের জায়গার লোকেদের চেয়ে ভালো কাপড় পরে ও ভাল অবস্থায় বাস করে।“ আলোচ্য সভায় বিশিষ্ট জনেরা যে মত ব্যক্ত করেন তার সারাংশ হল, সভ্য ইংরেজদের মাধ্যমে আমাদের সভ্যতার অভাব ঘুচবে, ইউরোপীয়দের ব্যবসা-বাণিজ্যের অবাধ সুযোগ দান আমাদের দেশের ব্যবসার উন্নতি ঘটাবে, অর্থনীতির চেহারাটাই আমূল পাল্টে দেবে।
ইতিহাস সাক্ষী যে, আমাদের দেশজ অর্থনীতির চেহারাটা চিরকালের জন্যই পালটে গিয়েছিল তখন থেকে। ১৮৩২ খ্রীস্টাব্দে ইংল্যান্ডে পার্লামেন্টারি সিলেক্ট কমিটির তদন্তকালে ডেভিড হিল নামে ইস্ট ইন্ডিয়ার সরকারে এক উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে নীল চাষে বাংলাদেশের কোন উন্নতি হয়েছে কিনা সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন, “গ্রামের চেহারার (অর্থাৎ রাস্তাঘাটের) যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে, কিন্ত জনসাধারণের অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি।“ ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় অক্ষয়কুমার দত্ত লিখেন, “তিনি (ইংরেজ নীলকর) প্রজাদিগের নীলের অত্যল্প অনুচিত মূল্য ধার্য করেন। নীলকর সাহেব স্বাধিকারের একাধিপতিস্বরূপ, তিনি মনে করিলেই প্রজাদিগের সর্বস্ব হরণ করিতে পারেন, তবু অনুগ্রহ ভাবিয়া দাদনস্বরূপ যৎকিঞ্চিৎ যাহা প্রদান করিতে অনুমতি করেন, গোমস্তা ও অন্যান্য আমলাদের দস্তুরি ও হিসাবানাদি উপলক্ষে তাহারও কোন না অর্ধাংশ কর্তন যায়! একারণ প্রজারা যে ভূমিতে ধান্য ও অন্যান্য শস্য বপন করিলে অনায়াসে সম্বৎসর পরিবার প্রতিপালন করিয়া কালযাপন করিতে পারে, তাহাতে নীলকর সাহেবের নীল বপন করিলে লাভালাভ দূরে থাকুক, তাহাদিগকে দুশ্ছেদ্য ঋণজালে আবদ্ধ হইতে হয়।“
ইউরোপীয়দের নীলব্যবসাকে আরো জাঁকিয়ে তোলার জন্য রামমোহন-দ্বারকানাথ ও আরো অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগে গভর্নর-জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্কের সমর্থনসহ একটি আবেদন পত্র পৌঁছুনো হয় ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে। কিন্তু কিছু বনেদী জমিদার এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আর একখানি পত্র প্রেরণ করেন ইংল্যান্ড পার্লামেন্টে যার মূল ভাষ্য, “যে সব জেলায় নীলকররা বা অন্যান্য লোকেরা নিজেদের বাসস্থান স্থাপন করেছেন সেখানে জনসাধারণ অন্যান্য স্থানের জনসাধারণের চাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, কেননা নীলকররা বলপূর্বক ঐসব জমি দখল করেছেন এবং ধানগাছ নষ্ট করে নীলচাষ করেছেন (ধানের উৎপাদন কমে যাওয়ার এবং অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিসের অভাবের তাই কারণ)। …ভারতের অধিবাসী বিশেষ করে যাদের পদমর্যাদা আছে বা যারা উচ্চশ্রেণীভুক্ত–ভূসম্পত্তি ব্যতীত তাদের জীবিকার্জনের অন্য কোনো পথ নেই। এই অবস্থায় যদি তাদের জমিদারী (যা বকেয়া খাজনার জন্য প্রকাশ্যে নিলাম হতে পারে) বিদেশী দ্বারা ক্রয় করতে দেয়া হয়, তবে জীবনের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর জন্য এবং পদমর্যাদা রক্ষার্থে তাদের অত্যন্ত দুঃখ কষ্টে দিনযাপন করতে হবে।“
