রূপবান সিনেমা ও বাংলা চলচ্চিত্র

ষাটের দশকে উর্দু চলচ্চিত্রের স্রোতে বাংলা চলচ্চিত্র যখন বিপন্ন, তখন লোককাহিনী নির্ভর চলচ্চিত্র ‘রূপবান’ নির্মিত হয়। এটি বাংলা চলচ্চিত্রের নতুন যুগের সূচনা ছিল।

হোসাইন মোহাম্মদ জাকিহোসাইন মোহাম্মদ জাকি
Published : 6 Dec 2022, 07:37 AM
Updated : 6 Dec 2022, 07:37 AM

পুঁথিপাঠ, যাত্রা, পালাগান, কবির লড়াই, গাজন, কীর্তন, ইত্যাদি আবহমান কাল থেকে ছিল বাঙালির প্রধান বিনোদন। যাত্রাপালায় তখন ‘রূপবান’ এর জয়জয়াকার। দল বেঁধে ‘রূপবান’ দেখতে যেত মানুষ। এই গল্প সিনেমার পর্দায় আনলেন সালাহ্উদ্দিন। মূল পরিকল্পনায় ছিলেন তাঁর সহকারী সফদার আলী ভূঁইয়া। ১৯৬৫ সালের ৫ নভেম্বর সিনেমাটি মুক্তি পায়। ছবির বাজেট ছিল দেড় লাখ রূপি। বক্স অফিসে ছবিটি ব্যাপক আলোড়ন তোলে। এটির বাণিজ্যিক সাফল্য অতীতের সকল রেকর্ড ভাঙে। চলচ্চিত্রের দেশীয়করণে ‘রূপবান’ এর ভূমিকা ছিল অনন্য। 

শুধু আমদানিকৃত চলচ্চিত্রই নয়, দেশে তৈরি উর্দু চলচ্চিত্রের সঙ্গেও তখন যুদ্ধ করতে হচ্ছিল বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পকে। এদেশের ছবির বাজার তখন কলকাতা, মুম্বাই ও লাহোরের বাজার-চলতি বাংলা, হিন্দি ও উর্দু ছবির দখলে ছিল। স্বনামধন্য চলচ্চিত্র পরিচালক আলমগীর কবিরের তথ্য মোতাবেক, ১৯৬২-১৯৬৫ সালের মধ্যে ১৮টি বাংলা ছবির সঙ্গে ১৯টি ছবি উর্দু ভাষায় নির্মিত হয়। বাংলা ছবিকে এই সংকট থেকে রক্ষা করে বক্তব্য প্রধান বা মহান শিল্প ভাবনায় নির্মিত কোন ছবি নয় বরং ফোক ছবি ‘রূপবান’। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কারণে একদিকে ভারতীয় ছবি আমদানি বন্ধ হয়ে যায়, অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানবাসী গ্রহণ করেন ‘রূপবান’কে।

কোন জনপদের নিজস্ব জীবন, ভাষা ও বয়ানরীতির মধ্য থেকে জন্মানো ও বেড়ে ওঠা লোককাহিনী সেই জনপদের পরিচয় ও জীবনচর্চাকে প্রতিফলিত করে। ফলে সেটি যখন চলচ্চিত্রায়িত হয়, তখন তা জনপদের একটা বড় অংশকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তেমনই একটি সৃষ্টি ‘রূপবান’। গ্রামীণ অপেরা থেকে ‘রূপবান’কে চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়া হয়। এর পরিচালক মঞ্চের ঐতিহ্যবাহী প্রবেশ-সংলাপ-প্রস্থানশৈলীকে চলচ্চিত্রে সফলভাবে রূপান্তর করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মূল যাত্রায় ব্যবহৃত হয়েছিল এমন কয়েকটি জনপ্রিয় লোকগানও চলচ্চিত্রটিতে ব্যবহার করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামীণ জনসমাজ চলচ্চিত্রের মতো একটি পশ্চিমা, আধুনিক এবং প্রযুক্তিগত মাধ্যমের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। 

