আমরা ক্রমান্বয়ে প্রকৃতির এসব চিহ্ন থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। ঋতুর অদলবদল এবং ঐতিহাসিক ব্যাকরণ ধরতে পারছি না। তৈরি হচ্ছে বর্ষ বিদায় ও বর্ষ বরণের এক অপরিচিত নয়া ভাষিক তল।
Published : 13 Apr 2024, 04:01 PM
ষড়ঋতুর বাংলাদেশ আজ কত ঋতুর দেশ এটি এক দীর্ঘ তর্কের তল। ষড়ঋতুর দেশ হিসেবে পরিচয় মুছতে থাকলেও কোনো কোনো ঋতু এখনও বেশ জানান দিয়েই আসা-যাওয়া করে। প্রকৃতি যেমন সাজ বদল করে, তেমনই উৎসব আর মেলার আয়োজনে একেক ঋতু সাজে একেকভাবে। অঞ্চল এবং জাতিভেদেও ঋতুভিত্তিক আচার আর রীতিগুলোও ভিন্ন ভিন্ন।
বারো মাসে তের পার্বণের বাংলাদেশে বর্ষ বরণ ও বর্ষ বিদায়ের কৃত্য-আচারগুলো সকলক্ষেত্রেই উৎসমুখরতা তৈরি করে। পাশাপাশি বর্ষ বিদায় ও বর্ষ বরণকে ঘিরে দেশের নানানপ্রান্তে আয়োজিত হয় চৈত্রসংক্রান্তি, গাজন, চড়ক ও বৈশাখীমেলা। বাংলা বছরকে ঘিরে বাঙালি সমাজে চৈত্রসংক্রান্তি, হালখাতা, নববর্ষ যেমন বাংলার জনউৎসব তেমনি দেশের আদিবাসী সমাজে বর্ষ বিদায় ও বরণের কৃত্যসমূহও জনউৎসবে রূপ নেয়।
অঞ্চল ও জাতিভেদে বর্ষ বিদায় ও বরণ উৎসবের নামগুলোও ভিন্ন ভিন্ন। সমতলের কোচ ও হাজং আদিবাসীরা বর্ষ বিদায় ও বরণ উৎসবকে ‘বিহু’ বলে। ভাওয়াল ও মধুপুরগড়ের বর্মণ ও কোচ আদিবাসীরা সন্ন্যাসীপূজা, গাজন, চড়কপূজার মাধ্যমে চৈত্রসংক্রান্তি পালন করে। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা এ উৎসবকে বলে বিষু। সিলেট অঞ্চলের চা বাগানের আদিবাসীদের অনেকেই এসময় পালন করেন দন্ডবর্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমারা বর্ষ বিদায় ও বরণের এ উৎসবকে বলে বিজু। মারমারা বলে সাংগ্রাই। রাখাইনদের ভাষায় সাংগ্রেং। ত্রিপুরারা বলেন বৈসু বা বৈসুক কোথাও বুইসুক। গুর্খা ও অহমিয়ারা বলে বিহু। তঞ্চঙ্গ্যারা বলে বিষু। ম্রোরা এ উৎসবের নাম দিয়েছেন চানক্রান। চাক আদিবাসীরা এ উৎসবকে বলেন সাংগ্রাইং। খিয়াং আদিবাসীদের অনেকেই এ উৎসবকে সাংলান বলে থাকে।
প্রতিটি ঋতু বেশ কিছু নির্দেশনা নিয়ে আসে। প্রকৃতির নির্দেশনা। ফুল-পাতা-ফল কী শস্য, পতঙ্গের বিস্তার, মাটির রং, পাখির ডাক, জলের তরঙ্গ সব কিছুতেই থাকে সেই নির্দেশনা। সমতল কী পাহাড়, অরণ্য কী গড়, বরেন্দ্র কী চর, উপকূল কী দ্বীপে এসব নির্দেশনা নানা ব্যঞ্জনায় মূর্ত হয়ে ওঠে। গ্রামীণ নিম্নবর্গ হাজার বছর ধরে প্রকৃতির এসব নির্দেশনা মান্য করেছে, করে তুলেছে জীবনের আরাধ্য। তৈরি করেছে কৃত্য, বিকশিত হয়েছে উৎসব।