এই জমিদারেরা শ্রেণীস্বার্থেই কথা বললেও তাদের বক্তব্যে নীলচাষের সত্যিকার শ্রী’টা ঠিকই ফুটে উঠেছিল। তখনকার দেশী জমিদারেরা নীলচাষ মেনে নিতে না পারলেও বর্তমানে দেশী শিল্পপতিরা আরএমজি চাষ দুবাহু বাড়িয়ে গ্রহণ করছেন, মালয়েশিয়া ও কানাডায় সেকেন্ড হোমের বিনিময়ে তারা বিশ্বের রিটেইল মোগলদের হাতে তুলে দিচ্ছেন কাড়ি কাড়ি অর্থ, আর ওদিকে আমাদের শ্রমিকদের হতে হচ্ছে দগ্ধ হয় বাহ্যিক আগুনে, নয়তো অভ্যন্তরীন জীবনের ন্যূনতম দাবি না মেটাতে পারার দহনে। নীলচাষের মতোই রাশি রাশি সুযোগ-সুবিধার যুক্তি ছোঁড়া হয় আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পের জন্যও। আর রাশি রাশি বঞ্চনা ও সংকোচনের ইতিহাস থেকে যায় আড়ালে। নীল চাষের বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে ছিল শোষণ; আর ছিল জমির উর্বরতা-হানি ও এতদসংশ্লিষ্ট দূষণ। আধুনিক কালের তৈরি পোশাকের শিল্প-জাদুতে একই রকম শোষণ ও দূষণ আরো পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত আকারে দেখতে পাওয়া যায়!
প্রথমে শোষণের ব্যাপারটিতে আসা যাক। আর্নেস্ট ফ্রেডরিখ শুমেখার তার ‘স্মল ইজ বিউটিফুল’ নামের কালজয়ী বইয়ে একটি আফ্রিকান টেক্সটাইল মিল পরিদর্শনের কথা জানান, যেখানে গিজগিজ করছিল ধনী দেশ থেকে আমদানি করা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি। স্থানীয় তুলো টপ কোয়ালিটি সুতো উৎপাদনে যথেষ্ট নয় বলে কারখানাটিকে এমনকি প্রয়োজনীয় কাঁচামালও ওই সব ধনী দেশ থেকে আমদানি করতে হতো। এরকম উন্নয়ন মডেলের আরো উদাহরণ মেলে শুমেখারের বইটিতে যেখানে সাবান বা খাদ্য উৎপাদনে প্রয়োজন পড়ত সু-শোধিত ও শোভিত সব কাঁচামাল যা শুধু ধনী দেশেই মিলত অতি চড়া দামে। এদিকে দেশীয় অব্যবহৃত কাঁচামাল আবার রপ্তানি হতো ওইসব ধনী দেশে অতি স্বল্প মূল্যে। শুমেখারের কথায়–“দরিদ্র দেশগুলোকে ঠেলে দেয়া হত ধনী দেশের উৎপাদন পদ্ধতি ও ভোগ-মানকে লুফে নিতে, যা দরিদ্র দেশগুলোর স্বনির্ভরতার সব সুযোগকে বিনষ্ট করে দিত। এর অবধারিত ফলাফল ছিল, দরিদ্র দেশগুলোর অজান্তেই একটি নয়া উপনিবেশবাদের গোড়াপত্তন।“ বাংলাদেশী পোশাক কারখানাগুলোর অনেকগুলোতে শুমেখারের পরিদর্শিত কারখানাটিকে অবিকল দেখতে পাওয়া যাবে যে সন্দেহ নেই।
আমাদের তৈরি পোশাকের বাজারদরে আগে থেকেই ভাটার টান ছিল, যা ইতোমধ্যে ঠেকেছে তলানিতে। রানা প্লাজার মতো দুনিয়া কাঁপানো দালান ধসের পর রিটেইল পুঁজিপতিরা অ্যাকর্ড ও আল্যায়েন্স নামে দুটো কারখানা পরিদর্শক গড়ে তুলেছে, যাদের কাজ হলো গার্মেন্টস কারখানাগুলোকে আরো পরিবেশবান্ধব করে তোলা। ইতোমধ্যে ১৫৭টার মতো গার্মেন্টস কারখানা পাস করেছে টেকসই হওয়ার পরীক্ষায়; ৩০ শতাংশ কম শক্তি খরচ করে তারা রূপান্তরিত হয়েছে ‘গ্রিন’ ইন্ডাস্ট্রিতে। কিন্তু এই পথে করতে হয়েছে যে সাধনা, ঝরাতে হয়েছে ঘাম, তার দাম দিচ্ছে না রিটেইল ক্রেতারা। প্রায় ১৫-২০ শতাংশ খরচ বেড়ে গেলেও গার্মেন্টসগুলোর বরাতে জুটেছে কেবল ২ শতাংশ কর-ছাড়, আর একখানা সার্টিফিকেট ‘লিড’ নামক আন্তর্জাতিক মান নির্ধারণী প্রতিষ্ঠান থেকে।
