দেশের বাইরের সাম্প্রতিক উত্তপ্ত পরিবেশ সবার চোখে পড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাংলাদেশীদের জন্য এটা উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগের সময়। আমি কোনো রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখছি না। কারণ এর সঙ্গে দেশ ও দেশের ভাবমূর্তি জড়িত। কে বা কোন দল দেশ শাসন করছে আর কে বা কারা বিরোধী দলে আছে, সেটা এ আলোচনায় আপেক্ষিক বিষয়। কারণ সবার ওপরে দেশ। দেশের সম্মান যখন ভূপাতিত বা প্রশ্নের মুখে পড়ে, তখন নাগরিক হিসেবে বা দ্বৈত নাগরিক হিসবেও আমাদের আবেগ অনুভূতি আহত হয় বৈকি। প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সফরকে ঘিরে যে উত্তেজনা তার জন্য কেবল বিরোধীদের দায়ী করলে এই সমস্যার সমাধান মিলবে না।
আমরা বিদেশে বসবাস করার কারণে খুব ভালো করে জানি বাংলাদেশীরা কতটা পরিশ্রমী। কতটা খাটেন তারা, কিভাবে কষ্ট করে জীবনযাপন করেন, দূর থেকে আরাম-আয়েশের জীবন মনে হলেও প্রবাসীর দিন কাটে ভীষণ কষ্টে। নিজের কাজ নিজে করার সমাজে মানুষকে পরিশ্রম করতে হয় ব্যাপক। এই পরিশ্রমী মানুষজন কেন মারমুখো হলো? কেন তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল? এর উত্তর খোঁজা কঠিন কিছু নয়। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষ প্রতিবাদ করে। তাদের আচরণ যদি অস্বাভাবিক হয়ে যায় বা অন্যায়ের পথ ধরে তখন আমরা বিস্মিত হবার পাশাপাশি হতাশায় ভুগি। যা ঘটেছে বা যা কিছু হয়েছে, তাকে আমলে নিয়ে এর একটা দীর্ঘমেয়াদী সুরাহা এখন জরুরি ।
কথায় কথায় আমরা পাকিস্তানিদের মাথা গরম, উগ্র বলে রায় দেই। এই পাকিস্তানিরাও তাদের সরকার প্রধানের বিরুদ্ধে প্রবাসে এমনটা করেন বলে শুনিনি, ভারতীয়রা তো নয়ই। কারণ দেশের মৌলিক সমস্যা আর ভাবমূর্তির বেলায় তারা এক। স্বাধীনতার এত বছর পর ও আমাদের জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠেনি। মৌলিক বিষয়ে মতভেদ এতটাই প্রকট যে বাংলাদেশীদের জাতীয় অস্তিত্বই এখন ভয়াবহভাবে আক্রান্ত। এটা সুখের কিছু নয়।বাদ-প্রতিবাদ বিদ্রোহ মানুষের অধিকার। তা করতে গিয়ে যখন পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে যায় তখন উভয়ের সহনশীলতা কাম্য । কাম্য আচরণে শিষ্টতা। সেটা আমরা দেখিনি। সরকারি বা বিরোধী দলের কেউ মনে রাখেননি যে এর ফলে আমাদের দেশের সম্মান পড়বে সংকটে ।
বলাবাহুল্য এই সংকটের সমাধান দেশে। আমরা আওয়ামী লীগ বা বিএনপি এই দুই দলে বিভক্ত রাজনীতির শিকার । অথচ এমন কথা ছিল না। কথা ছিল আমাদের রাজনীতি যাই হোক যে দলে বিভক্ত হোক জাতির সম্মান বিষয়ে থাকবে সমঝোতা। সে জায়গাটি থাকেনি বা রাখা হয়নি। আলাপ-আলোচনার দিনকাল বহু আগেই বিগত।এখন হিংসা আর প্রতিহিংসার শিকারে পরিণত হয়েছে জাতি। কে দায়ী, কারা এর জন্য দায় নেবে, জানি না। কিন্তু নিতে হবে। নেবার সময় বইয়ে গেলে আখেরে দুর্ভোগ আরো বাড়বে। আমি আগেও লিখেছি রাজনৈতিক দলগুলোর বিদেশি শাখা-প্রশাখা বিস্তারের জন্য দায়ী দেশের নেতারা। দেশীয় গডফাদারদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বিদেশে উত্তাপ ছড়ানো সরকারি বা বিরোধী দলের নেতা-উপনেতারা মনে রাখেন না এতে দেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। খোঁজা দরকার কারা এসব উপদলগুলোকে আশ্রয় দেন। প্রবাসী এসব নেতা-উপনেতাদের পালে হাওয়া দেন তাদের গড ফাদাররা। সে কাল সাপ এখন ফণা তুলছে। যারা বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী তাদের যুক্তি দেশে কথা বলতে দেয়া হচ্ছে না। আর যারা সরকারি দল করেন, তাদের তো যুক্তির অভাব নেই। এসব যুক্তি-তর্ক যে অসার তা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট ।
