মার্কিন দূতের কাণ্ড এবং রুশ-মার্কিন দ্বন্দ্বে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাণ্ডের ফলে বাংলাদেশের মাটিতেই রুশ-মার্কিন বিতর্ক শুরু হয়েছে, যা আমাদের দেশকে আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বের দাবার ঘুঁটিতে পরিণত করতে পারে।

শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকশামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক
Published : 29 Dec 2022, 12:01 PM
Updated : 29 Dec 2022, 12:01 PM

বাংলাদেশে কর্মরত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের একটি পদক্ষেপ নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে, তা এখন বাংলাদেশে রুশ-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্বের সূচনা করেছে, যেটি আমাদের জন্য অনাকাঙ্খিত উদ্বেগের কারণ। মার্কিন দূতের পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনে গ্রহণযোগ্য কিনা, তা পর্যালোচনার জন্য সেই সংক্রান্ত আইন এবং স্বাগতিক দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের নাক গলানোর অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন সময়ে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া প্রয়োজন।

খ্রিস্টের জন্মের ৩ শ বছর আগে, আলেকজান্ডার পরবর্তী ভারতবর্ষে মৌর্য সাম্রাজ্যের সময়, মহাঋষি কৌটিল্য কূটনীতিক আচার-আচরণ নিয়ে যা লিখেছিলেন, আজও তা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত রয়েছে। কৌটিল্যের অন্যতম নির্দেশনা ছিল কোনও দেশের রাজ প্রতিনিধি স্বাগতিক দেশের খবরাখবর নিজ দেশে পাঠাতে পারবেন, প্রয়োজনে গোয়েন্দা তৎপরতাও চালাতে পারবেন, কিন্তু সে দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে পারবেন না। তিনি আরো বলেছেন, প্রতিটি রাষ্ট্রীয় দূতের বড় দায়িত্ব হবে স্বাগতিক দেশের সাথে নিজ দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে সচেষ্ট থাকা। যুগে যুগে কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে বহু সভা-সম্মেলন এবং আন্তর্জাতিক সন্ধি হয়েছে, যার অন্যতমটি ছিল ১৬৪৮ সালের 'ওয়েস্ট ফেলিয়া' সন্ধি, যার কথা হেনরি কিসিঞ্জার তার একাধিক পুস্তকে প্রশংসাসূচকভাবে উল্লেখ করেছেন। সেই চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল কোন দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশের হস্তক্ষেপের উপর নিষেধাজ্ঞা। আন্তর্জাতিক আইনের জনক হিসেবে পরিচিত ডাচ আইন বিশারদ হুগো গ্রোসিয়াস একই ধরনের কথা লিখেছিলেন। ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশন পূর্ব সময়ে কূটনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তি হতো দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি, আর তাতেও কূটনীতিকদের উপর স্বাগতিক রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের উপর নিষেধাজ্ঞার বিধান অবশ্যই স্থান পেতো। ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের ৪১ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে যে কূটনীতিকরা স্বাগতিক দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন এবং সে দেশের ঘরোয়া ব্যাপারে মাথা ঘামাবেন না। কনভেনশনে 'জুস কজেন্স' এর স্বীকৃতি রয়েছে, যার অর্থ উক্ত কনভেনশন সত্ত্বেও প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনের সে সকল বিধান চলবে যেগুলো উক্ত কনভেনশন দ্বারা খণ্ডিত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র সরকার উক্ত কনভেনশনে ১৯৭০ সালে দস্তখত করলেও সে দেশের সিনেট এতে অনুমোদন দেয়নি। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ভাষ্য হচ্ছে কনভেনশনের বিধানাবলি প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজ দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের নাক গলানো কখনো সহ্য করেনি, আর তাই ভিয়েনা কনভেনশনের বহু যুগ পূর্বে, ১৮৮৮ সালে তার দেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগে বৃটিশ রাষ্ট্রদূত লর্ড সেকভিলকে 'অবাঞ্ছিত' (persona non-grata) ঘোষণা করলে ব্রিটিশ সরকার লর্ড সেকভিলকে রাষ্ট্রদূতের পদ থেকেই অপসারিত করেছিল। পরবর্তী সময়েও যুক্তরাষ্ট্র বহু বিদেশি কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে তার দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের দায়ে।