কাঁচামাল, পরিবহন খরচ কয়েক গুণ বাড়লেও পোশাকের মূল্য ক্রমেই কমিয়ে দিচ্ছে বিদেশী ক্রেতারা প্রতিযোগিতার দোহাই দিয়ে। একটা হিসেবে দেখা যায়, রিটেইল মূল্যের মাত্র ১০-১৫ শতাংশ জুটছে বাংলাদেশের কপালে, অথচ এক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ একটি স্বীকৃত মানদণ্ড আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায়। বাংলাদেশের নোয়ানো মাথার পুরো সুযোগ যে নেয়া হচ্ছে, তার একটি বড় প্রমাণ হলো–যে পণ্যটি তুরস্কের কাছ থেকে কিনতে হয় ৫ ডলারে, সে একই পোশাকের জন্য মাত্র ২ ডলার গুঁজে দিয়ে পথ দেখতে বলা হচ্ছে বাংলাদেশকে। আবার মাল দেয়ার পরেও আটকে রাখছে, এক তরফা অর্ডার বাতিল করছে দাপুটে বিদেশী রিটেইল ক্রেতারা, মাঝে মাঝে যাদের স্রেফ ঈশ্বর ছাড়া আর কিচ্ছু মনে হয় না। করোনা পরবর্তী সময়ে প্রায় ৩২ টি বাংলাদেশী গার্মেন্টস প্রখ্যাত আমেরিকান ব্র্যান্ড ‘সিয়ার’-এর বিরুদ্ধে মামলা করে বিপুল পরিমাণ অর্ডার বাতিলের ঘটনায় সংক্ষুদ্ধ হয়ে। প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল ও ২২.৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য তখন শিপমেন্ট হয়ে গেলেও দিন শেষে বাদীদের বিধিতে বরাদ্দ হয় মাত্র ৬.৩ মিলিয়ন।
এবার আসা যাক দূষণের বিষয়ে। বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর আইন অনুযায়ী বিভিন্ন কলকারখানা থেকে নির্গত রাসায়নিকযুক্ত তরল বর্জ্য এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের (ইটিপি) মাধ্যমে শোধন করে ব্যবহার করতে হবে বা ফেলে দিতে হবে। এরই মধ্যেই বিভিন্ন গবেষণায় আমাদের নদনদীর দূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে টেক্সটাইল কারখানাগুলো। অপরিশোধিত তরল বর্জ্য নদীতে ফেলে নদীর জীব বৈচিত্র্য তছনছ করা, মাছের মারি ঘটানো ও নদীর উপর নির্ভরশীল ফসলগুলোকে হত্যা করা–এসব অপরাধে আগে থেকেই বিভিন্ন দেশের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ছিল পোশাক-সংশ্লিষ্ট শিল্পকারখানাগুলো। কর্মসংস্থানের রসগোল্লা গিলিয়ে চোখ অনেক দিন বেঁধে রাখার পর, অবশেষে ‘তৈরি পোশাক’ শিল্পটি ‘অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে ঘোষিত হয়েছে আমাদের ‘পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-২০২১’-এর সংযোজনীতে। ১৯৯৭ সালের বিধিমালায় শুধুমাত্র কাপড় রং করার রাসায়নিক প্রক্রিয়াটি লাল তালিকায় ছিল। ‘ওয়াশিং’ কারখানাগুলো ছিল ‘কমলা’ বা কম ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায়। নতুন বিধিমালায় ‘অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ’ বা ‘লাল’ তালিকায় যুক্ত হয়েছে টেক্সটাইল খাতের সমন্বিত প্রাকৃতিক ও সিনথেটিক টেক্সটাইল মিলগুলো (স্পিনিং, উইভিং, ডায়িং, ফিনিশিং), টেক্সটাইল ডায়িং কারখানা (দৈনিক উৎপাদন ২৫ টনের বেশি হলে) এবং ওয়াশিং কারখানা (দৈনিক উৎপাদন ২৫ টনের বেশি হলে)। বিধিতে বলা হয়েছে, বস্ত্র শিল্পের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পেতে হলে লাল তালিকায় বর্ণিত শর্তগুলো মেনে চলতে হবে। কিন্তু এই কাগুজে বাঘ দূষণ-সিংহকে কতখানি ঠেকিয়ে রাখতে পারবে, তা সময়ই বলে দেবে! বলতে কি, যেখানে ছাড়পত্র ছাড়াই হেসে-খেলে জীবন ধারণ করা যায়, সেখানে লাল রোগের শর্তগুলো মানতে যেন বয়েই গেছে বাঘা বাঘা গার্মেন্টস কারখানাগুলোর!
