যে আক্ষেপ নিয়ে চলে গেলেন গাফফার ভাই

সৈয়দ নাহাস পাশা
Published : 29 May 2022, 05:14 PM
Updated : 29 May 2022, 05:14 PM

একুশের গানের রচয়িতা, সাংবাদিক ও কলামনিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী নিজে ছিলেন স্বাধীনতা পুরস্কার বিজয়ী; তার বিশ্বাস ছিল, প্রবাসের একটি বাংলা পত্রিকারও সেই সম্মাননা পাওয়া উচিত।

তিনি লিখেছিলেন, "বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং আমাদের স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিপূত পত্রিকা 'জনমত' ছাড়া বিলাতে আর একটিও নেই।

"মুক্তিযুদ্ধ ও জনমত অঙ্গাঙ্গি হয়ে গিয়েছিল। সারা ইউরোপে বাঙালিদের কাছে জনমত হয়ে দাঁড়িয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র বার্তাবহ এবং মুখপত্র। তখন বিলাতে বাঙালি কমিউনিটির একমাত্র মুখপত্র ছিল জনমত।"

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ব্রিটেনে সাপ্তাহিক 'জনমত' এর বছরব্যাপী আয়োজনের সূচনা সংখ্যায় এ কথাগুলো লিখেছিলেন গাফফার চৌধুরী। ওই সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ২০২০ সালের ১১ মার্চ।

শুধু লিখেই হাত গুটিয়ে নেননি একাত্তরের মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র সাপ্তাহিক জয়বাংলার নির্বাহী সম্পাদক গাফফার চৌধুরী। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সাপ্তাহিক জনমত যে অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে, তার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এখন সময়ের দাবি। তাই তিনি নিজে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দাখিল করেছেন, আবেদন পাঠিয়েছেন, জোর সুপারিশ করেছেন।

আবদুল গাফফার চৌধুরী একুশের অমর গানের গীতিকার, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নিরন্তর কলম-সৈনিক, জাতির পিতার স্নেহধন্য, সত্যান্বেষী একজন সাংবাদিক। দেশে-বিদেশে অযুত পাঠক ছিলেন তার ইতিহাস ও তথ্য-নির্ভর বিশ্লেষণী লেখার নিয়মিত পাঠক।

সেই গাফফার চৌধুরী সাপ্তাহিক জনমতকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় ভূষিত করার সুপারিশ জানিয়ে গত এক দশকে তিনবার সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। সর্বশেষে তার নিজের লেখা চিঠি, আনুষ্ঠানিক আবেদনপত্র, সংশ্লিষ্ট দালিলিক প্রমাণ ২০২১ সালের অক্টোবরে ঢাকায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পৌঁছে দেওয়া হয়। 

এর আগে ২০১৪ ও ২০১৬ সালেও তিনি একই সুপারিশ করেছিলেন সরকারের কাছে। জনমতকে কেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া উচিত, সে বিষয়ে একটি ভিডিও বার্তাও তিনি পাঠিয়েছিলেন ২০২১ সালের প্রস্তাবের সাথে।

তার সেসব আবেদন-সুপারিশ কর্তৃপক্ষের বন্ধ দুয়ারে কেবল মাথাই ঠুকে গেছে।  

তার প্রস্তাবের যৌক্তিকতা কি যাচাই করে দেখেছিল রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদান কর্তৃপক্ষ? কেউ কি তলিয়ে দেখেছিল, কেন  গাফফার চৌধুরী বার বার একই আবেদন করে যাচ্ছেন? স্বাধীন বাংলাদেশ আর সাপ্তাহিক জনমত পথ চলেছে একই সরলরেখায়, ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে। ১৯৬৯ সালে অমর একুশের দিনটিতে লন্ডনে জনমতের আত্মপ্রকাশ। 

গণঅভ্যুত্থানের উন্মাতাল দিনগুলোয় বাংলাদেশ তখন প্রকম্পিত। বঙ্গবন্ধুর সুনিপুণ নির্দেশনায় তখন জাতির প্রস্তুতি-পালা নতুন যাত্রার, এবার যেতে হবে স্বাধীনতার মোহনায়। ১৯৭১ অভিমুখে সে যাত্রায়ও শামিল ছিল জনমত। ১৯৭৪ সাল থেকে লন্ডনে প্রবাস জীবনে থাকা আবদুল গাফফার চৌধুরী জনমত- এর সাথী-বন্ধু ছিলেন ৪৮ বছরের বেশি সময় জুড়ে। জনমতের অভিযাত্রার প্রতিটি বাঁকে, প্রতিটি মোহনায় তিনি ছিলেন সহযাত্রী।

এ বছরও স্বাধীনতা পুরস্কারের তালিকায় জনমতের নাম না আসায় হতাশা প্রকাশ করেছিলেন গাফফার চৌধুরী। এ বিষয়ে লিখতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় পেরে ওঠেননি। 

এক আলাপচারিতায় বলেছিলেন, "বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক হচ্ছে স্বাধীনতা পুরস্কার। আর হত্যার দায়ে জেল খাটা আমির হামজা নামের অখ্যাত এক ব্যক্তিকে সাহিত্য ক্যাটাগরিতে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এই কাণ্ডটি স্বাধীনতা পুরস্কারের মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি রাষ্ট্রীয় পদকের মর্যাদা ধুলোয় লুটিয়ে দিয়েছে।"

মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাজ্যসহ গোটা ইউরোপে স্বাধীনতাকামী প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠিত করতে জনমতের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের সময় আব্দুল গাফফার চৌধুরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক 'জয়বাংলা' প্রকাশেরও আগে থেকেই সাপ্তাহিক জনমত প্রবাসীদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের খবর পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করে গেছে। 

গাফফার চৌধুরী সে কথা নিজেই বলে গেছেন। জনমত- এর এই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু অবহিত ছিলেন, সে কথাও তিনি 'বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও জনমত' শিরোনামের এক লেখায় উল্লেখ করেছেন।

একবার নয়, দুবার নয়, তিন-তিনবার তার প্রস্তাব উপেক্ষা করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। অথচ তাদের হাত দিয়েই বিতর্কিত কিংবা অখ্যাতদের নাম উঠেছে স্বাধীনতা পুরস্কারের তালিকায়, সমালোচনার মধ্যে তা বাদও পড়েছে। 

গাফফার ভাই আজ নেই, তার আক্ষেপটুকু মুছে দেওয়ার সুযোগও আর আমাদের থাকলো না।