বর্ষ বিদায় ও বর্ষ বরণের জনকৃত্যগুলোও প্রকৃতির নির্দেশনাকে পাঠ করেই বিকশিত। ফাল্গুনে ভাঁট, শাল, মহুয়া, মিষ্টিকুমড়া, বিলিম্বি, ভেন্না, আমরুল, নাগেশ্বর, পলাশ, কাঁঠালচাঁপা, দোলনচাঁপা, কনকচাঁপা ফুটে। প্রকৃতি জানান দেয় বসন্ত ঋতু এসেছে। যদিও আজকাল বর্ষ বিদায়ের চাইতেও বর্ষ বরণ হয়ে উঠেছে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ উৎসব।
দেশের অপরাপর জাতিসমূহের কৃত্যমুখরতাকে ঢেকে তৈরি হয়েছে এক বাঙালি জাত্যাভিমান। তৈরি হয়েছে নানা কর্পোরেট ঔপনিবেশিক ব্যঞ্জনা। একতরফা কিছু চিহ্নের ভেতর দিয়ে ঢেকে ফেলা হচ্ছে হাজার বছরের ঐতিহাসিক চিহ্নময়তা। বর্ষ বরণ ওঠেছে কেবলি হালখাতা, পান্তা-ইলিশ, সাদা-লাল কাপড়ের এক বৈচিত্র্যবিমুখ শহুরে জমায়েত। ঋতুর প্রতি কৃতজ্ঞতা কী নতজানু প্রবৃত্তি হারিয়ে গেছে। প্রকৃতির চিহ্নের প্রতি দায় ও দায়িত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ওঠেছে এক নতুন প্রজন্ম। চলতি আলাপখানি বর্ষ বিদায় ও বর্ষ বরণ ঘিরে প্রকৃতির সেইসব চিহ্নের প্রতি দরদ নিয়ে আগলে ওঠার আহবান জানায় বাংলাদেশকে।
তিতা শাক
প্রকৃতিতে তিতা-জাতীয় শাকের উপস্থিতি জানান দেয় চৈত্র মাস শেষ হয়ে যাচ্ছে, বৈশাখ সমাগত। এটি বর্ষ বিদায় ও বর্ষ বরণের সন্ধিস্থলের এক অনন্য চিহ্ন। তিতাশাক ছাড়া বাঙালি কী আদিবাসী সমাজে বর্ষ বিদায় কৃত্য হয় না। নিম, গিমা, নাইল্যা, দন্ডকলস, আমরুল, থানকুনি, নিশিন্দা, তেলাকুচা, মালঞ্চ, কানশিরা এ রকমের ১৩ থেকে ২৯ রকমের তিতা স্বাদের শাক খাওয়ার চল আছে দেশের নানা জনপদে। সিলেট অঞ্চলে চৌদ্দ শাক খাওয়ার প্রচলন। আদিবাসী বেদিয়া-মাহাতোরা চৈত্রসংক্রান্তির দিন বথুয়া, কাঁটাখুঁড়ে, গিমাসহ নানান জাতের তিতাশাক খায়।
বেগুন পাতার বর্ত
সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ৭টি জেলায় বিস্তৃত হাওরাঞ্চল দেশের ছয়ভাগের এক ভাগ। আর এ জনপদে বর্ষ বিদায় ও বরণের পরবখানি জুড়ে আছে বেগুন পাতার বর্ত।
বেগুন শুধুমাত্র মানুষ বা পতঙ্গ প্রাণীর খাদ্যই নয়। বেগুনকে ভাটি জনপদে প্রকৃতির নির্দেশনাকে আরাধনার জন্য পবিত্র জীবন্ত স্বাক্ষী হিসেবেও মান্য করা হয়। বেগুন পাতাকে স্বাক্ষী রেখেই নতুন অন্ন-ব্যঞ্জন রান্না করে বেগুন পাতাতেই তা প্রকৃতির কাছে উৎসর্গ করা হয়। চইত পরবে বর্তের আগ পর্যন্ত বাড়ির নারীরা উপবাস থাকেন। ভোর রাতে ওঠে বাড়ি ঘর লেপামোছা করতে হয়। বেগুন পাতার বর্তের জন্য বাড়ির বিছরাক্ষেতের (আঙ্গিনা বাগান) বেগুন গাছ থেকে ৫ থেকে ১৩টি পাতা সংগ্রহ করা হয়। পাতাগুলো ধুয়ে ১৩টি পাতায় ১৩ জাতের তরিতরকারি রান্না করে ভাতসহ দেয়া হয়। এ বর্তে সবরি আম, কাঁঠাল, কলা, আম, মনকাঁটা, ডেফল, জাম্বুরা, ভুবি, কয়ফল, লেবু, জাম, লিচু, নেওয়া, আতাফল— এরকম ১৩ জাতের দেশি ফল লাগে। গিমাই, নাইল্যা, ডেঙ্গা, লাল ডেঙ্গা, পালং, ঠুনিমানকুনি, দন্ডকলস, হেলেঞ্চা শাক রান্না করা হয়। ঘরের মইধ্যম পালার (হাওরাঞ্চলে বাঙালি সনাতন হিন্দুদের ঘরের ভেতরের বাঁশ বা কাঠ নির্মিত থাম, এটি পবিত্রস্থল) কাছে একটি মাটির ঘট বসানো হয়। বেগুন পাতাগুলো ঘটের কাছে ও মইধ্যমপালায় রাখা হয়। তারপর উপবাসীবর্তী নারীরা বেগুন পাতা বর্তের কিচ্ছা বয়ান করেন। কিচ্ছা শেষে উপবাসী নারীরা ঘটের কাছে দেয়া ভোগ থেকে ফল ফলাদি খেয়ে উপবাস ভাঙেন এবং সকলের মাঝে প্রসাদ বিলিয়ে দেন। বর্ত শেষে বেগুন পাতাগুলো নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়া হয়। এভাবেই বেগুন পাতা বর্তের ভেতর দিয়ে হাওরাঞ্চল একটি বছরকে বিদায় জানায় এবং প্রকৃতির সংকেত গুলোকে আগলে নতুন বছরকে আহবান জানায়। প্রকৃতির নতুন শস্য লতাগুল্ম গ্রহণের জন্য সামাজিকভাবে চইত পরব কৃত্যের মাধ্যমে অনুমতি নেয়।
বেগুন পাতার বর্তের কিচ্ছাটি সাধারনত: নারীরাই বংশ থেকে বংশে মৌখিক ধারায় জীবন্ত রেখে চলেছেন। কিচ্ছাটি সংক্ষেপে এমন: এক বামনী তার ছোট মেয়ে রেখে মারা যায়। ছোট মেয়ে নানা সময় নানা বায়না ধরে। মেয়ে একদিন বায়না ধরে গাঙ্গে স্নান করবে। বাড়ি থেকে দূরে নদী। বাধ্য হয়ে বামন মেয়েকে গাঙ্গে নিয়ে যায়। গাঙ্গে ভেসে যাচ্ছিল এক রামকলার ছুব (আগপাতা)। মেয়ে বায়না ধরে ওই ছুব তার চাই। বামন বাড়ি এসে নল ও শণ ঘাস এনে দড়ি বানিয়ে ওই ছুব মেয়েকে দেয়। বাড়ি এসে ছোট মেয়ে ওই কলাপাতায় ভাত খায়। এভাবে তার গর্ভ হয়ে যায়। গ্রামের মানুষ নানা কথা বলে। রাজা বামনকে ডেকে নেয়। বামন সবকিছু খুলে বলে। রাজা মেয়েকে কারাগারে বন্দি করে। রাতে রাজা স্বপ্নে দেখে ওই মেয়ের গর্ভে ভাটির পাঁচ দেবতা জন্ম নিয়েছে। চইত, ভাটি, ষষ্ঠী, করমাদি আর শ্রাবণী। পাঁচ মাসের পাঁচ দেবতা। রাজা স্বপ্নে দেখে মেয়েটির কানি আঙুল কেটে দিলেই সব দেবতা মুক্ত হবে, জন্ম নেবে। এভাবে কানি আঙুল কেটে দেবতাদের মুক্ত করা হয়। তারপর ভাটি অঞ্চলে পাঁচ মাসে পাঁচ দেবতার জন্য আলাদা কৃত্যের আয়োজন হয়।
কাঁচা আম
গাছে গাছে গুটি আম বেশ পুষ্ট হয়ে ওঠে এ সময়। দেশের নানা প্রান্তে কাঁচা আম বর্ষ বিদায় ও বর্ষ বরণের কৃত্যে প্রথম গ্রহণ করা হয়। বাৎসরকি আম খাওয়ার অনুমতি নেয়া হয় প্রকৃতির কাছে। রবিদাসদের ভেতর হাজরা-কৃত্যের মাধ্যমে বর্ষ বিদায় পালিত হয়। এদিন যবের ছাতু ও কাঁচা আম একত্রে মিশিয়ে আম-ছাতুয়া খাওয়া হয়। মৌসুমি ফল আমকে বর্ষ বিদায়ের এ রীতির ভেতর দিয়েই সমাজ গ্রহণ করে। বছরের প্রথম দিন ঘরের দেওকুড়ি নামের পবিত্রস্থলে কর্মের পূজা করা হয়। রবিদাসদের ভেতর যে যে কর্মপেশায় জড়িত তারা সেই কর্মের সাথে জড়িত আনুষঙ্গিক উপকরণগুলি দেওকুড়িতে রাখে। হাতুড়ি, কোদাল, শাবল, কাঁচি, ছুরি, বাটাল যার কর্মে যা লাগে সব। এ সময় ঢোল, খাজরি, ঝাল বাজানো হয়। রবিদাসদের ভেতর এসময় বাইশাখী পূজাও পালিত হয়।
শাল-মহুয়া
শাল-মহুয়াও প্রকৃতিতে বর্ষ বিদায় ও বর্ষ বরণের চিহ্ন নিয়ে আসে। সাঁওতালি ভাষায় মাস বলতে বঙ্গা, চাঁন্দো শব্দ গুলির চল আছে। ফৗগুন (ফাল্গুন) মাস থেকেই শুরু হয় সাঁওতালি বর্ষ। বর্ষ বিদায় ও বরণের উৎসব বাহাও পালিত হয় এ মাসেই। এ সময় গাছে গাছে সারজম, ইচৗক, মুরুপ্ আর মহুয়া ফুল ফোটে। বাহা পরবের ভেতর দিয়েই সাঁওতাল সমাজ এসব ফুলের মধু পান ও ব্যবহারের অনুমতি প্রার্থনা করে প্রকৃতির কাছে। বাহার আগে এসব ফুলের ব্যবহার সামাজিকভাবে নিষেধ।
বিজু ফুল
বর্ষ বিদায় ও বর্ষ বরণ ঘিরে আয়োজিত বিজুই চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের সবচেয়ে বড় পরিসরের সামাজিক উৎসব । ফুল বিজু, মূল বিজু ও গয্যাপয্যা দিন এ তিন পর্বে বিভক্ত বিজুর শুরু হয় বাংলা চৈত্র মাসের ২৯ তারিখ। পাহাড়-টিলা-বন ও গ্রাম ঘুরে ঘুরে এদিনে শিশু, কিশোর ও বালিকারা সংগ্রহ করেন নানান পদের ফুল। ভাতজরা ফুল বা বেইফুল ছাড়া বিজু জমে না। ভাতজরা ফুল বিজুর সময়ে ফুটে বলে অনেকে একে বিজুফুলও বলে।
কাইনকো
কাইকনো বা নাগেশ্বর ফুলও দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে কোনো কোনো জনগোষ্ঠীর ভেতর বর্ষ বিদায় ও বরণের প্রকৃতির চিহ্ন। বর্ষ বরণের উৎসব সাংগ্রাইংয়ের প্রথমদিনকে বান্দরবানের চাক আদিবাসীরা বলেন পাইংছোয়েত বা ফুল দিন। চাকরা সাংগ্রাইংয়ের সময় কাইনকো বা নাগেশ্বর ফুল সংগ্রহে মুখরিত হয়ে ওঠেন। পাইংছোয়েতর দিন গ্রামে গ্রামে আয়োজিত হয় পেকো (গিলা), গ্যাং (লাটিম), মাইকানিকছা (কানামাছি) নামের নানান চাক খেলা। সাংগ্রাইংয়ের দ্বিতীয় দিন হলো আক্যাই। এদিনে পাড়ার যুবসম্প্রদায় বাইক (ঢোল), লাংহোয়াক (ঝাঁঝ) ও হ্নে (বাঁশী) বাজিয়ে ক্যাং বা বৌদ্ধমন্দিরে যায় আর্শীবাদ গ্রহণের জন্য। সাংগ্রাইংয়ের শেষ দিনকে চাকরা বলেন আপ্যাইং।
