সব শঙ্কা দূরে ঠেলে এবার সুনামগঞ্জের হাওরে বাম্পার ফলন হয়েছে। গত বছরের অকাল বন্যায় বেশকিছু হাওর ডুবে গিয়ে হাজার হাজার কৃষক নিঃস্ব হয়ে পড়েন।
Published : 25 Apr 2023, 11:15 AM
বৈশাখের প্রথম দিন। সূর্যকিরণ তখনও মাটি স্পর্শ করেনি। তবে শিশির ভেজা ধানক্ষেত হাসছে তারই আভায়। গ্রাম থেকে আঁকাবাঁকা মেঠোপথ চলে গেছে দূরের পথে। যেখানে হাওরের গহীনে তার মিতালী। দুধারে তাকে আপন করে নিয়েছে কাঁচাপাকা ফসল। এমনই এক ভোরে বাড়ি থেকে হাওরের পথে পা বাড়ালেন কৃষক অজিত সরকার। কাঁধে গামছা, পরনে লুঙ্গি ও গেঞ্জি। চৈত্রের তাপে তাঁর চেহারা অনেকটা তামাটে। গোয়ালে গোটাপাঁচেক দুধেল গাভী ও হালের গরু। তা দিয়েই অগ্রহায়ণ থেকে তিনি নিজের বোরো ধানের বীজতলা সাজাতে শুরু করেন। কখনও রাত বারোটা-একটা পর্যন্ত কাজ করে, আবার কখনও তারও পরে কাজ শেষে ঘুমাতে যেতে হয় তাঁকে। কিন্তু ক্ষেতে লাঙল চালাতে বা ট্রাক্টর দিয়ে ক্ষেত নিড়াতে তাঁকে উঠতে হয় সেই ভোর চারটা-পাঁচটায়। এভাবেই ধীরে ধীরে তাঁর দুচোখ স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। বৈশাখের সূর্যকিরণ যখন মধ্যবয়সী এই কৃষকের চোখেমুখে পড়ে তখন তাঁর মুখে এক অদ্ভুত আনন্দ খেলে যায়। তিনি শরীরে এক আশ্চর্য শক্তি অনুভব করেন। তাঁর পা আরও জোরকদমে এগুতে শুরু করে হাওরের টানে। আপন মনে ভাবতে থাকেন নানা কথা। কোন জমিটায় কত ফসল পাবেন, কতটুকু পেলে গতবছরের ক্ষতি কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠবেন। নিজের ভেতরে হিসাব-নিকাশ করতে করতে কখন যে কাচা আট কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলেন তা টেরই পাননি। একসময় ঢুকে পড়েন তাঁর বুক ভর্তি উঁচু বোরো ক্ষেতে। যেখানে ঢুকেই তিনি স্পর্শ করলেন কয়েকটি পাকা ধানের শীষ। হাতটা শিশিরে ভিজে গেল। এই সাতসকালে শিশিরভেজা সেই হাত তিনি মুখে ছোঁয়ালেন। তাঁকে এটি তৃপ্তি দিল। ঘণ্টাখানেক ধরে ঘুরে দেখলেন নিজের জমি। ততসময়ে পুরোটা শরীর শিশিরে ভিজে গেছে।
সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলার টগার হাওরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কথা হয় সাড়ারকোনা গ্রামের এই কৃষকের সঙ্গে। কেমন হলো ফসল জিজ্ঞেস করতেই হেসে দিলেন তিনি। অজিত সরকার বললেন, ‘এইবার ফসল খুব ভালা অইছে। অখন ঘরে তুলতে পারলেই অয়। দিনডি যেমন গরম (রোদ) দিতাছে, এইভায় কয়েকটা দিন দিলে মোটামুটি সবাই ধান ঘরো তুলতে পারব।’ তিনি আরও জানান, মাসখানেক আগে ব্লাস্ট রোগে ফসলের বেশ ক্ষতির শঙ্কা দেখা দিয়েছিল। তবে যারা কিটনাশক প্রয়োগ করেছিলেন তারা তা থেকে সুরক্ষা পেয়েছেন।
গত মার্চের শেষের দিকে মধ্যনগর উপজেলার কয়েকটি হাওরে ব্লাস্ট রোগের সংক্রমণ দেখা দেয়। বিশেষ করে বড় ঘোড়াডোবা, ছোট ঘোড়াডোবা, বোয়ালা ও শালদিঘা হাওরে বোরোর বেশ ক্ষতি হয়। এতে সংশ্লিষ্ট কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ বিষয়ে কথা হয় মধ্যনগর ইউপি চেয়ারম্যান সঞ্জিব রঞ্জন তালুকদারের সঙ্গে। মধ্যনগর বাজারের দক্ষিণ মাথায় দাঁড়িয়ে হাওর দেখিয়ে তিনি বলেন, বড় ঘোড়াডোবা ও ছোট ঘোড়াডোবা হাওরের অনেক কৃষক ব্লাস্ট রোগে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন। কেউ কেউ ফসলই কাটেননি। কারণ, ধান কাটতে গেলে যে খরচ হবে তেমন ধান গোলায় উঠবে না। কৃষি বিভাগ থেকে কৃষকদের এ বিষয়ে পরামর্শ দিলেও ক্ষতি ঠেকানো যায়নি।
তবে শেষ পর্যন্ত সব শঙ্কা দূরে ঠেলে এবার সুনামগঞ্জের হাওরে বাম্পার ফলন হয়েছে। গত বছরের অকাল বন্যায় বেশকিছু হাওর ডুবে যায়। এতে হাজার হাজার কৃষক নিঃস্ব হয়ে পড়েন। এজন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও কৃষকরা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ যথাযথ না হওয়াকে দায়ী করেন। তারা অভিযোগ তোলেন অনিয়ম ও দুর্নীতির। এবারও কিছু অভিযোগ উঠেছিল। যদিও গতবারের তুলনায় তা ছিল কম। ফলে এবার প্রশাসন থেকে নজরদারি বাড়ানো হয়। তবে এবার টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল না আসায় অনেকটা স্বস্তিতে ছিলেন কৃষক। গত একটি বছর কঠিন সময় অতিক্রম করেছেন ভাটি বাংলার কৃষকরা। ধার ও ঋণ করে এবার তারা চাষ করেন। কেউ কেউ কৃষিকাজ ছেড়ে দিয়েছেন। আবার কোনো কোনো ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক চাষাবাদের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছেন।
একাধিক অনুঘটক এবছর হাওরে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। গতবছর সারা দেশে দু-দফা বড় বন্যা হাওরাঞ্চলকে সমৃদ্ধ করেছে। বন্যার পলিমাটির কারণে এবার ফসল বেশি হয়েছে। এছাড়া বেশ কয়েক জাতের উচ্চ ফলনশীল ধান হাওরকে সোনার ফসলে ভরিয়ে দিয়েছে। এখন যতদূর চোখ যায় শুধু সোনালী ধান। আগে কৃষকরা বোরো ও ইরি জাতীয় কিছু ধানের চাষ করতেন। এখন খরা ও অকাল বন্যার হাত থেকে বাঁচতে আগাম ফলন দেয় এমন কিছু ধানের আবাদে ঝুঁকেছেন কৃষক। এ ব্যাপারে কৃষি বিভাগও তাদের উৎসাহিত করেছে। এবছর হাওরে বাম্পার ফলন হয়েছে এমন ধানের মধ্যে রয়েছে কৃষিবিদ, মাইক্রোওয়ান, মিতালী-৪, জনকরাজ ইত্যাদি।
পাশাপাশি দেশজুড়ে বয়ে যাওয়া তীব্র তাপদাহ ও গরম হাওরের ধান দ্রুত পাকতে সাহায্য করেছে। বৃষ্টি না হওয়ায় হাওরের ধান ছিল শুকনো। রাস্তাঘাটও ছিল কম কর্দমাক্ত। ফলে হাওরের মাঝেও ধান কেটে খুব সহজেই গরু ও ঘোড়ার গাড়ি বা ইঞ্জিনচালিত যান দিয়ে তারা বাড়ি নিয়ে এসেছেন।
তবে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আধুনিকতা ঢুকে পড়েছে হাওরের প্রকৃতিতে। কৃষি শ্রমিক সংকটও এর বড় একটা কারণ। আগে প্রতি গৃহস্তবাড়িতে হালের গরু ও গাভী ছিল। ছিল নৌকাও। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে কৃষকরা ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ করেন। ধান কাটতে দূর-দূরান্ত থেকে দলে দলে আসত ধান কাটার ব্যাপারীরা। এখন তাদের সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে। তাদের জায়গা দখলে নিয়েছে ধান কাটার যন্ত্র ও ইঞ্জিনচালিত বাহন। গরু দিয়ে আর মাড়াই হয় না বললেই চলে, সেখানে স্থান নিয়েছে ধান মাড়াই যন্ত্র। সারাদিনে একডজন গরু দিয়ে যে ধান মাড়াই করা যেত তা এখন যন্ত্রের সাহায্যে এক ঘণ্টায় সম্ভব। আবার কোনো যন্ত্র দিয়ে ফসলের ক্ষেতের মধ্যেই ধান কাটা ও মাড়াই একইসঙ্গে চলছে। এতে কৃষকের শ্রম ও সময় বাঁচলেও বাড়তি অর্থ গুণতে হচ্ছে।
ধানের বাম্পার ফলন নিয়ে মধ্যনগর ইউপি চেয়ারম্যান সঞ্জিব রঞ্জন তালুকদার বলেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমি বিভিন্ন হাওরে ঘুরতে গিয়েছি। এখন কৃষকদের মধ্যে উৎসবের আমেজ। কয়েকদিন ধরে একটু বৃষ্টি হলেও তেমন সমস্যা হচ্ছে না। মধ্যনগরের প্রায় ৮০ ভাগ ধান কাটা শেষ হয়েছে। আর কয়েকদিনের মধ্যে পুরো ধান কৃষকের গোলায় উঠবে।
তবে সরকারি হিসেবে সোমবার পর্যন্ত সিলেটে ৫৫ ভাগ, মৌলভীবাজারে ৭০ ভাগ, হবিগঞ্জে ৬৭ ভাগ, সুনামগঞ্জে ৭৩ ভাগ, কিশোরগঞ্জে ৫৮ ভাগ, নেত্রকোনায় ৭৭ ভাগ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৬৭ ভাগ ধান কাটা হয়েছে। হাওরভুক্ত ৭টি জেলার হাওরে এবছর বোরো আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে। আর হাওর ও হাওরের বাইরে উঁচু জমি মিলে মোট বোরো আবাদ হয়েছে ৯ লাখ ৫৩ হাজার হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৪০ লাখ টন চাল। কৃষি মন্ত্রণালয়ের দাবি, হাওরাঞ্চল দেশের এক তৃতীয়াংশ চাহিদার চালের জোগান দেয়।
এছাড়া টানা বৃষ্টিপাতের আশঙ্কায় বৈশাখের শুরুতে বিভিন্ন হাওরে মাইকিং করেছে স্থানীয় কৃষি বিভাগ। একারণে আরও দ্রুত ফসল তোলার চেষ্টা করছেন কৃষকরা।
আশার কথা কৃষকের গোলা এখন ধানের পরিপূর্ণ। তাঁর ভাড়ারে ধরে না সোনার ফসল। অনেক কৃষক দাম ভালো পাওয়ায় এখনই বিক্রি করে দিচ্ছেন। তা দিয়ে ঋণ পরিশোধ বা বাজার-সদাই করছেন।
তবে হতাশার বিষয় হলো এখনও প্রকৃতির খেয়ালে বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছেন কৃষক। গত রোববার সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলায় হাওরে ধান কাটার সময় বজ্রপাতে ১০ কৃষক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। এপ্রিল থেকে জুনের প্রথম ভাগকে বজ্রপাতের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। কিন্তু বজ্রপাত রোধে কোনো যন্ত্র বা বার্তা দিতে না পারায় মানুষকে অকালে জীবন দিতে হচ্ছে। হাওর বজ্রপাতের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যে শীর্ষে।
প্রকৃতির বিরূপতার মধ্যেও বৈশ্বিক সংকটে আশা জাগাচ্ছে দেশের হাওর। রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী বেড়ে গেছে খাদ্যপণ্যের দাম। আমাদের দেশের খাদ্যভাণ্ডার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় হাওরকে। অথচ ২০১৭ সাল থেকে ধানের দেশের মানুষ ভাতের কষ্ট ভোগ করে আসছে। এরপর থেকে প্রতিবছরই প্রকৃতির বিরূপ আচরণে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি কৃষক। এবার তাঁদের ঘুরে দাঁড়ানোর পালা। এই হাওরকে ঘিরেই তাঁদের পথচলা। এবার হাওরের বাতাসে ভাসবে সানাইয়ের সুর। নতুন করে জীবন সাজাবে কোনো যুবা কৃষক।