২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র সে দেশের নির্বাচনে ডনাল্ড ট্রাম্পকে জেতানোর চেষ্টা রত থাকার অভিযোগে ১০ জন রাশিয়ান কূটনীতিককে বহিষ্কার করে। সম্প্রতি দেশটি ইকুয়েডরের এবং ১৯৮০ সালে দুইজন লিবিয়ান কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছিল। বিভিন্ন সময়ে বহিষ্কার করেছিল আরো অনেক কূটনীতিককে। বিশ্বের অন্যান্য দেশও একই পন্থা অবলম্বন করে আসছে। ১৯৮৮ সালে সিঙ্গাপুর তার দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগে মার্কিন দূতাবাসের প্রথম সচিবকে বহিষ্কার করেছিল এই বলে যে সিঙ্গাপুরের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে সিঙ্গাপুরের মানুষ, যেভাবে আমেরিকার মানুষ আমেরিকার রাজনীতি নির্ধারণ করে।

২০১৬ সালে ভারত গোয়েন্দাগিরির অভিযোগে একজন পাকিস্তানি কূটনীতিককে শুধু বহিষ্কারই করেনি, বরং বহিষ্কারের পূর্বে তাকে গ্রেপ্তারও করেছিল। আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের কারণে কূটনীতিকদের বহিষ্কারের ব্রিটিশ ইতিহাসও বেশ পুরোনো। ১৫৮০ সালে ব্রিটিশ সরকার, ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার অভিযোগে স্পেনের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছিল। ১৯৭৬ সালে লন্ডনে কর্মরত লিবিয়ান দূতকেও যুক্তরাজ্য বহিষ্কার করেছিল এবং ১৯৯৫ সালে বহিষ্কার করেছিল সৌদি দূতাবাসের সেই কূটনীতিককে যে লিবিয়ার স্বার্থ দেখাশোনা করতো। ১৯৯৯ সালে দেশটি একজন লাইবেরিয়ান কূটনীতিককে এবং ২০০৭ সালে বহিষ্কার করেছিল চারজন রাশিয়ান কূটনীতিককে। ১৯৯১ সালে জার্মানি একজন ইরাকি কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছিল। ১৯৭৬ সালে মিশর সে দেশে পাঠানো লিবিয়ার রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছিল মিশরের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের অভিযোগে। ১৯৮৩ সালে নিকারাগুয়া তিনজন মার্কিন কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছিল এবং সমসাময়িক সময়ে বহিষ্কার করেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের এবং ভ্যাটিক্যানের দূতদের। ১৯৬১ সালের কনভেনশনের ৯ অনুচ্ছেদে চুক্তিভুক্ত দেশসমূহকে যে কোন বিদেশি কূটনীতিককে 'অবাঞ্ছিত' ঘোষণার অধিকার দিয়েছে, যে বিধান প্রয়োগ করে বাংলাদেশ পাকিস্তানের একজন উপ-হাইকমিশনারকে বহিষ্কার করেছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে আপত্তিকর মন্তব্যের জন্য। তাছাড়া আরো দুইজন পাকিস্তানি কূটনীতিককে ২০১৫/১৬ সালে বহিষ্কার করা হয়েছিল আমাদের দেশে জঙ্গি অর্থায়নের কাজে লিপ্ত থাকার কারণে। ২০২১ সালে তুরস্ক সরকার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডা, নিউজিল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত সহ মোট ১০ জন রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তুরস্কে কয়েক বছর ধরে আটক ওসমান কাবালা নামক এক ব্যক্তিকে ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতের রায় মোতাবেক মুক্তি দেয়ার দাবি জানানোর কারণে।

এর পরপরই যুক্তরাষ্ট্র সরকার ঘোষণা দেন যে তার কূটনীতিকগণ স্বাগতিক দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না, সেই সাথে তুরস্কও ১০ কূটনীতিককে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত পরিহার করেছিল।