একজন পশ্চিমা নাগরিক যখন অফিসের পথে হাঁটতে থাকেন, কখনো কি তার মাথায় প্রশ্ন উদ্রেক করে, কী অঢেল পানিসম্পদ ব্যয়িত হয় তার ট্রাউজারটি ধৌত ও রং করার কাজে? ইন্টারন্যাশনাল ফাইনান্স কর্পোরেশানের একটি সমীক্ষা বলছে, প্রতি বছর গার্মেন্টস শিল্পের সুতো ও কাপড় রং এবং ধৌত করার কাজে ১৫০০ বিলিয়ন লিটার পানি ব্যবহৃত হয় বাংলাদেশে–এটি সেই পরিমাণ তরল যা দিয়ে ৬,০০,০০০ অলিম্পিক সুইমিংপুলকে ভরে দেয়া যায়, বা, ৮,০০,০০০ মানুষের সারা বছরের পানির কাজ নির্বিঘ্নে চলে যায়! আমরা যে জিন্স প্রতিদিন পাদুটোর উপর চেপে রাখি, তার ওজন প্রায় ১ কেজি, আর এইটুকু পোশাককে ধৌতকরণে খোয়াতে হয় প্রায় ২৫০ লিটার পানি। আর এ হচ্ছে মিষ্টি পানি, ভূগর্ভস্থ চ্যানেল থেকে যা পাম্প করে বের করা হয়। পানির টেবিল কিন্তু অসীম নয়; প্রতিবছর ২.৫ শতাংশ নেমে যাচ্ছে। আমাদের ভূগর্ভস্থ পানির চ্যানেলগুলো এভাবে ক্রমেই রিক্ত হচ্ছে পোশাক দৈত্যের খাবার যোগন দিতে গিয়ে, আর পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দেবে যাওয়ার ঝুঁকিসম্পন্ন একটি ভূত্বক অবশিষ্ট রেখে যাচ্ছে!
বাস্তবতা হলো, উন্নত বিশ্ব এই অল্প সম্পদও খোয়াতে রাজি নয়, তাই বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে পোশাক শিল্পের এই ‘নেসেসারি ইভিল’ যজ্ঞটিকে। আর আমরাও কানা খোঁড়ার মত উজাড় করে চলেছি আমাদের সম্পদ, কারণ এই পথের বাঁক বা খানা-খন্দগুলো তো আমাদের চেনা নেই। এই যে আধুনিক শিল্পবাদ, যা গণ বা ব্যাপক উৎপাদনের (মাস প্রোডাকশান) থিয়োরি মেনে চলে, তা কখনো আমাদের নিজস্ব ছিল না। আমাদের ছিল ঘরে ঘরে উৎপাদন যাকে মহাত্মা গান্ধী বলতেন ‘প্রোডাকশান বাই মাস পিপল’।
গান্ধীজী শিল্পবাদ নামক পাপকে মোচনের উপায় হিসেবে দুটো ব্যবস্থাপত্র দিয়ে গেছেন বিশ্ববাসীর জন্য–বিকেন্দ্রীকরণ ও স্বাবলম্বন। এ যেন এক নতুন শিল্পবিপ্লব যেখানে প্রতিটি দেশ খাদ্য ও বস্ত্রের ন্যায় মৌলিক প্রয়োজনগুলো মেটাবে সম্পূর্ণ নিজেদের গড়ে তোলা কারখানা দিয়ে যেখানে বিদেশ থেকে কোন কাঁচামাল আসবে না, আর বিদেশে কোন ফিনিশড প্রডাক্ট রপ্তানি হবে না। এভাবে সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়বে এক আত্মনির্ভরশীল শিল্পের রূপকথা। মানবতাবাদী পণ্ডিত আলডুস হাক্সলির মতে, “উত্তম সমাজ রচনার জন্য রাজনৈতিক পন্থা হচ্ছে বিকেন্দ্রীরকরণ, তথা দায়িত্বশীল শাসনের পথ।“ গান্ধীও চাইতেন, মানুষ যেমন আপন পায়ের উপর ভর করে চলে, তেমনি সমাজও হবে স্বয়ংক্রিয় ও আত্মনির্ভরশীল। হ্যা, আমদানি-রপ্তানি থাকবে, কিন্তু তা থাকবে মৌল প্রয়োজনীয় বস্তুগুলোর বাইরের বস্তুর জন্য।
কিন্তু কোথায় দাঁড়িয়ে আমাদের সেইসব দেশজ শিল্প? তাদের কারিগরেরা কই এখন? কোথায় আমাদের কুটির শিল্প একেকটি পরিবার যাকে কেন্দ্র করে স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারতো? আমাদের গৌরবময় ঐতিহ্য ছিল কাঁসারি, শাঁখারি, মালাকার, কুম্ভকার, ছুঁতার শিল্পে । আমাদের বস্ত্র শিল্পে ছিল তাঁতি যারা সূক্ষ্ম সুতোর বা রেশমের কাপড় বুনতে পারত; ছিল জোলা ও যোগী যারা গামছা, লুঙ্গি, মশারি বানাত; ছিল আর এক শ্রেণীর বস্ত্রশিল্পী যারা কাঠির সাহায্যে ভেড়ার লোমের কম্বল, নারিকেলের দড়ির পাপোশ, কার্পেট, শতরঞ্জি বানাতে পারত। আমাদের ছিল শর্করা শিল্প যা যোগান দিত খেজুরের গুড়, তালের পাটালি, মিছরি। এই শিল্পের উৎপাদিত ঝোলাগুড় থেকে ভালো সার হতো। এক কালে ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর গ্রামে লক্ষাধিক মণ চিনি প্রস্তুত হতো। আমাদের ছিল গৌরবময় ধাতু শিল্প যা ঘিরে থাকতো স্যাকরা, কামার দিয়ে। যশোরের কামারবাগে তিনশ ঘর কামার ছিল যারা যুদ্ধাস্ত্র বানাতে পারত। সেই সময়টাতে লোহার অস্ত্রের জন্য বিদেশের উপর নির্ভর করতে হতো না আমাদের। আমাদের ছিল মৃৎশিল্প যা জন্ম দিয়েছিল কুম্ভকাররা, যারা হাঁড়ি-পাতিল নির্মাণ করত; আর ছিল পাল শিল্পী যাদের হাতের কোমল ছোঁয়ায় নির্মিত হত মূর্তি, টালি। বিক্রমপুরের আড়িয়লে ছিল কাগজ শিল্প। আমাদের ছিল গৌরবময় দারু শিল্প; বিক্রমপুরের মাটির নিচে যার বহু নিদর্শন মিলেছে। কাঠের মূর্তি, নৌকা, চেয়ার, টেবিল, গরুর চাকা ইত্যাদি ছিল এই শিল্পের ভাস্কর্য! আমাদের চর্ম শিল্প, কারু শিল্প, মিষ্টি, হুঁকো, ছাতার বাট তৈরির শিল্প ছিল। ছিল পাটি, বাঁশ, বেত, শোলার জিনিস তৈরির শিল্প। ফরিদপুরের সাতৈর নামক স্থানে এমন মিহি পাটি তৈরি হতো যার উপর দিয়ে এমনকি সাপের পক্ষে চলা অসম্ভব ছিল বলে কথিত আছে। একটা ছোট বাঁশের চোঙ্গার মধ্যে ছয় হাত লম্বা চার হাত চওড়া শীতল পাটি পুরে দেয়া যেত।এই শিল্পগুলো নেই এখন, এদের কঙ্কাল আছে শুধু।