আমাদের স্বাধীনতার বয়স কম নয়। ৫০ বছর পর একটি দেশে এতো বিভক্তি কেন? এর সহজ উত্তর সমাধানহীন রাজনীতি। কেউ কাউকে সহ্য না করার রাজনীতি । এর অবসান হবে কি ভাবে? নিশ্চিতভাবে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক সমাজ আর নির্বাচনের ন্যায্যতা এর একটা বিহিত করতে পারে ।কিন্তু তা কি আদৌ আছে? যখন কথা বলা প্রায় নিষিদ্ধ বা বললেও ভেবেচিন্তে বলতে হয়, তখন মানুষের মনে যে মেঘ জমে সেটাই হয়তো অশনি সংকেত হয়ে দেখা দেয়। আজকে দেশে নানাভাবে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও বাইরের মুক্ত সমাজে তার নিয়ন্ত্রণ যে কঠিন সেটাই দেখা গেল। এই মারমুখি বাংলাদেশীদের দেখে অন্যেরা কি ভাববে? আমাদের উপমহাদেশের প্রতিবেশীরা এমনিতেই আমাদের প্রবাসে আমাদের রাজনৈতিক দল নির্ভরতা নিয়ে হাসাহাসি করে। কারণ দেশের বাইরে আমি কোন ভারতীয় কংগ্রেস বা পাকিস্তানের মুসলিম লীগ দেখিনি। তারা যদি রাজনীতি করেন তো বসবাসরত দেশের মূল দলগুলোর রাজনীতি করেন। এতে লাভ হয় দেশের। লাভ হয় দেশের জনগণের ।এরা যদি এমপি হতে পারেন তো সংসদে গিয়ে নিজ নিজ দেশের কথা তুলে ধরেন। একসময় তারা শীর্ষ পদে চলে যায়। বৃটেনের ঋষি সুনকই তার উজ্জ্বল উদাহরণ। আমাদের দেশের প্রবাসীদের মেধা থাকার পর ও আজ সে সম্ভাবনা শেষ হবার পথে।
আমরা আসলে কি চাই? আমারা যদি দেশের উন্নতি আর অগ্রগতি বিবেচনায় রাখি তাহলে এই বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হতে হবে । আর তা সম্ভব কেবল আলোচনা আর সহনীয় পরিবেশ বজায় রাখার মাধ্যমে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমেরিকায় সে কাজটি করার চেষ্টা করেছিলেন জেনেছি।বিরোধীদের আগ্রাসী মনোভাবের কারণ বোঝা কঠিন নয় । তাদের ভেতর যারা উগ্র তাদের বাদ দিলে বাকিদের কথা শুনতে হবে।তাদের রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে । সরকারি দলের ভয় কেন সেটা বোধগম্য হয় না মাঝে মাঝে । এতো উন্নয়ন এতো অর্জনের পর ও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেন বদলায় না? নির্বাচনের সময় এখন সামনে। এই সময়কালে যদি তারা একবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে মনে হয় পরিবেশ কিছুটা হলেও উন্নত হবে।
সত্যিকারের ভাবমূর্তি কখনো ভয়ভীতির ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। বহু দেশে আমাদের চাইতেও সংঘাতপূর্ণ রাজনীতি বিরাজমান। এরপরও তারা দেশের বাইরে এমন সব কাণ্ড করে না যা দেশের মুখ ম্লান করে দেয় । আমাদের জাতীয় সংগীতের শেষ লাইনটি হচ্ছে, তোমার বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি। দেশ ও দেশের বাইরের মানুষদের নয়নজলে ভাসিয়ে কোন রাজনীতিই টিকে থাকতে পারে না। সেটা সরকারি বা বিরোধী দল উভয়ের জন্য সত্য ।