প্রতিটি কনভেনশনের মতো ভিয়েনা কনভেনশনের বিধান সমূহও কনভেনশনভুক্ত দেশসমূহ মানতে বাধ্য। তদুপরি প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনে কূটনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিধান সহ, সকল বিধানই সকল রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক। সে অর্থে আমাদের দেশে কর্মরত কয়েকজন বিদেশি রাষ্ট্রদূত আমাদের দেশের নির্বাচন, নির্বাচন ব্যবস্থা, সরকার ব্যবস্থা, আইন-কানুন এবং তার প্রয়োগ নিয়ে যে সব কথা বলছেন তা নিশ্চিতভাবে ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশন এবং কূটনীতি সংক্রান্ত প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনের মারাত্মক খেলাপ। বলা বাহুল্য, আমাদের কোন কূটনীতিক অন্য দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে এমনভাবে নাক গলালে, সে দেশ অনেক আগেই আমাদের কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে কনভেনশনের ৯ অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করতো। কনভেনশন এবং প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইন ছাড়াও জাতিসংঘ সনদের বিধানসমূহ মান্য করা সকল সদস্য রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য বটে, যার ২(৭) অনুচ্ছেদে বলা আছে অন্য দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে সকল আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বকে (প্রতিটি রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাই আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব) দূরে থাকতে হবে। ইরানে মার্কিন দূতাবাসে সন্ত্রাসী আক্রমণ সংক্রান্ত মামলার রায় প্রদানকালে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালত একদিকে যেমন কূটনৈতিক মিশন সমূহ রক্ষার ব্যাপারে স্বাগতিক রাষ্ট্রের দায়িত্বের কথা উল্লেখ করেছেন, অন্যদিকে স্বাগতিক দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার বিধানের কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তবে আদালত ইরান সরকারের সেই যুক্তি মেনে নিতে পারেননি যে সেই অঘটনের জন্য মার্কিন দূতাবাস দায়ী কেননা দূতাবাস ইরানের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছিল বলেই কিছু সংখ্যক ইরানি দূতাবাসটি আক্রমণ করে। ভিয়েনা কনভেনশনের ৩১ অনুচ্ছেদে প্রতিটি রাষ্ট্রে কূটনীতিকদের জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছাড়াও দেওয়ানি এবং ফৌজদারি বিষয়ে দায়মুক্তির বিধান রয়েছে, বিধান রয়েছে কতগুলো বিশেষ সুবিধা প্রদানের। কোন কূটনীতিক স্বাগতিক দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অর্থ মূলত সে সব দায়মুক্তি এবং বিশেষ সুবিধার অপব্যবহার, যা কোন রাষ্ট্রের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ১৯৮৪ সালে যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয়ে বসবাসরত প্রাক্তন নাইজেরীয় মন্ত্রী উমরো ডিকোকে অপহরণের অভিযোগে মেজর মোহাম্মদ ইউসুফু নামের এক নাইজেরীয় সামরিক কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে বিচারে পাঠানো হলে তিনি কূটনৈতিক দায়মুক্তির দাবি করলে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তা প্রত্যাখ্যান করেছিল এই বলে যে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ মেজর ইউসুফুকে কূটনৈতিক মর্যাদা দেয়নি। বিচারে ইউসুফুর ১২ বছর কারাদণ্ড হয়। ঘটনার পর লন্ডনে কর্মরত নাইজেরিয়ান রাষ্ট্রদূতকেও বহিষ্কার করেছিল বৃটিশ সরকার। উমোরো ডিকুকে অপহরণের পর নাইজেরিয়ার একটি কূটনৈতিক ব্যাগে ঢুকিয়ে সেটি নাইজেরিয়াগামী বিমানে উঠানোর প্রক্রিয়াকালে ব্যাগটি ব্রিটিশ শুল্ক কর্মকর্তাদের সন্দেহ আকৃষ্ট করলে তারা তা খুলে অসুস্থ ডিকুকে ভেতরে দেখতে পান। ভিয়েনা কনভেনশনে কূটনৈতিক ব্যাগ খোলার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ব্রিটিশ কর্মকর্তারা সেটি পরোয়া না করেই ব্যাগটি খুলেছিলেন। পরবর্তী আর এক ঘটনায় ব্রিটেনে আশ্রয় নেওয়া ইসরায়েলি শান্তিবাদি পরমাণু বিজ্ঞানি মারদেকাই ভানুনুকে যুক্তরাজ্যে কর্মরত মোসাদের এক নারী গুপ্তচর ১৯৮৬ সালে প্রেমের জালে ফাঁসান। তার সাথে অভিনয় করে তাকে বৃটিশ জলসীমার বাইরে নিয়ে গেলে সেখানে অপেক্ষমান ইসরায়েলি নৌ-জাহাজ ভানুনুকে কব্জা করে ইসরায়েলে নিয়ে যায়, যে ঘটনায় বিলেতে প্রতিবাদের ঝড় উঠলে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লন্ডনে কর্মরত ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতকে তলব করেন। দূত জানিয়েছিলেন, সংশ্লিষ্ট ঘটনা তার অজ্ঞাতেই ঘটেছে, আর তাই সেই দূতের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি, যদিও পার্লামেন্টের সদস্যরা বারবার দাবি জানাচ্ছিলেন ইসরায়েলি দূতকে বহিষ্কার করার ব্রিটিশ সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপে সহযোগিতার অভিযোগে।

সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া যা নিয়ে দেশে এবং যুক্তরাষ্ট্রে তুমুল হৈ-হুল্লোর চলছে, তার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ঢাকায় কর্মরত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের কর্মকাণ্ড। ২০১২ সালে নিখোঁজ বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমন ও ‘গুম’ হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’র সমন্বয়কারী আফরোজা ইসলাম আঁখির বাসায় গিয়েছিলেন তিনি।

শাহীনবাগের ওই বাড়িতে যাওয়ার আগে থেকেই ‘মায়ের কান্না’ নামে আরেকটি সংগঠনের সংগঠকরা সেখানে জড়ো হন। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়ে ফাঁসি হওয়া সেনা ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের পরিবারবর্গদের নিয়ে এ সংগঠনটি গড়ে উঠেছে। তাদের দাবি, জিয়ার আমলে ও সামরিকবাহিনীর সদস্যদের আসলে বিচারবহির্ভূূতভাবে হত্যা করা হয়েছে।

বাড়ির ভেতরে নিখোঁজ বিএনপি নেতা সুমনের পরিবারের সঙ্গে আধা ঘণ্টার বেশি আলোচনার পর বেরিয়ে আসেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। বের হয়ে গাড়িতে ওঠার সময় তাকে ঘিরে ধরে স্মারকলিপি দেওয়ার চেষ্টা করে ‘মায়ের কান্না’ এর সদস্যরা।স্মারকলিপিতে জিয়ার আমলে ফাঁসি হওয়া সেনা ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের হত্যার ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্তে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চাওয়ার বিষয় তুলে ধরেন তারা।

রাষ্ট্রদূত পিটার হাস তাদের কথা না শুনেই তড়িঘড়ি করে গাড়িতে উঠে যান। পরে মার্কিন রাষ্ট্রদূত সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে অভিযোগ করে বলেছেন, এতে তার নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছিল। প্রতিটি রাষ্ট্রদূতকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব ভিয়েনা কনভেনশন স্বাগতিক রাষ্ট্রের উপর আরোপ করেছে, যে বিধানের কথা আন্তর্জাতিক বিচার আদালত তেহরানে মার্কিন দূতাবাস আক্রমণ মামলায় গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করেছেন।

আমরা রাস্তায় বের হলেই দেখতে পাই প্রতিটি রাষ্ট্রদূতের গাড়ির পেছনে অন্তত একটি পুলিশ বোঝাই গাড়ি পাহারায় থাকে। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বেলায় তার ব্যত্যয় হয়নি। এ ধরনের নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা কিন্তু বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশে কোন রাষ্ট্রদূতকে দেওয়া অচিন্তনীয়। যদিও যুক্তরাজ্যে কূটনীতিকদের নিরাপত্তার জন্য একটি বিশেষ পুলিশ বাহিনী রয়েছে, তারপরও দূতাবাসের সামনে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার জন্য এমনকি একজন পুলিশও মোতায়েন করা হয় না, পুলিশের কোন গাড়িও রাষ্ট্রদূতের গাড়ির পাহারায় থাকে না। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশ দূতাবাসে জোরপূর্বক প্রবেশ করে সে সময় ব্যারিস্টারি অধ্যয়নরত রফিকুল ইসলাম মিঞা (পরে বিএনপির মন্ত্রী) এবং আরো দুইজন বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত দুইজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক নূরুল মোমেন খান (মিহির) এবং এম আর আকতার মুকুলকে মারাত্মকভাবে প্রহার করেছিল। রফিকুল ইসলাম মিঞা এবং তার সহচরদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ পুলিশ কোন মামলাও করে নি। সম্প্রতি কিছু মাস্তান লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাস আক্রমণ করে সেখানে বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙচুর করার সময়ও পুলিশি সাহায্য ঘটনা চলাকালেই চাওয়া হয়। কিন্তু পাওয়া যায়নি। পরে পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেনি বা করতে পারেনি। সেই অর্থে আমাদের দেশে যে বিদেশি কূটনীতিকদের যে নিরাপত্তা দেওয়া হয়, তা অভাবনীয়। এতো গেল একটি প্রসঙ্গ।

দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি হচ্ছে, মার্কিন রাষ্ট্রদূত ওই নিখোঁজ বিএনপি নেতার বাড়িতে গিয়ে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলিয়েছিলেন কিনা? এ বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহের অধিকার তার রয়েছে, যা তিনি সশরীরে না গিয়েও সংগ্রহ করতে পারতেন। বিষয়টি যে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিচার বিবেচনার বিষয়বস্তু তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কোন ব্যক্তি 'গুম' হয়েছে মর্মে অভিযোগ থাকলে তা তদন্ত করার এবং বিচারে তোলার দায়িত্ব একান্তভাবেই বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের এবং আদালতসমূহের, যাতে বিদেশি দূতদের নাক গলানো ভিয়েনা কনভেনশন এবং প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইন বিরোধী।

কনভেনশন অনুযায়ী কোন দেশের নাগরিক অন্য দেশে ফৌজদারি মামলায় জড়ালে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাস কর্তৃক তাকে সহায়তা প্রদান করতে হয়, যাকে কূটনৈতিক আইনের ভাষায় 'কনসুলার সহায়তা' বলে। কিন্তু উল্লেখিত ক্ষেত্রে সে কথা প্রযোজ্য ন। বহু শতাব্দী পূর্বে কৌটিল্যের সেই বাণীর প্রতিফলন যেমন 'ওয়েস্ট ফেলিয়া' সন্ধিতে ছিল, তেমনি রয়েছে ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের প্রিয়েম্বলে, যা হলো প্রতিটি রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব স্বাগতিক দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চালানো। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের সম্পর্কে নৈকট্য আনয়ন উভয় দেশের স্বার্থেই বাঞ্ছনীয়। মহাসাগর সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন বাস্তবায়িত রাখার জন্য, অর্থাৎ সকল আন্তর্জাতিক সমুদ্রের উপর এবং তলদেশে সকল রাষ্ট্রের অধিকার রক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্য কটি দেশ 'ইন্দো-প্যাসিফিক' কৌশল নামে যে বেসামরিক ঐকমত্যের প্রচেষ্টারত রয়েছেন, নিজ স্বার্থেই, অর্থাৎ সকল আন্তর্জাতিক সমুদ্রে নির্বিঘ্নে চলাচল এবং সমুদ্রের তলদেশের সম্পদের উপর অপ্রতিরোধ্য অধিকার রক্ষায়, বাংলাদেশও সেই বেসামরিক ঐকমত্যে যোগ দেয়ার কথা বিবেচনা করছে বলে শোনা যায়। এই প্রকল্পের একটি বড় অংশীদার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত বাংলাদেশের সাথে মিত্রতার হাত প্রসারিত করা। আর সেই দায়িত্ব পালনে ঢাকায় তার রাষ্ট্রদূতকে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে। সে উদ্দেশ্যে কূটনীতি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে মার্কিন দূতাবাসের (এবং অন্য সব দূতাবাসের) উচিত বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি থেকে দূরে থাকা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন যথার্থই বলেছেন বাংলাদেশের নির্বাচনী বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার নিরঙ্কুশ এবং একচেটিয়া অধিকার এদেশের মানুষের, বিদেশি কারোর নয়। অন্যান্য দূতাবাসের বেলায়ও কূটনীতি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘ সনদের নির্দেশাবলি মেনে নেয়ার অপরিহার্যতা বুঝতে হবে যাতে এসব কারণে তিক্ততা বিস্তার করতে না পারে। আমাদের দেশের যে সব লোক বিদেশি দূতদের সাহায্য কামনা করছে, তাদের স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার যে- তারা যা করছে তা মীর জাফর কৃত অপরাধ থেকে অভিন্ন নয়। মীর জাফর সিরাজউদ্দোলাকে হটিয়ে নিজে নবাবি দখলের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহায্য নিয়েছিল, আর বর্তমান মীর জাফররা একই ধরনের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বেআইনিভাবে বিদেশি দূতদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন।

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাণ্ডের ফলে বাংলাদেশের মাটিতেই রুশ-মার্কিন বিতর্ক শুরু হয়েছে, যা আমাদের দেশকে আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বের দাবার গুটিতে পরিণত করতে পারে। তিক্ততা পরিহার এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য সকল রাষ্ট্রের উচিত ভিয়েনা কনভেনশনের বিধান অনুযায়ী আমাদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার থেকে দূরে থাকার, নয়তো এমন সময় আসতে পারে যখন তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মিশরসহ অন্যান্য দেশের মতো আমাদেরও সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রদূতদের বিরুদ্ধে ৯ অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করতে হতে পারে।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি