ঘুঘুডাঙ্গায় কড়াদের জমিতে ঘুঘু চড়ানো হচ্ছে

ঘুঘুডাঙ্গায় দিনাজপুরের স্বনামধন্য বেশ কয়েকটি চৌধুরী পরিবারের বসবাস আদি থেকে। সেই চৌধুরীদের মধ্যে কারও কারও উত্তরসূরিদের বিরুদ্ধে কড়াদের জমি নিজেদের নামে করে নেওয়া এবং দখলের অভিযোগ রয়েছে। মোল্লা পদবিধারী কিছু পরিবারের দিকে আছে একই অভিযোগের তীর। তারা ‘পেলে দুই বিঘে প্রস্থ ও দিঘে সমান হইবে টানা’— ভেবে কিনে নেওয়ার নাম করে দখল করে নিয়েছে কড়াদের জমিগুলো।

মুস্তাফিজুর রহমান রূপমমুস্তাফিজুর রহমান রূপম
Published : 18 April 2023, 03:02 PM
Updated : 18 April 2023, 03:02 PM

ঘুঘুডাঙ্গায় এক দশক আগেও ২০-২২টি কড়া পরিবার বাস করত। কমতে কমতে দুটি পরিবারে নেমে এসেছিল। এখন অবশ্য সেখানে আছে চারটি পরিবার। আদতে ওই দুটি পরিবার ভেঙে গত কিছুদিনের মধ্যে এই চারটি পরিবার হয়েছে। ভিটেয় ঘুঘু চড়ানো বাগধারাটি ছোটবেলায় পড়েছিলাম। ঘুঘুডাঙ্গায় এলে ওই কথাটি মনে পড়ে।

মাত্র কয়েক বছর আগে ছয়টি পরিবার ভারতে চলে গেছে ভিটেমাটি হারিয়ে। চারটি পরিবার ধর্মান্তরিত হয়েছে। ধর্মান্তরে স্বকীয়তা হারালেও জীবনমান খুব একটা উন্নত হয়েছে বলে বোধ হয় না। অবশিষ্ট পাঁচটি পরিবার অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নিয়েছে দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ঝিনাইকুড়ি গ্রামে। কারণ এই গ্রামটিতে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ কড়ারা। বাংলাদেশে সর্বসাকুল্যে টিকে থাকা ২৮টি কড়া পরিবারের মধ্যে ২৪টির ৯৪ জন মানুষ বাস করে এই ঝিনাইকুড়িতে। আর বাকি চারটি পরিবারের যাদের কথা এরই মধ্যে বললাম, তাদের ১১ জন নারী-পুরুষ ও শিশুর বাস দিনাজপুরেরই সদর উপজেলার আউলিয়াপুর ইউনিয়নের ঘুঘুডাঙ্গা গ্রামে।

দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ঝিনাইকুড়ি গ্রামের তরুণ লাপোল কড়া গত বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর ওই গ্রামের কড়াদের কথা বেশ আলোচনায় এসেছে। বিরলের কড়াদের কথা অবশ্য নৃতত্ত্বে আগ্রহী লেখক-সাংবাদিকরা আগে থাকতেই লিখেছেন, বিশেষ করে সালেক খোকন, রাজীব নূর, পাভেল পার্থ ও ফারহা তানজীম তিতিলের লেখায় বিচ্ছিন্নভাবে তাদের কথা পড়া হয়েছে অনেক মানুষের।

নিজে দিনাজপুরের সন্তান হলেও কড়াদের গ্রামে আমার যাতায়াত শুরু হয়েছিল এই মানুষগুলোর সঙ্গে। পরে অবশ্য বারবার গিয়েছি। লাপোলকে আমাদের উন্নয়ন সংস্থা ‘ভাবনা’য় রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলাম। লাপোল বাংলাদেশের কড়াদের মধ্যে প্রথমবার বিশ্ববিদ্যালয়ে চৌকাঠে পা রাখা একমাত্র শিক্ষার্থী। ঝিনাইকুড়িতে এখন ভাবনা পরিচালিত একটি বিকল্প শিক্ষাকেন্দ্রও আছে, যার নাম রাখা হয়েছে ‘কড়া পাঠশালা’। শুরুর পাঁচ মাস পাঠশালা ছিল একটি অস্থায়ী ঘরে। ২১ জন শিক্ষার্থী ও দুইজন শিক্ষক নিয়ে অস্থায়ী জায়গায় স্কুলটির কার্যক্রম শুরু হলেও এখন এটির স্থায়ী ঠিকানা হয়েছে লাপোলদেরই জমিতে।