চড়ক গাছ ও গাজনের দল
চৈত্র সংক্রন্তির এক অনবদ্য চিহ্ন হলো গ্রামাঞ্চলে গুড়ে বেড়ানো গাজন বা চড়কের দল। লাল সালু কাপড় পরিধান করে এবং শিব-গৌরি সেজে, কেউবা মুখোশ চাপিয়ে মাগন সংগ্রহ করেন। পামাপাশি দেশের নানাপ্রান্তে নানা আয়োজনে চড়ক পূজার চড়ক গাছ এবং নীল কাঠও এক অনন্য চিহ্ন।
গ্রামীণ মেলা
চৈত্র সংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখে গ্রাম জনপদের আদি মেলাগুলোও এক ধরনের জনচিহ্ন। বর্ষ বিদায় ও বর্ষ বরণকে ঘিরে মূলত চৈত্রসংক্রান্তিতেই গ্রামজনপদে মেলা আয়োজনের আদি চল। গাজীপুর, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ দেশের নানাপ্রান্তে যেখানেই চড়কপূজা আয়োজিত হয় সেখানেই এখনও মেলার আয়োজন ঘটে। কোথাও কোথাও মেলা চলে বৈশাখের শেষপর্যন্ত। এমনই একটি মেলা হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ‘ভাদুঘরের বান্নি’। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শহরতলীর গ্রাম ভাদুঘরে তিতাস নদীর তীরে বৈশাখের ১৪ তারিখে হয় এই মেলাটি।
চাবাগান এলাকাগুলোতে এসব মেলার আয়োজন স্থানিক এবং স্বতস্ফূর্ত। এসব মেলা কোনো কোনোটি একদিন স্থায়ী হয়, কোনোটি চলে দিনকয়েক, কোনোটিবা পনের দিন কী একমাস। তবে চলতি সময়ে বর্ষ বিদায় ও বরণ ঘিরে আয়োজিত মেলাগুলোর স্থায়িত্ব খুব কম এলাকায় এক মাস গড়ায়। অঞ্চলভেদে এসব মেলায় আগে ভিন্ন ভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী, ফলফলাদি, বীজ, পঞ্জিকা পাওয়া গেলেও এখন দেশের প্রায় সব এলাকার মেলাই একাকার হয়ে গেছে। এ যেন বহুজাতিক বিশ্বায়িত দুনিয়ার বাণিজ্য বাহাদুরি।
আমরা ক্রমান্বয়ে প্রকৃতির এসব চিহ্ন থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। ঋতুর অদলবদল এবং ঐতিহাসিক ব্যাকরণ ধরতে পারছি না। তৈরি হচ্ছে বর্ষ বিদায় ও বর্ষ বরণের এক অপরিচিত নয়া ভাষিক তল এবং নানা অধিপতি চিহ্নের বাহাদুরি। দেশের নিম্নবর্গের হাজার বছরের চিহ্নের ওপর এ এক প্রশ্নহীন ঔপনিবেশিক আঘাত। প্রকৃতির নির্দেশনা ও চিহ্নের প্রতি নতজানু হওয়া ছাড়া কোনোভাবেই বর্ষ বিদায় ও বরণের কোনো মৌলিক বিকাশ সম্ভব নয়। এই প্রবণতা পণ্যমুখী এক কর্পোরেট বাজারের দিকেই মানুষকে চেপে ধরে আর বেসামাল করে তুলে। নতুন বছরে দেশের সকল প্রান্তে টিকে থাকা ও লড়াই করে যাওয়া প্রকৃতির সকল চিহ্ন সুরক্ষায় আহবান আবারো সকলের প্রতি। আসুন নতজানু হই, আগলে বাঁচি সকল আড়াল ছিন্ন করে।