এই প্রসঙ্গে চলচ্চিত্র সমালোচক চিন্ময় মুৎসুদ্দী ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সামাজিক অঙ্গীকার’ গ্রন্থে লিখেছেন, ১৯৬০-এর দশকের প্রথম দিকে যেখানে অন্যান্য বাংলা চলচ্চিত্রের মাত্র চার বা পাঁচটি রিলিজ ছাপা হতো, সেখানে রূপবান-এর ১৭টি রিলিজ প্রকাশ হয়েছিল। শুধু রূপবান-এর প্রদর্শনীর জন্য গ্রামীণ এলাকায় অনেক অস্থায়ী প্রেক্ষাগৃহ তৈরি করা হয়েছিল। টিনের চালার এইসব প্রেক্ষাগৃহ, অ্যানালগ সিনেমা হলের পর্দা আর কাঠের বেঞ্চের ছারপোকার ছড়াছড়ির মাঝেই নিজেদের স্থান করে নিতেন রূপবানের দর্শকেরা! ঢাকার স্টার সিনেমা হলে প্রতি বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় ছিল নারীদের জন্য বিশেষ শো এর ব্যবস্থা।

সালাহ্উদ্দিনের পরিচালনায় পরবর্তীতে ছবিটির উর্দু সংস্করণ মুক্তি পায় পশ্চিম পাকিস্তানে। ১৯৬৫ পরবর্তী যুগকে সিনে-সাংবাদিকরা রূপবান যুগ হিসেবে অভিহিত করেছেন। নানা রূপে আবির্ভূত হয় ‘রূপবান’। ১৯৬৬ সালে পরিচালক সফদার আলী ভূঁইয়া রূপবান নামের সঙ্গে জুড়ে দেন রহিম বাদশা (‘রহিম বাদশা ও রূপবান’), পরিচালক ইবনে মিজান ‘রূপবান’ কে পাঠান বনবাসে (‘আবার বনবাসে রূপবান’)। একই বছর মুক্তি পায় জহির রায়হানের লোককাহিনী নির্ভর ছবি ‘বেহুলা’ ও খান আতাউর রহমানের ‘রাজা সন্ন্যাসী’। এই বিষয়ে চলচ্চিত্র সমালোচক বিধান রিবেরু ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র’ গ্রন্থে লিখেছেন, ১৯৬৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ১৪টি বাংলা ছবির মধ্যে ১০টিই ছিল লোককাহিনী ভিত্তিক। পঞ্চাশের দশকে যেখানে একটিও লোকজ কাহিনী নির্ভর চলচ্চিত্র মুক্তি পায়নি, সেখানে ষাটের দশকে মুক্তিপ্রাপ্ত ১৫৫টি ছবির মধ্যে ৩৮টি ছিল লোককাহিনী নির্ভর। কোন কোন পরিচালক আবার তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বাজার লাভের উদ্দেশ্যে এই লোক কাহিনীগুলোকে উর্দু ভাষায় চিত্রায়িত করেন। এমনকি স্বরচিত লোক ছবিও তৈরি করেন কয়েকজন পরিচালক। রূপবানের ভূত চেপেছিল তখন সর্বত্রই। রূপবান সিগারেট, রূপবান আলতা, রূপবান ঘুমের বটিকা, রূপবান মার্কা কেরোসিন তেল থেকে শুরু করে আরও কত কি!

ষাটের দশকে শুরু হওয়া রূপবানধর্মী চলচ্চিত্রের ধারা একবিংশ শতকের শুরুতেও দৃশ্যমান ছিল। ‘গুনাই বিবি’, ‘মহুয়া’, ‘ভাওয়াল সন্ন্যাসী’, ‘আপন দুলাল’, ‘জরিনা সুন্দরী’, ‘সাইফুলমূলক বদিউজ্জামান’, ‘রূপবানের রূপকথা’, ‘সাতভাই চম্পা’, ‘সুয়োরানী দুয়োরানী’, ‘গাজী কালু চম্পাবতী’, ‘ভেলুয়া সুন্দরী’, ‘কাজলরেখা’, ‘বেদের মেয়ে জোছনা’, ‘রঙিন রূপবান’, ‘আজকের রূপবান’, ‘খায়রুন সুন্দরী’সহ আরো অসংখ্য ছায়াছবি লোকজ কাহিনীকে ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে। কলকাতায়ও তৈরি হয়েছে ‘রূপবান কন্যা’ নামে একটি সিনেমা। অনেক লোককাহিনীর মতো ‘রূপবান’ও এক রূপকথা। 

১২ বছরের রূপবানের সঙ্গে রাজপুত্র রহিম, যে কিনা সদ্য জন্মলাভ করেছে, তার বিয়ের মাধ্যমে এ কাহিনীর বিস্তৃতি ঘটে। তারপর দৈববাণীর কল্যাণে ১২ দিনের স্বামী রহিমকে নিয়ে ১২ বছরের রূপবানের বনবাস। রূপবানের বনসংগ্রামী জীবন, রহিম বাদশার বেড়ে ওঠা, অপর রাজকন্যা তাজেলের প্রেমে পড়া, পরিশেষে অমোঘ সত্য প্রকাশিত হওয়ার বিষয়াদিই রূপবান লোককাহিনীর উপজীব্য। ছবিটির প্রযোজনা ও চিত্রনাট্য রচনা করেছেন পরিচালক স্বয়ং। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুজাতা, মনসুর, চন্দনা, আনোয়ার হোসেন, ইনাম আহমেদ, সিরাজুল ইসলাম, তেজেন চক্রবর্তী, তন্দ্রা, রহিমা ও হেলেন। কলাকুশলীদের মধ্যে ছিলেন চিত্রগ্রহণে আবদুস সামাদ, সঙ্গীত পরিচালনায় সত্য সাহা, শব্দ গ্রহণে মনি বোস ও সম্পাদনায় বশীর হোসেন।

সুজাতা আজিমের লেখা ‘আমার আত্নজীবনী’-তে খুঁজে পাওয়া যায় ‘রূপবান’ সংশ্লিষ্ট আরও নানা তথ্য। ‘রূপবান’ চরিত্রে অভিনয়কারী সুজাতার পারিবারিক নাম ছিল তন্দ্রা মজুমদার। পরিচালকের কল্যাণে সেটা হয়ে যায় সুজাতা। রূপবান মুক্তির পর ছবিটির জনপ্রিয়তা এতটাই তুঙ্গে ওঠে যে, নায়িকা সুজাতাকে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন জেলায় কাজ করতে গিয়ে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। অনুরাগীদের ঢল ঠেকানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পুলিশ পর্যন্ত মোতায়েন করতে হয়েছে। গ্রামের যেসব মা-চাচীরা ইতিপূর্বে সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখার কথা চিন্তাও করেননি, তারাও ‘রূপবান’ দেখতে গরু-মহিষের গাড়িতে হলমুখী হয়েছিলেন। শুধু রূপবানের প্রতি অনুরাগই নয়, রূপবানের স্পর্শকৃত বাঁশটিও উঠেছিল নিলামে। সিনেমার একটি দৃশ্যে সুজাতা একটি বাঁশে হাত রেখে গান গেয়েছিলেন। ভক্তকূলের অভিলাষে সে বাঁশটি বিক্রি হয় ষাট টাকায়! চলতি বাজারে যার মূল্য এক বা দু আনার বেশী হওয়ার কথা নয়। ‘ও দাইমা কিসের বাদ্য বাজে গো’, ‘সাগর কূলের নাইয়ারে’, ‘মনের দুঃখ কইনারে বন্ধু রাইখাছি অন্তরে’, ‘বিদায় দেন বিদায় দেন’ শিরোনামে রূপবানের বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় গান তখন হরহামেশাই লোক মুখে শোনা যেত। তৎকালীন দৈনিক পত্রিকায় ‘রূপবান’ এর বিজ্ঞাপন থেকেও ছবিটির আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা টের পাওয়া যায়। ১৯৬৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয় ‘রূপবান: ৩৬তম সপ্তাহ রূপমহলে’ শিরোনামে বিজ্ঞাপন। বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তার এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত!

কালের পরিক্রমায় ফোক ছবির সেই জয়রথ থেমে গেছে। ক্যাবল টিভি, মোবাইল, ল্যাপটপে বিনামূল্যে সিনেমা দেখার দ্বার উন্মোচিত হওয়ায় পাল্টে গেছে দর্শকদের রুচি, ভালো লাগা, মন্দ লাগা। আমাজন প্রাইম, নেটফ্লিক্স, জি-ফাইভ, হইচই-এর মতো ওটিটি প্লাটফর্মগুলোতে এখন পছন্দের কনটেন্ট খুঁজে পাচ্ছেন দর্শকরা। জায়ান্ট স্ক্রিন, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত সাউন্ড সিস্টেম এবং সর্বোপরি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সিনেপ্লেক্সের নান্দনিক পরিবেশও দর্শককে হলমুখী করতে পারেনি। আশির দশকে যেখানে দর্শকদের চাপে রাত ১২টার পরও অনেক হলে শো চালাতে হয়েছে, সেখানে হলমুখী না হওয়ায় একে একে বন্ধ হয়ে গেছে সেসব হল। ১৯৯৮ সালে দেশে সিনেমা হল ছিল ১২৩৫‌টির মতো। দুই যুগের ব্যবধানে চালু আছে সব মিলিয়ে হয়তো এক-দেড়শ! উপচে পরা ভিড়ের কারণে দ্বিগুণ দামে ব্ল্যাকে টিকেট কাটা এখন শুধুই স্মৃতি।