কিন্তু আমাদের এতসব উদ্যোগ আয়োজনের অন্তরালে থেকে গিয়েছে ঘুঘুডাঙ্গার চারটি কড়া পরিবারের ১১ জন সদস্য। দিনাজপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে দিয়ে এশিয়ার সর্ববৃহৎ ঈদগাহ বলে পরিচিত গোর এ শহীদ ময়দানের পাশ দিয়ে প্রধান সড়কটি ঘাগড়া খালের (এখন খাল বলে পরিচিত হলেও একদা ঘাগড়া ছিল প্রবহমান নদী) ওপরের বড়পুল পার হয়ে পশ্চিমে বাঁক নিতে হয়। সেখান থেকে কিছু দূরেই শের-এ বাংলা ক্লাবের মোড় থেকে একটি রাস্তা দক্ষিণে সেন্ট ফিলিপস স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে দিয়ে কসবা উলিপুর হয়ে চলে গেছে ঘুঘুডাঙ্গায়। আঁকাবাঁকা সরু রাস্তাটি এক জায়গায় অনেক দূর পর্যন্ত পুনর্ভবা নদী, যা এখন কাঞ্চন নামে পরিচিত, তার পাশাপাশি এগিয়ে গেছে। নদী তীরে বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি, শরৎকালে কাশফুলে ছেয়ে যায়। নদীও এখানে দীর্ঘ বাঁক নিয়ে চলে গেছে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে। অবশ্য তার আগে গৌরীপুর গ্রামের কাছে এই নদীতে বছরদুয়েক হলো একটি স্লুইস গেট তৈরি করা হয়েছে। পথটি মূলত নদীর বাঁধের ওপর দিয়ে।

দিনাজপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে থেকে ঘুঘুডাঙ্গা বাজারের দূরত্ব ১০ কিলোমিটারের মতো। গৌরীপুরের দূরত্ব ১২ কিলোমিটার হবে। কোনো কোনো জায়গায় পথের দুইধারের বাঁশ ঝাড়, গাছপালা যেন মাথা নুইয়ে পথের ওপর সামিয়ানা বানিয়েছে। এই এলাকাটি দিনাজপুর সদরের রবিশস্যের ভাণ্ডার বলে পরিচিত। প্রচুর আলু এবং বিভিন্ন সবজি হয় এখানকার পলি মিশ্রিত বালু মাটিতে। অন্য সব সবজির ফলনও নেহায়েত মন্দ হয় না।

ঘুঘুডাঙ্গা বাজার থেকে বেশ ঢালু হয়ে আরও সরু পাকা রাস্তা কিছুদূর গিয়ে কাঁচা হয়ে পৌঁছেছে কড়াদের গ্রামে। গ্রাম বলতে চার পরিবারের বসবাস। পাশাপাশি দুটি বাঁশফোর পরিবারও বাস করে কড়াদের ঘরগুলোর একেবারে পাশেই নতুন টিন বাঁশ-কাঠের তৈরি ঘরে। বাঁশফোর সম্প্রদায়ের মানুষেরা বাঁশ দিয়ে ডালি, কুলা, খই চালনি ইত্যাদি সরঞ্জাম বানিয়ে থাকে। তারা পরিচ্ছন্ন কর্মীর কাজও করে। বাঁশের কাজ তথা বাঁশকে ফুঁড়ে (বুনে) গৃহস্থালি সরঞ্জাম তৈরির কাজ করে বলে তাদের এমন নাম হয়ে থাকতে পারে। বাঁশফোররা অনেক জায়গায় হরিজনদের সঙ্গেও বসবাস করে। তবে হরিজনরা তাদের নিজেদের সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ মনে করে না। দিনাজপুরে বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু বাঁশফোর সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে, সংখ্যায় তারা কড়াদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হলেও বাংলাদেশের ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’র তালিকায় নেই তাদের নাম।

কড়ারা সংখ্যায় কম হলেও সরকারের ওই তালিকায় নাম আছে তাদের। জাতিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের সবগুলো উপাদান আছে এই রকম সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে বোধহয় কড়ারাই সবচেয়ে কম। কড়া শব্দের অর্থ মাটি খোঁড়া। কোনোভাবে মাটি খোঁড়ার কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণেই এই আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠীর নাম ‘কড়া’ হয়েছে। ভারতের ঝাড়খণ্ডে কড়াদের বেশ কয়েকটি গ্রাম আছে বলে জানা যায়। বিরলের ঝিনাইকুড়ি গ্রামে কড়া ভাবনা প্রকল্পের কড়া পাঠশালার কারণে যাওয়া হয় মাঝে মাঝেই। গ্রামের মাহাতো মানে গোত্রপ্রধান যোগেন কড়া অনুরোধ করেন ঘুঘুডাঙ্গার কড়াদের কাছে যাওয়ার জন্য। নিজেরও এমন ইচ্ছে ছিল মনে মনে। প্রথমবার যাওয়া হয় গত বছরের ডিসেম্বরের ২২ তারিখের শীতের শেষ বিকেলে স্ত্রী-পুত্রসহ। কয়েকটি কম্বল উপহার দেওয়া হয় চারটি কড়া এবং দুটি বাঁশফোর পরিবারের মানুষদের। শীতের পড়ন্ত বিকেলে গ্রামজুড়ে যেন অদ্ভুত এক বিষণ্ণতার ছায়া ঘিরে ছিল সেদিন।

আমাদের দেখে আশেপাশের বাড়ির কয়েকজন মহিলা, শিশু এবং একজন বয়স্ক পুরুষ এগিয়ে এসেছেন কৌতূহলে। তারা মুসলিম। কড়া এবং বাঁশফোর পরিবারগুলো কম্বল উপহার পাওয়ায় তারা বেশ খুশি হলেন। বললেন, ‘ভালো হয়েছে ওরা অনেক কষ্টে থাকে।’ জানালেন কড়াদের এখানে অনেক জমি ছিল। আমবাগান, ফসলি জমি, বসতভিটা সবই। এখন চারটি কড়া পরিবার যে ভিটায় বসবাস করে সেটুকুও নাকি কাগজে-কলমে অন্যের জমি। ভিটায় আম, কাঁঠালের গাছ রয়েছে। জীর্ণ ঘরগুলোর সামনে নিকোনো উঠোনটা বড় বেশি চোখে পড়ে।

গত ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসের মধ্যাহ্নে আবার যাওয়া হয় ঘুঘুডাঙ্গায় কড়াদের কাছে। সঙ্গে বাল্যবন্ধু মামুন চৌধুরী। ঝিনাইকুড়ি কড়া গ্রামের মাহাতো যোগেন কড়ার মেয়ে কামিনী কড়া এগিয়ে এসে বলল, ‘জোহার’। জোহার শব্দটির শাব্দিক অর্থ আমার জানা নেই। কড়ারা সালাম-আদাবের প্রতিশব্দ হিসেবে এটি ব্যবহার করে।

কামিনীর বাবা যোগেন এই ঘুঘুডাঙ্গার সন্তান। ভিটেমাটি হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ঝিনাইকুড়িতে। ঝিনাইকুড়িরই এক তরুণের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল কামিনীর। তার ওই বরটি ভারতে চলে যাওয়ায় আবারও পারিবারিকভাবেই বিয়ে হয় ঘুঘুডাঙ্গায়।

কারও ঘর থেকে প্লাস্টিকের চেয়ার এনে আমাদের বসতে দেওয়া হয় আঙিনায় গাছের ছায়ায়। ডিসেম্বরের মতো এবারও ধারেকাছের মুসলিম পরিবারগুলোর কয়েকজন এগিয়ে আসেন। যাদের মধ্যে ক্র্যাচে ভর করে চলা বয়স্ক মানুষটির নাম মন্টু মিঞা। জানা গেল তিনি স্বাধীনতার আগে থেকেই এখানে বসবাস করেন। ষাটের দশকে এখানে কড়াদের ৩টি পাড়া ছিল। সব মিলিয়ে ৫০-৬০টি পরিবারের অন্তত আড়াই শতাধিক মানুষ ছিল কড়া সম্প্রদায়ের। কড়াদের ৩০ একরের বেশি জমি ছিল। পরিশ্রম করে জমিতে ফসল ফলিয়ে, আশেপাশে বন জঙ্গল থেকে শিকার করে আদিবাসী কড়াদের জীবন বেশ চলছিল। তারা মাটি লেপা, আলপনা আঁকা, কোঠা ঘরে বসবাস করত। আজ এই কড়াদের জোড়াতালি দেওয়া টিনের ঘরগুলো আরও বেশি জীর্ণ মনে হলো দিনের আলোয়।

ডিসেম্বর থেকে মার্চ এই সময়ের মধ্যে এখানকার কড়াদের দুই পরিবারে দুটি শিশু জন্ম নিয়েছে। ২-৩ মাস বয়সের বড়জন ঘুমাচ্ছে গাছের ডালে বাঁশ ও দড়ির তৈরি দোলনায়। ডিজিটাল পার হয়ে বর্তমান এই স্মার্ট বাংলাদেশের প্রত্যন্ত উত্তরবঙ্গে জন্ম নেওয়া কড়া শিশু প্রকৃতির মতোই সুন্দর ও নিষ্পাপ। এখানে ঝিনাইকুড়ির কড়া পাঠশালার ছাত্র রাহুল কড়াকে পাওয়া গেল। শিশুটি কামিনী কড়া ও মালন কড়ার ছেলে। সে অধিকাংশ সময় ঝিনাইকুড়িতে তার নানা মাহাতো যোগেন কড়ার কাছে থাকে বলে সেখানকার কড়া পাঠশালার ছাত্র। এখানে বাবা-মায়ের কাছে এসেছে। আমার পূর্বপরিচিত হওয়ায় সারাক্ষণ হাসিমুখে পাশে পাশে থাকল।

আমরা কড়াদের সমাধিস্থান দেখতে গেলাম। বাগান, জমির আলপথে না গিয়ে আমরা একটু ঘুরে গ্রামের মেঠোপথ দিয়েই গেলাম। কামিনী, তার পুত্র রাহুল এবং মন্টু মিঞার তরুণ নাতি শাহিন চলল আমাদের সঙ্গে পায়ে হেঁটে। ভোটারু কড়া আগে আগে চললেন তার সাইকেলটি চালিয়ে। পথের ধারে করলা, শসা এবং কিছু জমিতে ভুট্টার আবাদ করা হয়েছে। এই জমিগুলো মূলত কড়াদের। এখন ১০ শতাংশের মতো জমি অনাবাদী খাস হয়ে পড়ে আছে। আর আছে ৫ শতাংশের মতো কড়াদের সমাধিক্ষেত্রটি। শুধু এটুকুই বর্তমানে কড়াদের নামে রেকর্ডভুক্ত আছে। সমাধিক্ষেত্র বলতে, পুবে-পশ্চিমে করলা ক্ষেতের মাঝে কয়েকটি জংলি গাছ ও ঝোপঝাড় জন্মানো শতক পাঁচেকের এক চিলতে জমি। আগে আরও অনেকটা থাকলেও দুইপাশের দখলদার জমিওয়ালারা নিজেদের জমি বাড়াতে থাকার কারণে এই অবস্থায় এসে ঠেকেছে। এখান থেকে সামান্য পশ্চিমে বালিয়াড়ি এবং সেই পুনর্ভবা নদী। বাকি সমস্ত কড়াদের জমিই এখন হালনাগাদ কাগজে না আছে কড়াদের নামে, না আছে তাদের দখলে।

ঘুঘুডাঙ্গায় দিনাজপুরের স্বনামধন্য বেশ কয়েকটি চৌধুরী পরিবারের বসবাস আদি থেকে। সেই চৌধুরীদের মধ্যে কারও কারও উত্তরসূরিদের বিরুদ্ধে কড়াদের জমি নিজেদের নামে করে নেওয়া এবং দখলের অভিযোগ আছে। মোল্লা পদবিধারী কিছু পরিবারের দিকে আছে একই অভিযোগের তীর। তারা ‘পেলে দুই বিঘে প্রস্থ ও দিঘে সমান হইবে টানা’— ভেবে কিনে নেওয়ার নাম করে দখল করে নিয়েছে কড়াদের জমিগুলো। কড়াদের খাদ্যাভ্যাসে এমন অনেক কিছু রয়েছে, যা মুসলিমদের জন্য হারাম। অনেকে তাদের নাপাক এবং অচ্ছুত বলেও মনে করেন। কিন্তু কড়াদের জমিগুলো ছলচাতুরি এবং বল প্রয়োগের মাধ্যমে দখল করে নেওয়া জায়েজ মনে করেন।

সংকটের গোড়াটা আমাদের বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের ধারণার মধ্যে রয়ে গেছে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। পাকিস্তান হলো মুসলিমের রাষ্ট্র এবং ভারত অমুসলিমের, হিন্দুর নয় কিন্তু। হাল-আমলে যদিও তা হিন্দুর রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। পাকিস্তানের একাংশে বাঙালিরা শুরুতেই ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রটি অসারতা বুঝতে পারে। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পায়। জাতিরাষ্ট্র পৃথিবীতে নতুন নয়, ‘ওয়েলশ’, ‘স্কট’, ‘আইরিশ’, ‘ব্রিটন’– এই চারটি জাতির সম্মিলিত (রাষ্ট্রীয়) জাতীয়তা ‘ব্রিটিশ’।

সংকট দেখা দিল ‘বাঙালি’ শব্দটিকেও যুগপৎ বাংলাদেশের জাতীয়তা এবং রাষ্ট্রীয়তাবোধক করে তোলার চেষ্টায়। প্রান্তিক হয়ে গেল বাংলাদেশে বিরাজমান সংখ্যালঘু জাতিগুলো। এই প্রান্তিকতাকে নতুন মাত্রা দিল রাষ্ট্র ধর্মের সংযোজন। এই সবের কাছে উপেক্ষিত হলো ১৯৫০ সালে জারি হওয়া আদিবাসী জমি আইন এস এ অ্যান্ড টি অ্যাক্ট ১৯৫০-এর ৯৭ ধারার বিধান। ওই বিধান মতে ‘একজন আদিবাসী কেবল অন্য একজন আদিবাসীর কাছে তার জমি হস্তান্তর বা সম্পূর্ণ খাই-খালাসী বন্দক দিতে পারবে। তবে হস্তান্তর গ্রহীতা হিসেবে আদিবাসী পাওয়া না গেলে, স্থানীয় রাজস্ব অফিসারের লিখিত অনুমতি নিয়ে আদিবাসী ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তির কাছে জমি হস্তান্তর করতে পারবে।’ এই অনুমতি প্রাপ্তির জন্য কয়েকটি ধাপ রয়েছে। যেমন, আবেদন, যাচাই-বাছাই, শুনানি অন্তে অনুমতি প্রাপ্তি অথবা বাতিল।

ঘুঘুডাঙ্গার কড়াদের ক্ষেত্রে এমন কোনো আবেদন করে কোনো কড়া জমি হস্তান্তরের অনুমতি নিয়েছে বলে নজির পাওয়া যায় না। শুধু এটুকুই নয়, সমতলে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি আইনে আরও আছে যে ‘এই আইনি বিধান বহির্ভুতভাবে আদিবাসীদের ভূমি হস্তান্তরিত হলে সরকারের নির্বাহী বিভাগ ওই ভূমি পুনরুদ্ধার করে, মূল মালিক বা তার অনুপস্থিতিতে তার উত্তরাধিকারীদের মাঝে কিংবা উত্তরাধিকার পাওয়া না গেলে ওই ভূমির মালিকানা সরকারি হেফাজতে নিয়ে অন্য কোনো আদিবাসী ব্যক্তির মাঝে বণ্টন করে দেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে।’ দুঃখের বিষয় এমন স্বচ্ছ ও পোক্ত আইন থাকা সত্ত্বেও কড়াদের জমিগুলোর শেষ রক্ষা হয়নি।

সমাধিক্ষেত্র এবং হারানো জমি দেখে কড়াদের আঙিনায় ফিরে এসে বিদায় নেওয়ার আগমুহূর্তে আম বাগানের দিক থেকে সাইকেল চালিয়ে এসে উপস্থিত হলো শুকুরু কড়া। বয়সে তরুণ, এখনো অবিবাহিত, তার মা লোখিয়া কড়াকে নিয়ে মা-ছেলের পরিবার। ভাই ভোটারু কড়া বিরলের ঝিনাইকুড়ির পাশের ঝোপতলা গ্রামের হিন্দু পরিবারের মেয়ে চাঁদনীকে বিয়ে করে এনে এখন পৃথক অন্নে খায়। শুকুরু সাইকেলের পেছনে এক বোঝা ডাটা বেঁধে নিয়ে এসেছেন। পরিশ্রমী তরুণ, তাকে দেখে মনে হলো তিনি এই চারটি কড়া পরিবারের প্রাণশক্তির কেন্দ্র।

সাইকেল থেকে ডাটার বোঝা নামিয়ে দ্রুত হাতে খড় দিয়ে আটি বেঁধে আমাদেরও দুই আটি ডাটা দিয়ে দিলেন। জানালেন তার সবগুলো ডাটা বিকেলের হাটে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হতে পারে। ঝিনাইকুড়ির কড়ারা অভাবের সময়, যখন জমিতে কৃষি শ্রমিকের কাজও থাকে না, তখন অর্ধেক মূল্যে আগাম শ্রম বিক্রি করে অবস্থাপন্ন কৃষক মহাজনদের কাছে এবং মৌসুম এলে বিনে টাকায় কাজ করতে বাধ্য হয়। এখানে শুকুরুকে তেমনটা করতে হয় না। এই এলাকায় প্রচুর সবজি চাষ হবার কারণে সারাবছরই শুকুরুর কোনো না কোনো কাজ জুটে যায়।